সারাদেশ

সহিষ্ণুতার নান্দনিক নীড় নির্মূলের পীড়া

ডেস্ক রিপোর্ট: সহিষ্ণুতার নান্দনিক নীড় নির্মূলের পীড়া

ছবি: বার্তা২৪.কম

অত্যধিক সহিংসতা এবং অমানবিকতা নিয়ে আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা প্রায় নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই অধৈর্য এবং রূঢ় হয়ে পড়ছি। দিন দিন মানুষ অমানবিকতাকে আঁকড়ে ধরছে, যা বিভক্ত এবং অস্থির করে তুলছে আমাদের সমাজকে।

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া যে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা গেছে তা হলো নির্দয়তা। হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও চিত্রগুলোতে আমরা কোনো মানবিক আচরণ দেখতে পাইনি। একজন নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে পুলিশ গুলি চালায়; তাকে কীভাবে মানুষ ভাবা যায়? আর যে পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নির্মমভাবে নিহত হয়, তার লাশ ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ধরনের আচরণকেও মানবিক বলা যায় না। 

আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, প্রতিপক্ষকে যেকোনো অবস্থাতেই নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্মূল অর্থাৎ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, কোনো চিহ্নও রাখা হচ্ছে না। যারা হত্যাযজ্ঞ থেকে দূরে ছিল এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল না, তারাও সন্ত্রাসীর মতো আচরণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য যত উপায় আছে সবই প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রতিদিন গুজবের নতুন নতুন কারখানা আবিষ্কার হচ্ছে এবং এসব কারখানা থেকে উৎপাদিত ‘পণ্য’ নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ ধরনের আচরণ সমাজকে করে তুলছে আরও অস্থিতিশীল।

ভয়াবহ দিক হলো ভয় দেখিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। দুপক্ষই তাদের মতের বিপরীতে থাকা মানুষদের তালিকা করে রেখেছে, যেমন একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই প্রবণতা আমাদের সমাজকে আরও ভয়ানক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। বিপরীত মতকে সহ্য করতে না পারার এই প্রবণতা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এখন তা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমার বিপরীত মত অর্থাৎ আমার শত্রু, তাকে যে কোনো মূল্যে নির্মূল করতে হবে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ভিন্নমতকে সহ্য করা এবং তাকে সম্মান জানানোর প্রবৃত্তি গড়ে তোলা সমাজের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। পক্ষ ও প্রতিপক্ষের মধ্যে পার্থক্য সমাজের সৌন্দর্য বাড়ায়। মত কিংবা দ্বিমত না থাকলে কোনো দেশ, সমাজ, বা জাতি সামনে এগোতে পারে না। আমাদের দেশে সবাইকে ‘সহমত ভাই’ হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, কেউ যদি দ্বিমত করে তবে তাকে ‘নাস্তিক’ বা ‘রাজাকার’ বলা হয়। এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, এতে কোন সংশয় নেই।

আমাদের দেশের কি কোনো আশা নাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার? মত এবং দ্বিমতকে সম্মান জানানোর মানসিকতা গড়ে তুলতে কি আমরা আদৌ সক্ষম হবো? আমরা কি সারাজীবন মূর্খ, গণ্ড, একগুঁয়ে এবং অহংকারী হয়েই থাকবো?

এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের প্রথমেই নিজেদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে একে অপরের মতামতকে সম্মান জানাতে হয়। সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতা আমাদের সমাজের ভিত্তি হওয়া উচিত।

সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার পাশাপাশি সমাজে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার চর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহমর্মিতা মানুষকে অন্যের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে এবং তাদের সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে সহমর্মিতা থাকলে মানুষ একে অপরের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়। এ ধরনের মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সর্বত্র এই গুণাবলির চর্চা করতে হবে।

সমাজে মতের পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই পার্থক্যকে সম্মান করার মানসিকতা থাকতে হবে। এই মানসিকতা গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সহিষ্ণুতা, এবং সহনশীলতা গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে।

সমাজে সহিংসতা এবং অমানবিকতার পরিবর্তে মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, এবং সহনশীলতার চর্চা করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশ এবং সমাজ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের দেশেও আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আমাদের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক

প্রশ্নবিদ্ধ-গণমাধ্যম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ভালো কথা, বাংলাদেশেও দেখছি সরকারি প্রচার মাধ্যম তো অবশ্যই, ব্যক্তিমালিকানাধীন গণমাধ্যমও সরকারের হয়েই প্রচার চালায়; সরকার-বিরোধীরা প্রশ্রয় পায় না। গণমাধ্যমের প্রচারে উন্নতির খবর পাওয়া যায়, দুর্দশার খবর ও কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে থাকে।

প্রচারের শক্তির চেয়েও অধিক শক্তিশালী হচ্ছে মতাদর্শের শক্তি। প্রচার অস্থায়ী, মতাদর্শ স্থায়ী। প্রচার পারে অত্যাচারকে আড়াল করে রাখতে, মতাদর্শ ইচ্ছা করলেই পারে মানুষকে আটক করে রাখতে। মতাদর্শকে রক্ষা করার জন্য মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে; এবং প্রাণ দেয়ও।

মতাদর্শ অবশ্য দু’রকমের হয়। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল মতাদর্শ বন্দি করে না মুক্তি দেয়, মানুষকে এগিয়ে নেয় মুক্তির অভিমুখে। ব্যক্তিকেই এগিয়ে নেয় বটে, কিন্তু কাজটা করে সমষ্টির ভেতরে থেকে এবং সমষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে। তবে প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শেরই আকর্ষণ অধিক। কারণ ব্যক্তির ভেতর সুপ্ত থাকে স্বার্থপরতার যে বোধ তাকে সে উত্তেজিত করে, জাগিয়ে তোলে, ভাবতে শেখায় যে ব্যক্তিমালিকানাতেই বাস করে সর্বোচ্চ সুখ। ব্যক্তি যদি বিচ্ছিন্ন হয় তবে সে যে পক্ষ ধরে আত্মকেন্দ্রিকতার, নদীর ঢেউ না হয়ে এগিয়ে চলে পাড়ের বালুকণায় পরিণত হবার দিকে, সেই সত্যটা বেমালুম ভুলিয়ে দেয়।

প্রতিক্রিয়াশীলতা রং ঢং জানে, নিজেকে সাজাতে পারে নানান সাজে, কারণ তার চরিত্রটাই হচ্ছে প্রতারণার, লোক দেখানোর ও লোক ঠকানোর, জাদুকরেরা যেমনটা করে থাকে নিজেদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য। প্রগতিশীলতা সে কাজ পারে না। তার দায়িত্ব থাকে সত্য বলার এবং সত্যই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় এটা সত্য হলেও পথিমধ্যে আপাত-সুন্দর মিথ্যার মোহবিস্তারের ব্যাপারটা চলতে থাকে। বিশ্বে এখন যে মতাদর্শের কর্তৃত্ব চলছে তার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ এক সময়ে প্রগতিশীল ছিল, যখন সামন্তবাদের নিগড় ভেঙে সে পথ করে দিয়েছিল মানুষের জন্য মুক্তির; কিন্তু এখন সে তার প্রগতিশীলতা খুইয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। তাই তো দেখি ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালায় তখন পুঁজিবাদী বিশ্বের শাসকশ্রেণি প্রতিবাদ করবে কী উল্টো তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে। সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সশরীরে অকুস্থলে গিয়ে হাজির হন, এবং বিলম্ব না করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও দৌড় দেন; ইরাক আক্রমণের সময়ে জর্জ বুশের পিছু পিছু যেভাবে ছুটেছিলেন জন ব্লেয়ার। তাদের মোটেই মনে পড়ে না যে ফিলিস্তিনিরা লড়ছে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও রক্ষা করার জন্য, আর ইসরায়েলিরা যা করছে তা হলো জবরদখলের এলাকাটাকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা ভিন্ন অন্যকিছু। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ফিলিস্তিনিদের জন্য বোমার চাইতেও ভয়ঙ্কর যে বিপদ অপেক্ষা করছে সেটা হলো রোগের বিস্তার। ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়েছে, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। বিশ্বখাদ্য সংস্থা শুনতে পাচ্ছে গাজাতে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি।

ইসরায়েল গাজাতে যে ভাবে মানুষ, বিশেষ করে শিশু হত্যা ঘটিয়ে চলেছে তা গণহত্যা ভিন্ন অন্যকিছু নয়, কিন্তু মিডিয়া তাকেই বলছে যুদ্ধ। বলে চলেছে যে সন্ত্রাসীদের দল হামাসের দলের সঙ্গে ইসরায়েলি নিয়মিত সেনাদের সংঘর্ষ বেঁধেছে। অথচ হামাস নয়, লড়ছে সকল ফিলিস্তিনিই, জবরদখলের বিরুদ্ধে। গাজা একটি কারাগার। গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বোমার আতঙ্কে মানুষ সেখান থেকে পালাতে চায়। কিন্তু পালাবার জায়গা নেই, পথও নেই খোলা। সকল পথ অবরুদ্ধ। ফিলিস্তিন তো ফিলিস্তিনিদেরই আবাস। জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে ঐতিহাসিক ভাবে অত্যন্ত মূল্যবান এই ভূখ-ে মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে, এটাই হবার কথা ছিল। হয়নি। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইহুদিদের জন্য একটি বাসভূমি স্থাপনের ‘প্রয়োজনে’, মূলত কর্তৃত্বকারী ব্রিটিশের উদ্যোগে, ফিলিস্তিনের একটি অংশ কেটে নিয়ে ইসরায়েল নামে একটি ইহুদি বর্ণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে ইসরায়েল তার দখলদারিত্ব বাড়াতে থাকে, এবং ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনিদের ২২ শতাংশ ভূমি ইসরায়েলের দখলে চলে গেছে। এখন তো মনে হয় ফিলিস্তিনিদের বসবাসের এলাকাটুকুও দখল করে নেবে।

মিডিয়া কখনোই নিরপেক্ষ নয়। সবসময়েই ক্ষমতাবানদের পক্ষে। তাই দেখি ইউক্রেনে রুশ হামলায় ২ জন মানুষ মারা গেলে মস্ত বড় খবর হয়, কিন্তু ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে গাজার হাসপাতালে যখন এক লহমায় ৫০০ মানুষ প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী, তখন তা দাঁড়ায় একটা সংখ্যা মাত্র। মার্কিন গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে লেখা ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি বুদ্ধিজীবীদের একটি ‘খোলা চিঠি’তে যে প্রশ্নটা করা হয়েছে তা সহস্র সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, বিশ্ববিবেক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব যদি এখন সত্যি সত্যি থাকতো তাহলে। ‘খোলা চিঠি’টিতে প্রশ্নটা এই রকমের : “কেন আমরা সাংবাদিকতার জায়গা থেকে চাপ প্রয়োগ করছি না, কেনই-বা আমরা গাজায় যুদ্ধাপরাধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বানোয়াট ছবিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলছি না?”

ইসরায়েলির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন যে ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, মনুষ্যবেশধারী জানোয়ার বটে। মন্ত্রীর কথাটা এমন ভাবে প্রচার করা হয়েছে যেন ওটি কোনো ইতর প্রাণির আওয়াজ নয়, বীরের উক্তি।

বিবেকবান মানুষদের দিক থেকে প্রতিবাদ অবশ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই হচ্ছে। তবে তা আগের দিনের মতো প্রবল নয়। প্রতিবাদের সংবাদ আবার প্রচারও পাচ্ছে না। খোদ ইসরায়েলেই প্রতিবাদ হয়েছে। হয়েছে রাষ্ট্রীয় হুমকির মুখেই। ইসরায়েলে বসবাস করে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করায় বিক্ষোভকারীদেরকে ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছে সে দেশের পুলিশ। ৬৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রথম পর্যায়েই। ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য ক্ষোভে পদত্যাগ করেছেন বাইডেনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন। উল্টো দিকে আবার ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এই অভিযোগে যে, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যারা বিক্ষোভ করছে তাদেরকে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

‘ইয়থ ম্যাটার্স’-এর জরীপে শতকরা ৭৫.৫ জানিয়েছে যে বাংলাদেশে তারা নিজেদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেই নিশ্চয়তা বোধ করে না। ৭১.৫ শতাংশের মতে মতপ্রকাশের ব্যাপারে তাদের ভেতর ভয় কাজ করে। ৫০ শতাংশের দেখতে পাচ্ছে দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই। ৮৮.৯ শতাংশের মতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। শতকরা ৬৮ জনের ধারণা গত পাঁচ বছরে অবস্থার উন্নতি নয়, অবনতিই ঘটেছে। তবে এসবের মধ্যেও ৪৮.৭ শতাংশ তরুণ কিন্তু জানিয়েছে যে ভবিষ্যতে তারা উদ্যোক্তা হতে চায়। এটা খুবই ভালো কথা। সংখ্যাটা আরও বড় হলে আমরা আরও উৎফুল্ল হতাম। কিন্তু আমরা জানি যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, তারাও পারবে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্যবইয়ের খোঁজ না করে বিসিএস পরীক্ষায় কাজে লাগবে এমন বই পড়তে যায় তার জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়, দায়ী সেই ব্যবস্থা যা তাদেরকে উদ্যোক্তা হতে নিষেধ করে; বলে সরকারি চাকরির চেষ্টা করো, না-পারলে বেকার থাকো। হতাশায় নিমজ্জিত থাকো। তাহলেই তারুণ্যের বিদ্রোহের শক্তি-সাহস আর থাকবে না, শাসকদের অভীষ্ঠ লক্ষ্য তো সেটাই।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

;

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান: হাতে পাঁজি মঙ্গলবার

ছবি: অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

গোঁয়ার্তুমি না করে, কোটা সংস্কার আন্দোলন কতদূর যেতে পারে সুচিন্তিতভাবে সেটা আওয়ামী লীগ ও সরকারের আগেই বোঝা উচিত ছিল। সরকারের প্রতি একশ্রেণির মানুষের ক্ষোভ আছে, ফলে এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আন্দোলন দমনের বিষয়ে ‘অতিআস্থা’ নামক নির্বুদ্ধিতা ছাড়া সেটা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না। এ বিষয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, আমি নিজেও ছিলাম তারমধ্যে একজন। কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা মানসিক সমর্থন ছিল। এই নির্দোষ সমর্থনটা যতটা না ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি, তারচেয়ে বেশি সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও অনাস্থার জায়গা থেকে উত্থিত।

আওয়ামীবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনকারীদের ব্যানারকে পূঁজি করে সরকারবিরোধী নাশকতা করবে সেটা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধিমান হবার দরকার ছিল না। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা, হেফাজতের সমাবেশ, নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাই বলে। আগের ওসব সরকারবিরোধী ইভেন্টগুলিতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারবিরোধী সংগঠনগুলির বপু যতো বিশাল‌ই হোক-না-কেন তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোটায়। এদের অবস্থা ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো, অন্যের ঘাড়ের উপরে বসে ছাড়া স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা এরা রাখে না। ফলে সাংগঠনিক ক্ষমতাহীন এসব সংগঠনসমূহ ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ নিয়েছে। এরা যা করেছে তা ঠিক করেনি, খুবই অন্যায় করেছে।
সরকারবিরোধী কাজ করতে গিয়ে এরা রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়েছে। রাষ্ট্রের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তবে আওয়ামী লীগ‌ও এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না; কারণ, এই আন্দোলনকে এই পর্যায় পর্যন্ত গড়াবার ব্যর্থতার দায় তাদের আছে। এটা কোনোভাবেই এই পর্যায় পর্যন্ত আসার কথা নয়। ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’ বাগধারার অর্থ, সমাধানের সহজ পথ থাকতে জটিল পথের অবতারণা করা। আওয়ামী লীগ সেই কাজটাই করেছে। এই সমস্যার সমাধান সহজ ছিল যা অঙ্কুরেই সমাধান করা যেতো।

সরকার হয়তো হেফাজতের আন্দোলন দমনের অভিজ্ঞতা থেকে এই আন্দোলন দমনে এক‌ই কৌশল প্রয়োগ করে সফল হবার কথা ভেবেছিল। কিন্তু হেফাজতের আন্দোলন আর এই আন্দোলন যে এক নয়, সেই সহজ হিসাবটা বোঝেনি। হেফাজতের আন্দোলনের সময় গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তি যুগপৎভাবে মাঠে ছিল। তারা জানপ্রাণ দিয়ে সকল অপপ্রচার, অপকৌশল, স্যাবোটাজ ইত্যাদি প্রতিহত করেছিল। সে সময়ে সাইবার যুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কোনোভাবেই যুত করে উঠতে পারেনি।

গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে সারাপৃথিবীর বাঙালি সমাজ তাদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। ফলে অনলাইন, অফলাইন ও রাজপথে জনমত ছিল সরকারের পক্ষে। স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা আওয়ামী লীগের বৈশিষ্ট্য। গণজাগরণ মঞ্চকেও নানা ছুতোয়, নানা বাহানায় ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ফলে আজ সেই সময়ের অধিকাংশ সাইবার যোদ্ধা‌ই এই সময়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে লেখেনি, তারা নীরব ছিল। এবার সাইবার জগত চলে গিয়েছে আওয়ামীবিরোধীদের দখলে। সে সময়ে যে ইন্টারনেট ও সাইবার জগত ছিল আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ, নিজেদের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকদের আপন না ভাবার ব্যর্থতায় এবার তা হয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য অভিশাপ। এ কারণে উপায়ন্তর না পেয়ে সরকারকে ইন্টারনেট বন্ধ করে পিঠ রক্ষা করতে হয়েছে। এভাবে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে সরকার দেশের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে। এই কয়েকদিনে দেশের যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুদ্ধের সময়ের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বেশি বলে প্রতীয়মান। আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকরা দেশের স্থিতিশীলতা ও সম্পদ রক্ষায় যে কতোটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে সেটা এবার প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমার মতে, আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো সময়োপযোগী করা উচিত। বর্তমান সময়ে ‘অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখক লীগ’ জরুরি ভিত্তিতে গঠন করা উচিত। রাজপথের আন্দোলনের চেয়ে অনলাইনের আন্দোলন এখন বেশি জরুরি। তাছাড়া অনলাইনের এক্টিভিস্টরা যে রাজপথেও অগ্রগামী থাকে, গণজাগরণ মঞ্চ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

গণজাগরণ মঞ্চ চলার সময়ে রাস্তা বন্ধ করার জন্য যে রোড-ব্লকগুলো দেওয়া হয়েছিল সেখানে লেখা ছিল ‘রাস্তা বন্ধ, জাতি সংস্কারের কাজ চলছে’। গণজাগরণ মঞ্চ জাতি গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্লিয়ার মেসেজ সম্বলিত ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়েছিল। মেসেজটা ছিল- এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের, কখনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের হবে না। আওয়ামী লীগ সেই ব্ল্যাংক চেককে কাজে লাগাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের পক্ষে যুদ্ধ করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধ করে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের এই আওয়ামী লীগের সময়েই জীবন বাঁচাতে দেশের বাইরে গিয়ে এসাইলাম নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। যারা দেশে আছেন তারাও সবাই অবমূল্যায়িত। অথচ রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় সাপোর্ট দেবার জন্য এনাম মেডিকেলের মালিককে কেবিনেটে স্থান দেওয়া হয়েছিল।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরাও সাভারে গিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমি নিজেই একটানা তিনদিন সাভারে ছিলাম। যে রক্তক্ষয়ী পথে গিয়ে কোটা সমস্যার সমাধান হলো এমন সাংঘর্ষিক ও রক্তক্ষয়ী পথ কাম্য ছিল না। কাম্য ছিল সহজ সমাধান এবং সেটা সম্ভবও ছিল। এখন যেভাবে সমাধান হলো তাতে সমাধানের সাথে আরও কিছু ক্ষোভ, হতাশা, আশঙ্কা, অনাস্থা, অবিশ্বাস ইত্যাদি যোগ হয়ে সমাধান হলো। এগুলো সহজে নির্মূল হবে না, জনমনে থেকে যাবে। পরবর্তীতে ছোটখাটো কোনো সমস্যা দেখা দিলেও সেখানে এগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সমস্যা সমাধান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। মুখে যা-ই বলুক-না-কেন আওয়ামী লীগের কপালেও চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে।

যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে আওয়ামী লীগের অন্ন সংস্থান হয়, অতিআস্থায় একগুঁয়েমি করে সেটাকে এমন রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সমাধান করলো যে, নতুন প্রজন্মের কাছে সেই মুক্তিযুদ্ধ‌ই কিছুটা হলেও সম্ভ্রম হারাল। ফলে শুধু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের অন্ন জুটবে বলে মনে হয় না। এ কারণে আওয়ামী লীগের আমলানির্ভরতা আরও বাড়বে। গণমানুষের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া একটি পুরানো ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের জন্য এটা একটা বড়ো নৈতিক পরাজয়। যদিও ইতোপূর্বেই তাদের এই নৈতিক পরাজয় হয়ে গেছে, এখন সেটার পুরুত্ব অবিচ্ছেদ্য স্তরে চলে গেলো।

আওয়ামী লীগ একটা অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল, উপরন্তু তারা সরকারে আছে। যে নাশকতাগুলো করা হয়েছে সেগুলোর তথ্য কেন আগে থেকেই সরকার পেলো না, এটি খানিকটা বিস্ময়ের। সুযোগসন্ধানী ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুদেরকে বলি- এভাবে আন্দোলন করে সফল হ‌ওয়া যায় না। এ মানুষগুলোর মৃত্যুর দায় আপনাদেরও। এটি প্রতীয়মান যে, বিতর্কিত ইশ্যুগুলিকে সরাসরি নিজেরা না করে আদালতের মাধ্যমে করানো আওয়ামী লীগের একটি কৌশল। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ছিল, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ‌ই আদালতের মাধ্যমে কবর দিয়েছে। কোটা ইশ্যুতেও আওয়ামী লীগ একই কৌশল নিয়েছিল। কোটা নির্ধারণের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। নির্বাহী বিভাগ থেকে আইন বিভাগ হয়ে এটা বিচার বিভাগে যাবার কথা। আওয়ামী লীগ আগেই সেটা বিচার বিভাগের হাতে তুলে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। ফলে কোটা আন্দোলন শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের ভাবটা এমন যেন- আমি কিছু জানি না, ভাজা মাছটা কেমনে উল্টে খেতে হয় তাও জানি না, আদালত সব জানে। যদিও সরকার চাইলে ৩৬৫ দিনের যে-কোনো দিন, যে-কোনো সময় আদালত বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই করা উচিত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধপ্রীতি প্রমাণের বহু অপশন আছে। আওয়ামী লীগ অনেককিছুই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের অনুভূতি ছুঁয়ে মনে দাগ কাটতে পারে এমনভাবে কাজগুলো করতে পারেনি। নিজেদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর নামে এতো বেশি কিছু করে ফেলেছে যে, মানুষ তাতে ত্যক্তবিরক্ত হয়েছে, ফলে অন্য সবকিছু এই বিরক্তির নিচে চাপা পড়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা- ইত্যাদি ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো সব অর্জনকে খেয়ে ফেলেছে। এই ‘না-পারার’ ব্যর্থতা ঢাকতে দলটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা অতিরিক্ত রেখে মুক্তিযুদ্ধপ্রীতি প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই সমাধানটা আওয়ামী লীগের জন্য নাকে খত দিয়ে নিজেদের ফেলানো থুথু নিজেদের জিহ্বা দিয়ে চেটে খাবার মতো হয়ে গেলো।

বাকশাল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এক সর্বনাশ হয়েছিল, কোটা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বের কারণে এবার আরেক ক্ষতি হলো। সেইসাথে এ দেশের সেরা অর্জন, সেরা ত্যাগ একাত্তরের অর্জন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা প্রশ্নসাপেক্ষ হলো। আওয়ামী লীগের এই জেদ, নতুন প্রজন্মের কাছে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার নামকে কিছুটা হলেও এক‌ই কাতারে নামিয়ে আনতে ভূমিকা রাখল। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাকে এমন অশ্রদ্ধার জায়গায় আনার দায় আওয়ামী লীগের আছে। কোটা সংস্কারের মতো একটি ‘তিল’ আওয়ামী লীগের জিদ, গোঁয়ার্তুমি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার কারণে ‘তাল’ হয়ে তালগোল পাকিয়েছে। এরপর যে সমাধান হয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগ বুক চিতিয়ে যেভাবে কৃতিত্ব দাবি করছে তা বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্ব, বিবেকহীন ঔদ্ধত্য ও নির্লজ্জতা। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। অনেকগুলো তরুণ তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দায় কে নেবে? দায় নিলেই-বা কি! যে গেছে সে গেছে, যার গেছে সে বুঝতেছে কষ্ট কাকে বলে!

এই দেশে, যে ছাত্র আন্দোলনের ফসল ভাষা আন্দোলন এবং তার‌ই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, সেই ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার রাজপথ। যে তরুণ সমাজ স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসিত ভূখণ্ডে রক্ত দিয়েছে, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ করার জন্য রক্ত দিয়েছে, সেই তরুণ সমাজকে আজ স্বাধীন বাংলাদেশে একটা চাকরির জন্য রক্ত দিতে হচ্ছে! ধিক্ দেশের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

অতিআত্মবিশ্বাসে আহাম্মকি করে নিজেদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের কোন নেতারা মাঠে নামিয়েছিল জানি না। তাদের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে মানুষ বিরক্ত হলো, নিজেদের সহযোগী সংগঠনটির নেতাকর্মীদের‌ও প্রাণ গেলো, খালি হলো অনেক মায়ের বুক। কেউ কারো না, যে যায় সে যায়‌ই। পরে যদিও ছাত্রলীগকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে কিন্তু তার আগেই এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির ভয়াবহরকম ক্ষতি হয়ে গেছে। ফলে ছাত্রলীগ থেকে দল ত্যাগের হিড়িক‌ও লক্ষ করা গেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির রুম ভাঙচুর হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের কোমর অনেকটাই ভেঙে গেলো। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার পথ কঠিন হয়ে গেলো। ছাত্র সংগঠন হয়েও এখন ছাত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের ঐতিহ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হলো।

তৃণমূল পর্যায়ে সম্পৃক্ততাহীন লোকজনকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নৈকট্য এবং নেত্রী-জিকির কোটায় নেতা বানানোর খেসারত তো দিতে হবে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বগুলো তার‌ই ফল। বর্তমান নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলল। যে রক্তাক্ত ইতিহাস তৈরি করল তা দলটির জন্য কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। বর্তমান নেতৃত্ব আগামীর নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ রেখে গেলো। জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে দুর্নীতিবাজদের দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার একজন দুর্নীতিবাজের প্রাণ‌ও নিতে পারেনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে থাকা তরুণদের তাজা প্রাণ কেড়ে নিতে পেরেছে। কোটা সংস্কারের দাবি করা তরুণটি আওয়ামী লীগের শত্রু, কিন্তু দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়া দুর্নীতিবাজরা আওয়ামী লীগের শত্রু নয়। তারা আঁচলের তলে বেড়ে ওঠে।

সরকারি চাকরির বাইরে কর্মনিশ্চয়তা সৃষ্টি করুন। প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পাচ্ছে গড়ে ৩ হাজারের‌ও কম, যা মাত্র ০.১৪%, বাকি থেকে যাচ্ছে ৯৯.৮৬%। যে তরুণ আজ গবেষণা করবে, সমাজ গড়বে সেই তরুণ আজ চাকরির জন্য জীবন দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে দেশের এ অবস্থার জন্য এই তরুণ সমাজ দায়ী নয়। এ দায় আপনাদের। আপনারা স্বাধীনতার বেনিফিসিয়ারি, ওই তরুণ সমাজ নয়। স্বাধীন ভূখণ্ড ছাড়া সে আর কিছু পায়নি। একটা জীবন পেয়েছিল সেটাও বিলিয়ে দিয়ে গেলো!

;

সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া

ছবি: বার্তা২৪.কম

এতো মৃত্যু, এতো রক্ত, এতো ধ্বংস, এতো তাণ্ডবের সম্মিলিত চেহারাটা বড় বীভৎস এবং করুণ। মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দগ্ধ ও রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশবাসীর তাজা স্মৃতি ছুঁয়ে রয়েছে আতঙ্ক, ভীতি ও উদ্বেগ, যা ক্রমশ স্বস্তির দেখা পেলেও একটি প্রশ্ন সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই সংঘাতময় নজিরবিহীন নৈরাজ্যে কার জয় হলো? কার হলো পরাজয়?

সহজে বা এককথায় উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, নৈরাজ্য এক বিকারগ্রস্ত পরিস্থিতির নাম। যুক্তি ও বুদ্ধি কাজ করে না নৈরাজ্যবাদী সংঘাতে। আর সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া। দুষ্টচক্রের মতো বাড়তে থাকে। এক সংঘাত আরেক সংঘাতকে ডেকে আনে। সংঘাতে আচ্ছন্ন করে ফেলে সবকিছু।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের কারণে কোনও কাজ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন আর স্বরূপে স্থির থাকতে পারে না। পরিণত হয় ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিটি ধারাও নিয়মের সীমারেখার ভেতর থাকতে পারে না। চলে যায় নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলাফল সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অগণিত মৃত্যু, সীমাহীন রক্তপাত। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন। ক্ষতির মাত্রা কল্পনার চেয়েও অধিক।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে একটা লাগামছাড়া আক্রোশ সওয়ার হয়। ক্ষোভ ও হিংসা দখল করে পুরো পরিস্থিতি। উন্মত্ততা তেড়ে আসে বন্য পশুর মতো। গণউন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞে। কেন এমন হয়েছিল কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে? হয়তো কখনও জানা যাবে সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা করা হলে। হয়তো এর রাজনৈতিক কার্যকারণও জানা যাবে। কিন্তু মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতির পূরণ সম্ভব হবে না কোনোও দিনও। হয়তো ধ্বংসের পর নির্মাণ হবে। মৃত্যুর পর নবজন্ম হবে। তথাপি সহজে মুছবে না দগদগে ক্ষতির চিহ্ন ও রেশ।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের সংগঠিত রূপ হলো গণউন্মত্ততা। প্রায়ই যে ছেলেধরা বা কথিত চোর সন্দেহে অবলীলাক্রমে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়, তা আসলে এক ধরনের গণউন্মত্ততা, যা সংঘাতময় মনোবৃত্তি ও নৈরাজ্যজনক মানসিকতার ভিন্নধর্মী বহিঃপ্রকাশ। সমাজ ও মানুষ অস্থিরতার কবলে নিপতিত হলে বিস্ফোরণ ঘটে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।

সেজন্যই সমাজে শান্তি, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা জরুরি। আর শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক সমাজের স্বার্থে ও মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গণউন্মত্ততা বড়ই বিপদজনক। এর প্রকৃত কার্যকারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার। নচেৎ বিষফোঁড়া হয়ে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে ফেটে বের হবে এবং সংঘাত ও নৈরাজ্যের ধারাকে পুষ্ট করতে থাকবে অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, যার শুরু থাকলেও শেষ থাকবে না। বরং এর থেকে জন্ম নেবে আরও সংঘাত। আরও নৈরাজ্য। আরও তাণ্ডব ও উন্মত্ততা।

মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের ধ্বংস-চিহ্নিত ও রক্ত-মথিত ঘটনাপ্রবাহে সংঘাত ছিল। নৈরাজ্য ছিল। তাণ্ডব ছিল। গণউন্মত্ততা ছিল। সবই ছিল। শুধু অনুপস্থিত ছিল বিবেক, যুক্তি, মানবিকতা, সহনশীলতা। যার পরিণতি ভোগ করতে হলো পুরো দেশ ও জাতিকে। প্রচুর মূল্য দিয়ে এবং শঙ্কার কৃষ্ণপ্রহর পেরিয়ে মানুষকে ফিরতে হয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।

বিশ্বের দেশে দেশে সংঘাত এক ভয়ঙ্কর বিপদের নাম। রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক বিভেদে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, জাতিগত দ্বন্দ্বে, মতাদর্শিক মতপার্থক্যে বহু দেশ সংঘাতে নিমজ্জিত হয়ে পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংঘাত-কবলিত সমাজ হচ্ছে রক্তাক্ত, মানুষ হচ্ছে বিপন্ন।

ক্ষুদ্র আয়তনে বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংঘাত কতো মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ মধ্য জুলাইয়ের নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ। এই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সংঘাত-মুক্তির পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক। বিভেদ ও বিতর্কের গতিপথ আর যেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সংঘাতকে সংঘাত দিয়ে নয়, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে উত্তীর্ণ করার কৌশল অবলম্বন করাই সুবিবেচনার কাজ। প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে ঠেলে দিয়ে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাবে কাছে টেনেই বরং সঙ্কট সমাধান ও সঙ্কট প্রশমন করা লাভজনক, শান্তিপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদ্ধতি।

উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশকে সামনে এগুতে হচ্ছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। লড়তে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, চাকরি প্রাপ্তির অনিয়ম ও নানা রকমের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই যাত্রাপথ মসৃণ নয়। এতে যদি সংঘাতের দৈত্য এসে হানা দেয় তাহলে কষ্টার্জিত সকল অর্জনই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অগ্রগামী বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকবে।

এমন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে কার লাভ হবে? কে জিতবে? কে হারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের আপামর মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। আসলে সংঘাত, নৈরাজ্য, উন্মত্ততা পরিশেষে কাউকেই লাভবান করতে পারে না। এক অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো সবাইকে এক সমাপ্তিহীন ধ্বংসের গহ্বরে ফেলে দিতে পারে শুধু

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

উদারবাদিতার সীমা

ছবি: বার্তা২৪.কম

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার আগে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনুষ্যত্বের দুর্দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতাটিতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” তাঁর চোখ সেদিন অশ্রুসিক্ত ছিল, জানিয়েছেন তিনি। সেটা ১৯৩১-এর ঘটনা। তার পরে প্রায় এক শ’ বছর কেটে গেছে কিন্তু মনুষ্যত্বের দুর্গতি মোটেই কমেনি। ১৯৩৯ আবার একটি বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরাই ঘটিয়েছে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে; তারপরে তৃতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ পীড়ন লুণ্ঠন অসংখ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। তারা আজ কেবল যে বায়ু ও আলোকে বিপন্ন করছে তা-ই নয়, পানিও দিয়েছে নষ্ট করে, ধরিত্রীকে তপ্ত করেছে দুঃসহ রূপে। খবর বলছে ২০২৩ সালে গ্রীষ্ম ছিল গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ; এবং শঙ্কা নাকি এই রকমের যে চলতি বছরের উষ্ণতা ওই রেকর্ডও ভেঙে ফেলবে।

রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটা ছিল ভগবানের কাছে। এযুগে ইহজাগতিকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রশ্ন নিয়ে মানুষ এখন আর ভগবানের দ্বারস্থ হয় না, জিজ্ঞাসা করে মানুষকেই। এ ক্ষেত্রে মানুষই এখন ভগবানের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। মানুষের নাকি অনেক ক্ষমতা; বিশেষ করে এই জন্য যে তারা ভোট দিতে পারে, ভোট দিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। কিন্তু পছন্দ করবার মতো সক্ষমতা মানুষের আছে কী? গণতন্ত্রের জন্য ‘আদর্শ’ ভূমি আমেরিকা; সেখানে একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে; জনগণ পুনরায় ক্ষমতা পাবে পছন্দের মানুষটিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাবার। কিন্তু তারা কাকে বসাবে? হয় বাইডেনকে নয়তো ট্রাম্পকে। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কতটা? সে তো উনিশ বিশের।

ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তাদের অবস্থান দেখলে তো বোঝা যায় যে উনিশ বিশের নয়, সাড়ে উনিশ ও বিশের বটে। ট্রাম্প বলেছেন তিনি নির্বাচিত না হলে আমেরিকাই থাকবে না; অর্থাৎ যে বর্ণবাদী আমেরিকা একদা কলম্বাসের ইউরোপীয় সহযোগীরা তাদের জবরদখল-করা ভূমিতে কায়েম করেছিল সেটা থাকবে না। ট্রাম্পের আওয়াজটা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের শাসন যদি টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে আমাকে ভোট দাও। কথাটা বাইডেন ঠিক ওই ভাবে বলেন না, কিন্তু তিনিও যে শ্বেতাঙ্গ-শাসনই অক্ষুন্ন রাখতে চান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত যে ভারত, সেখানেও তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, দুটি ভিন্ন দলের কাঁধে ভর দিয়ে, তবে উন্নয়নের ডঙ্কা বাজিয়ে নয়, যেটা আগেরবার বাজিয়ে ছিলেন; এবার সেটা করেননি কারণ উন্নয়ন তেমন ঘটাতে পারেননি, তার চেয়ে সহজ এবং তাঁর ধারণা অধিক কার্যকর পথ হচ্ছে তিনি না এলে মুসলমানরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, দেশের ধনসম্পত্তি সব দখল করে নেবে ভৌতিক এই ভয়টাকে প্রচার করে।

বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মোটামুটি পৃথিবী জুড়েই অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে তো দেখলাম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধেই। স্থানীয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে দলের লোকদের মধ্যেই। নির্বাচনে বিজয়ীরা যা খরচ করেন তার বহুগুণ তাঁরা যে তুলে নেবেন সেটা তাঁরা জানেন আমরাও জানি; স্থানীয় নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই কী ঘটেছে সে সম্পর্কে ঠাকুরগাঁওয়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা ঠিকই জানিয়েছেন : “ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারাদিন দুই-তিনটা ভোট পড়েছে, বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজার” [আজকের পত্রিকা, ১৭ মে]। ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজারের ভেতর একটি মাত্র শূন্যের ব্যবধান বৈকি; ব্যাপারটাও দাঁড়াচ্ছে শূন্য কুম্ভের মতোই। শূন্য কুম্ভের আওয়াজ বেশি, কারণ ভেতরের জিনিস কম।

মোক্ষম সত্যটা অবশ্য প্রকাশ পেয়েছে একটি দৈনিকের শিরোনামে : “যেখানে এক আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি”। সংবাদে-উল্লেখিত মিলের জায়গাগুলো হলো উপজেলা নির্বাচনে (ক) দলীয় সিদ্ধান্ত মানছে না দুই দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারা, (খ) নির্দেশনা অমান্য করার শাস্তি হয়নি সরকারি দলের কারও; এবং (গ) বিএনপি বহিষ্কারের পথে হাঁটলেও পাল্টা দায় দিচ্ছেন বহিষ্কৃত নেতারা”। মূল ঐক্যটা যেখানে তার কথা অবশ্য এই সংবাদ-তথ্যে নেই; সেটা হলো পুঁজিবাদী উন্নয়নে দীক্ষা। এক্ষেত্রে উভয় দলই সহযাত্রী, তাঁরা সেই উন্নয়নই সমর্থন করে থাকে যে-উন্নয়ন বৈষম্য বৃদ্ধি করে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়, নিচের দিকে ঠেলে দেয় দেশপ্রেমকে। উন্নয়নের ওই নীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’তে কোনো ফারাক নেই, যেমনটা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায়, যেখানে দুইদলের নেতারা পাবলিকের জমি দখল করে একত্রযোগে একটি দোকান গড়েছেন।

উদারনীতিকেরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন বুনো হাঁস নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪০ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কী ভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণা ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তাঁর বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসাতে; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু দশ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহ পরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই পুত্র হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-পিতা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারতো। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে।

জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল। এই পুত্র বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীর ভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইলো অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়ালো এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিল।, স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করলো।

১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারলো না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসেন না, সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মা’র সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসলো। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কার-চেষ্টার সমস্তটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরূপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট পিতা ওয়ারল টাকার জোরে যে-পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী পুত্র তাদেরকেই দিল ছিন্নভিন্ন করে।

বিখ্যাত এই নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর এই বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট পিতার আদর্শবাদী পুত্র গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনলো তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হবার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারতো সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে-পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

;

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *