১৩০ টাকার ব্রয়লার মুরগি কেন ২৬০ টাকা ও অকেজো বাজার ব্যবস্থাপনা

ডিম আগে না মুরগি? এ প্রশ্নের সমাধান করতে হলে আমাদের সবার মাথার চুল উঠে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি, কিন্তু মীমাংসায় পৌঁছানো অসম্ভব। দেশে ডিম আর মুরগির উৎপাদন খরচ আর বিক্রির দামে যে বিস্তর ফারাক, তা দেখে ধ্রুপদি সে প্রশ্নই ঘুরেফিরে মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে। কেউ কি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন, যে ব্রয়লার মুরগির কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা, তা বাজার থেকে প্রায় দ্বিগুণ দামে কেন কিনতে হয়? প্রায় দ্বিগুণ কেন, দ্বিগুণই বলতে হচ্ছে; কেননা শুক্রবারের (১০ মার্চ ২০২৩) প্রথম আলোর বাজারদর অনুযায়ী, ঢাকার ভোক্তাপর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

নতুন করে বলার নেই যে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পাঙাশ, তেলাপিয়া—এসব গরিবের প্রোটিন হিসেবে পরিচিত। গরিব কেন, এখন মধ্যবিত্তেরও বড় অংশের প্রোটিনের চাহিদা মেটায় এ খাবারগুলো। গরু, খাসির মতো প্রাণিজ প্রোটিনের যে উচ্চ মূল্য, তাতে কালেভদ্রেও সেগুলো পাতে তোলা দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। সে ক্ষেত্রে গরিবের সেই প্রোটিনের দামই যেভাবে সিন্ডিকেট ও বাজার কারসাজির মধ্যে অন্যায্য ও অনৈতিকভাবে বাড়ানো হয়েছে, এককথায় তাতে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রোটিন খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অথচ সেটা করা হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার, প্রতিযোগিতা কমিশন—সবার সামনেই।

তা না হলে যে মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা, তা কীভাবে ২৬০ টাকায় কিনতে হবে সাধারণ মানুষকে? ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন মুনাফার জন্য, দাতব্য কাজ করার জন্য নয়; কিন্তু সেটা তো যৌক্তিক সীমার মধ্যে থাকতে হবে। উচ্চ মূল্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন প্রোটিনপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, হাজারও তরুণের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যখন হুমকির মুখে পড়ছে, তখন সরকার যদি নিশ্চুপ থাকে ও সরকারি সংস্থাগুলো যদি হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকে– এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে।

ডিম ও মুরগির উচ্চ মূল্যের প্রেক্ষাপটে ৯ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অংশীজনদের নিয়ে একটা মতবিনিময় সভা ডাকে। সেখানে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, এ খাতের বৃহৎ উৎপাদকেরা কীভাবে সিন্ডিকেট করে ও অদৃশ্য এসএমএসের মাধ্যমে ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ডেইলি স্টারকে দেওয়া তাঁর বক্তব্যটি একনজর দেখে নেওয়া যাক, ‘রাতের বাজারগুলোতে করপোরেট কোম্পানির লোক থাকেন। তাঁরা করপোরেট কোম্পানিকে রাতেই দাম জানিয়ে একটি এসএমএস করেন। পরে সকালে করপোরেট কোম্পানিগুলো মুরগি ও ডিমের মূল্য দেশের বিভিন্ন বাজারে এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। তা ছাড়া কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ আছে। সেখান থেকেও এসব তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই এসএমএসের মাধ্যমে যে দাম নির্ধারণ করা হয়, সে দামটিই বাজারে বাস্তবায়িত হয়। করপোরেট কোম্পানি কম দামে দিতে বললে, সবাইকে কম দামে বিক্রি করতে বলা হয়। আবার বেশি দাম দিলে, সবাইকে বেশি দামে বিক্রি করতে বলা হয়।’

ডিম ও মুরগির বাজার এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার একই অভিযোগ ভোক্তার স্বার্থ দেখা নাগরিক সংগঠন ক্যাবেরও। আর সভায় উপস্থিত পোল্ট্রি শিল্পের বৃহৎ উৎপাদকদের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ছোট খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। আর তাদের মতো করপোরেট পর্যায়ে সেই খরচ ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।

পোলট্রি খামার একটা সময় পর্যন্ত দেশের বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। এ খাতে ছোট ও মাঝারি খামারিদের প্রাধান্য ছিল। বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার সুযোগ না থাকায় স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা সেখানে বজায় থাকত। স্বাভাবিক চাহিদা আর জোগানের ওপর ভিত্তি করে ডিম-মুরগির দামটা স্থিতিশীল থাকত। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র অনুযায়ীই একসময় ডিম, মুরগির এ বিশাল বাজারে করপোরেট খামারিরা প্রবেশ করেন। তাঁদের অনেকে পোলট্রি ফিড, মুরগির বাচ্চাও উৎপাদন করেন। তাঁদের কেউ কেউ সুস্থ প্রতিযোগিতার পথে না গিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপের কারণে ডিম–মুরগির বাজার আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কখনো দাম একেবারেই পড়ে যায়, আবার কখনো দাম ওঠে আকাশে।

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা বিশ্বের অন্যতম অকেজো ব্যবস্থাপনা। এখানে তদারকি সংস্থা থাকলেও বাজার তদারকিতে তাদের ভূমিকা প্রায় শূন্য বা লোকদেখানো। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারেরা এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসা ও সিন্ডিকেট ও কারসাজিতে যুক্ত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার আর রাষ্ট্রযন্ত্রকে এ কাজে ব্যবহার করেন।

পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি যে অভিযোগ করেছেন, সেটা অবশ্য নতুন নয়। গত কয়েক বছরে বেশ জোরেশোরে এ অভিযোগ উঠছে। বৃহৎ খামারিদের একাংশ পুরো বাজারকে অস্বাভাবিক করে রাখে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে। ডিম, মুরগির দাম ভালো পেলে ছোট খামারিরা উৎপাদনে উৎসাহী হন। তরুণেরা তখন সেখানে বেশি বেশি বিনিয়োগ করেন লাভের আশায়। অনেকে জমি বিক্রি করেন, সামান্য সঞ্চয় ভাঙেন, অনেকে ঋণ নিয়ে বা ধারকর্জ করে এ খাতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু এখানেই ছোট ও মাঝারি খামারিদের ট্র্যাজেডিটা শুরু হয়। কেননা, সিন্ডিকেট তখন বাজার কারসাজি করে দাম কমিয়ে দেয়।
বৃহৎ খামারিরা একসঙ্গে অনেক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করায় এবং নিজস্ব বাচ্চা ও ফিড থাকায় উৎপাদন খরচের দিক থেকে স্বাভাবিকভাবেই একটা সুবিধা পান। সাধারণ খামারিদের তুলনায় বৃহৎ খামারিদের উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কম। এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে সিন্ডিকেট। অল্প লাভে হলেও তারা ডিম-মুরগি বিক্রি করে। কিন্তু সে দামে বিক্রি করলে লোকসানে পড়েন ছোট খামারিরা। একবার লোকসান হলে ছোট খামারিরা নতুন করে উৎপাদনের উৎসাহ হারান। সামগ্রিকভাবে উৎপাদন কমে যাওয়ায় পরবর্তীকালে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায়।

পোলট্রি খাতের এ সিন্ডিকেট, বাজার কারসাজির কারণে তিন ধরনের প্রভাব পড়ছে। এক. সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রোটিনজাতীয় খাবারপ্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুই. ডিম-মুরগির দাম বাড়ায় বাজারে মাছ, মাংসের দামও বাড়ছে। তিন. দেশের তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হচ্ছে।
কিছুদিন পরপর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলে থাকেন, দেশের তরুণেরা কেন উদ্যোক্তা হন না, কেন তাঁরা চাকরির পেছনে ছোটেন? পোলট্রি শিল্পের সিন্ডিকেট ও কারসাজি দেখে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক, তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার কোন পরিবেশটা দেশে নিশ্চিত করা হয়েছে? নাকি পুরো পরিবেশ, সব আয়োজন সিন্ডিকেটের পকেট ভরে ফেলার জন্য।

তা না হলে যে মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা, তা কীভাবে ২৬০ টাকায় কিনতে হবে সাধারণ মানুষকে? ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন মুনাফার জন্য, দাতব্য কাজ করার জন্য নয়; কিন্তু সেটা যৌক্তিক সীমার মধ্যে থাকতে হবে। উচ্চ মূল্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন প্রোটিনপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, হাজারও তরুণের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন যখন হুমকির মুখে পড়ছে, তখন সরকার যদি নিশ্চুপ থাকে ও সরকারি সংস্থাগুলো যদি হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকে– এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে।

সূত্র : মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *