খেলার খবর

ছবির দেশে, কবিতার দেশে অলিম্পিকের রোশনাই

ডেস্ক রিপোর্ট: প্যারিস। স্থানীয় উচ্চারণে ‘পাগি’। শহরটার কথা শুনলে আপনার চোখে কী ভেসে ওঠে? আইফেল টাওয়ার? ল্যুভ মিউজিয়াম? 

শেষ কিছু দিনে এ দুই স্থাপনার আশপাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আপনি দেখতে পাবেন তাদের গায়ে একটা লোগোর উপস্থিতি। পাঁচ রঙা পাঁচটা বৃত্ত একে অপরকে জড়িয়ে। এ চিহ্নটাও আপনি চেনেন। অলিম্পিকের চিহ্ন এটা। দুয়ের মিশেল নিরবে জানান দিচ্ছিল, প্যারিসে আসছে অলিম্পিক। 

প্যারিসকে বলা হয় সারাবিশ্বের শিল্পের রাজধানী। কবিদের, শিল্পিদের দেশ নাকি থাকে দুটো, একটা তার মাতৃভূমি আরেকটা এই প্যারিস। আপোলিনিয়নেয়ার, মোপাসা, শার্ল বোদলেয়ার, ভিক্টর হুগোদের শহরে, দেশে ঘুরে সুনীল গঙ্গোপধ্যায় যার নাম দিয়েছিলেন ‘ছবির দেশ, কবিতার দেশ’। সে ছবির দেশে, কবিতার দেশে অলিম্পিক ২০২৪ বোধিত হলো গত রাতে। সেখানেও স্বকীয়তা রইল। রোশনাই ছড়িয়ে, জমকালো সব আয়োজনে অলিম্পিকের আবাহন ঘোষিত হলো সেন নদীর পাড়ে। 

শেষ বার এই প্যারিস যখন অলিম্পিক আয়োজন করেছে, তখন আর এখনকার বিশ্বের চেহারা পাশাপাশি ধরলে চেনাই যাবে না। মাঝে একটা প্রলয়ঙ্করী মহাযুদ্ধ দেখে ফেলেছে পৃথিবী, একটা স্নায়ুযুদ্ধের দেখা মিলেছে, পরাশক্তি ভেঙে নতুন কতশত দেশ হয়েছে, মানুষের দিনযাপনে যুক্ত হয়েছে কতশত প্রযুক্তি… তার মাঝেও প্যারিস রয়ে গেছে তার আগের মোহনীয় চেহারাতেই। শিল্পগুণের বিচারে আলাদা কদর ছিল এই শহরের। এতটাই যে শাসকদের (পড়ুন ‘আগ্রাসক’) যুদ্ধ মানসিকতাও এতে বিন্দুমাত্র ছেদ ফেলতে পারেনি। একটা মহাযুদ্ধেও তাই সসম্মানে অক্ষত রয়ে গেছে প্যারিস। 

শেষ অলিম্পিকটা এখানে হয়েছিল ১৯২৪ সালে। সে অলিম্পিকের সময় চার্লস কস্তের বয়স ছিল মাসতিনেক। এরপর তিনি বড় হয়ে ফ্রান্সকে অলিম্পিক সোনা এনে দিয়েছেন। ঢুকেছেন ইতিহাসের পাতায়। ফ্রান্সের অলিম্পিক সোনাজয়ীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিটি এখন তিনি। ২০২৪ সালে এসেও তিনি জানান দিয়েছেন নিজের উপস্থিতি। হুইল চেয়ারে করে এলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এরপর তার হাত থেকে নিয়ে জ্বালানো হলো অলিম্পিকের মশাল। তার আগে ফরাসি ফুটবল কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান স্তাদ দে ফ্রান্স থেকে মশাল দৌড় নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তাই এসে শেষ হয় কস্তের হাত হয়ে। 

সেন নদী ধরে একের পর এক কন্টিনজেন্ট এসে হাজির হয়েছে অনুষ্ঠানে। অলিম্পিকের জন্মভূমি গ্রীস, এরপর শরণার্থীদের দল নৌকায় করে এসেছে শুরুতে। তার পর থেকে বর্ণানুক্রমিকভাবে একে একে সব দেশ এলো অনুষ্ঠানটাতে। 

ফ্রান্স অবশ্য শুধু ছবির দেশ কবিতার দেশই নয়। এখানে নেপোলিওন, জন অফ আর্কের মতো মানুষদেরও তো উপস্থিতি ছিল সরবে। প্রায় ৬ শতক পর জন অফ আর্ককেও ফিরিয়ে আনা হলো গত রাতে। না জন অফ আর্ক নিজে নন, তার সাজে একজন এলেন অনুষ্ঠানে। রুপালি পোশাক গায়ে চড়িয়ে, রুপালি হুডিতে মুখ ঢেলে ধাতব ঘোড়ার পিঠে চড়ে সেন নদীর ওপর দিয়ে এলেন তিনি। পিঠে থাকা অলিম্পিকের পতাকাটা অর্পণ করলেন মঞ্চে।

এ অনুষ্ঠানে গতকাল সেলিন ডিওন এসেছিলেন। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো জনসমাগমে পারফর্ম করেন তিনি। তার আগে পরে লেডি গাগা, আয়া নাকামুরাদের মতো বিশ্ববরেণ্য শিল্পীরাও এসে মাতিয়েছেন মঞ্চ। তার আগে পরে সেন নদীর আশেপাশে বাসার ছাদও দেখেছে নৃত্যশিল্পীদের নান্দনিক সব নাচ।

প্যারিসের সৌন্দর্য্যের কারণে এবারের অলিম্পিক নান্দনিকতার পরাকাষ্ঠা আগে থেকেই ছিল। গত রাতে যখন এখানে যখন শিল্প আর ইতিহাসও এসে যুক্ত হলো, তা যেন নতুন মাত্রাই পেয়ে গেল। শিল্পের সঙ্গে বৃষ্টির যেন কোথায় একটা যোগ আছে। গতকাল প্যারিসের আকাশ কেঁদে জানান দিল, এবারও সে যোগটা টুটে যায়নি একটু। 

অলিম্পিকের নিজেরও অবশ্য একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা গোটা বিশ্বকে এক সূত্রে গাঁথা। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি তার উদ্বোধনী বক্তব্যে সেটা জানালেন আরও একবার। শুধু কথায় নয়, কাজেও সেটা করার চেষ্টা করেছে আইওসি। ৫২৫০ জন প্রতিযোগী এবার খেলছেন অলিম্পিকে, অর্ধেক তার নারী, অর্ধেক তার পুরুষ। ইতিহাসে এমন সাম্য আর কখনো দেখা যায়নি অলিম্পিকে। 

আলোর রোশনাইয়ের নিচে অন্ধকারও ছিল বৈকি। এ অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগে প্যারিসের রেলে দুর্বৃত্তদের হামলা আয়োজনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন অ্যাথলেটরাও তুলেছেন। তবে তীব্র নিরাপত্তার জালে ঢেকে গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটাকে ভালোভাবে শেষ করেছেন আয়োজকরা। 

এ অনুষ্ঠানের মতো এখন বাকি টুর্নামেন্টটাও এমনই অনিন্দ্য সুন্দরভাবে শেষ হোক, আয়োজকরা নিশ্চয়ই তাই চাইবেন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪ ডট কম-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *