সারাদেশ

নজিরবিহীন তাণ্ডবে রংপুরে লন্ডভন্ড সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা

ডেস্ক রিপোর্ট: সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে হঠাৎ করেই দুষ্কৃতিকারীদের অনুপ্রবেশে সহিংস হয়ে ওঠে। এতে রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও উন্নয়ন অবকাঠামোয় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমানে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে স্বস্তি ফিরছে জনমনে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢুকে পড়া নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন এখনো সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ভাসছে।

এদিকে কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার পর এখন তা ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে। অনলাইন গণমাধ্যমের নিয়মিত পাঠকদের জন্য শুক্রবার (১৯ জুলাই) থেকে বুধবার (২৪ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত উত্তরের বিভাগীয় নগরী রংপুরে ঘটে যাওয়া চিত্র তুলে ধরা হলো।

রংপুর নগরীতে শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল থেকেই ছিল না কোনো উত্তাপ। ওইদিন সরকারি ছুটি থাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে সুনশান ছিল পুরো নগর। আগের দিনের (বৃহস্পতিবার) তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নজর কাড়ে সাধারণ মানুষের। এরই মধ্যে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর শান্ত রংপুর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।

এদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জিলা স্কুল মোড়, সিটি পার্ক মার্কেট চত্বর, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানী মোড়, বিএনপির কার্যালয় সংলগ্ন গ্রান্ড হোটেল মোড়, শাপলা চত্বর, পুরাতন ট্রাক স্ট্যান্ড, কলেজ রোড চারতলার মোড়, লালবাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়, মডার্ণ মোড়, দর্শনা মোড়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা ও ধাপ চেকপোস্ট এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়।

এসব মিছিলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী, সমর্থকরা ছাড়ওা দুর্বৃত্তরা অংশ নেয়। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গ্রান্ড হোটেল মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেই মিছিল থেকে বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সাইনবোর্ডে ইটপাকটেল ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এ সময় সমবায় মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, ঢাকা ব্যাংকের বুথে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার আগেই কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় নগরীর আকাশ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন দেয় হামলাকারীরা। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের তাণ্ডবে বাদ পড়েনি সদর হাসপাতাল সংলগ্ন পরিবার পরিকল্পনার কার্যালয়। মা ও শিশুদের জন্য নির্মিত এই সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়াসহ বেশ কয়েকটি যানবাহন আগুন দেন তারা।

এদিকে শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেলের পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মিছিলে রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর থেকে জিলা স্কুল মোড় পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয় রাজপথ। এসময় দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও লাঠিসোঁটা দিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় বিক্ষোভকারীরা। তাদের সরকারবিরোধী স্লোগান আর থেমে থেমে ছোড়া ইট পাটকেলের ঢিল ও ভাঙচুরের তাণ্ডবে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয় পুরো নগরজুড়ে। এই সহিংস পরিস্থিতিতে নগরীর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করার পাশাপাশি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অর্ধশতাধিকেরও বেশি আহত হন। মিলন, সাজ্জাদ ও মিরাজ নামে তিনজনের মৃত্যু হয়। পরে আরো দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে স্থাপিত মুজিব শতবর্ষের দিনক্ষণ গণনার স্থাপনায় আগুন, লালবাগ থেকে পার্ক মোড়ে সড়কের রোড দু’পাশের গাছপালা ভেঙে, সিটি কর্পোরেশনের ফটকে হামলা, মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ভাংচুর, বিভিন্ন চত্বরের বেস্টনি ভাঙচুর, সড়ক নিরাপত্তায় ব্যবহৃত মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি, সাইনবোর্ড ও রোড ডিভাইডারের ক্ষতিসাধন করেন হামলাকারীরা। এরআগের দিন তারা নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি, মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়, আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগর এবং জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

অনেকেই বলছেন, এটি শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদেরকে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকা নয়। অনেক রাজনৈতিক দল ও দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের জানমালের যেমন ক্ষতিগ্রস্থ তেমনি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

শুক্রবার সকালে নগরীর পায়রা চত্বরে আগের দিন (১৮ জুলাই) পোড়ানো বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর পাশের সেন্ট্রাল রোডে নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ও মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ের সামনেও ছিল তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন। সেখানেও আগুনে পোড়ানো কংকাল মোটরসাইকেল পড়ে ছিল। আর পুলিশ ফাঁড়ি ও গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে ছিল ধোঁয়ার গন্ধ। সেখানে থাকা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সবকিছু পুড়ে গেছে। এছাড়া নগরীর মডার্ণ মোড়ে তাজহাট থানার সামনে আগুনে পোড়া তিনটি ট্রাক, থানার ভিতরেও ছিল দগদগে ক্ষতচিন্থ। এর পাশে রংপুর মডেল কলেজ সংলগ্ন সড়কে আরো তিনটি আগুনে পোড়া গাড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায়।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) পার্ক মোড় থেকে মর্ডাণ মোড় হয়ে মডেল কলেজ সংলগ্ন সড়কের আশপাশসহ প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে বিভিন্ন দলের নেতকর্মী, সমর্থক, সাধারণ মানুষরা অবস্থান নেন। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হটিয়ে তাজহাট থানা ঘেরাও করে। পরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে থানার ভিতরে বাইরে আগুন দেন বিক্ষুদ্ধরা। এদিন মানিক মিয়া নামে এক অটোচালকের মৃত্যু হয়।

এদিকে সারা দেশে কারফিউ জারির পর শনিবার (২০ জুলাই) রংপুর নগরীর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা টহলের পাশাপাশি দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রাখে। এতে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, ধ্বংসযজ্ঞ তাজহাট থানা, গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশ লাইন্সসহ সমস্ত কিছু দেখেছি। যারা হামলা চালিয়েছে এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। নৈরাজ্যের চরম অবস্থা, কোনো ভাবেই এরা (হামলাকারীরা) দেশপ্রেমিক মানুষ নয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে অনেক ফুটেজ রয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে থাকা সব ফুটেজ, ছবি, তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অবশ্যই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *