সারাদেশ

ধনী-গরিবের বিভেদ ভেঙে দেয় যে ইফতার আয়োজন

ডেস্ক রিপোর্ট: আসরের নামাজ শেষ হতেই শুরু একদল স্বেচ্ছাসেবকের কর্ম তৎপরতা। একের পর এক আসছেন ভিখারি, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। নিজে নিজেই বসে পড়ছে সবাই। গোল হয়ে আবার কেউ কেউ লম্বা সারি করে। সময় যতো এগোচ্ছে বাড়ছে মানুষের সংখ্যাও। এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে দিচ্ছেন প্লেট-থালা আর ছোট মগে শরবত ও পানি। সবাই সমবেত হয়েছেন সারাদিন রোজা রেখে একসঙ্গে ইফতার করতে। এক ইফতারই যেন ভেঙে দেয় ধনী-গরিব বিভেদের দেয়াল।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) পবিত্র রমজানের প্রথম দিন নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের দেখা গেল এমন চিত্র। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেছেন। যেখানে পুরো রমজান মাসজুড়ে চলে হাজার হাজার রোজাদারের ইফতারের আয়োজন। রোজা বাড়ার সাথে সাথে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে পাঁচ হাজারের ঊর্ধ্বে। প্রতিবারই এমনটি দেখা যায়।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোছাইন তাহের জবেরী আল-মাদানীর প্রচেষ্টায় ১৯৯৬ সালে শুরু হয় এই গণ ইফতার কার্যক্রম। একজন প্রধান বাবুর্চির নেতৃত্বে মোট ১০ জন বাবুর্চির এসব ইফতার রান্না বা তৈরি করে থাকেন। একই সঙ্গে ৩০ জন নিজস্ব কর্মকর্তা এ কাজে সহযোহিতা করনে।

ইফতারের অংশ নেয়া বিভিন্ন শ্রেণি পেশার কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। এদের মধ্যে একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. মহিউদ্দিন মাসুদ। জরুরি কাজের আন্দরকিল্লা এসেছেন তিনি। বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অনেক দূর থেকে একটা কাজে এসেছিলাম। এর মধ্যে ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় এখানে ইফতার করলাম। প্রথম রোজায় এত মানুষের সঙ্গে বসে ইফতার করতে পেরে অনেক ভাল লাগছে, আলহামদুলিল্লাহ্! আমি গত বছরও এখানে ইফতার করেছি।’

প্রথম রোজায় এ মসজিদের ইফতার করতে দেওয়ানহাট থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন। তিনি জানান, ‘এই মসজিদের নামাজ পড়লে একটি আলাদা প্রশান্তি অনুভব হয়। তাছাড়া সব শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে এক কাতারে বসে ইফতার করার আনন্দই অন্যরকম।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েল বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তাসিফ খান। প্রথম রোজার বাসায় ইফতার করার জন্য মা জোর দিলেও তা না শুনে গণ ইফতারে অংশে নিতে নগরীর খুলশী জালালাবাদ থেকে ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে  ছুটে আসেন আন্দরকিল্লা মসজিদে।

তাসিফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আজকের রোজার প্রথম ইফতার সর্বস্তরের রোজাদারদের সঙ্গে করার ইচ্ছে থেকে আসা। যদিও আমার মা প্রথম রোজার ইফতার বাসায় করার জন্য অনুরোধ করেছে অনেক। তারপরও ছোট ভাইকেসহ সঙ্গে নিয়ে চলে আসছি। এখানের ইফতার করতে অনেক ভালো লাগে। আমি প্রতিবছর এখানে ইফতার করি। ইফতার ও নামাজ পড়ে শান্তি লাগে এ মসজিদে।’

শুধু সাধারণ মানুষ নয়। এই আয়োজনে অংশ নেয় শত শত ভিখারিও। এমন একজন ষাটোর্ধ্ব মো. সেলিম উদ্দিন। প্রতিবছর রমজানের তিনি এই মসজিদের ইফতার করতেন। এবারও প্রথম রোজায় লাঠির ওপর ভর দিয়ে এসেছেন ইফতার করতে।

সেলিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রতিবছর রোজায় এখানের ইফতার করি। আজকেও এসেছি। আমাদের তো টাকা পয়সা নাই যে কিনে খাব। তারা এত সুন্দর করে ইফতারি দেয়, এতেই অনেক খুশি লাগে। আমরা ধনী গরিব সবার পাশে বসে ইফতার করতে পারি।’

কথা হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদের সাথে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মসজিদের খতিব আওলাদে রসূল তাহের হোসেন আল-মাদানি ১৯৯৬ সালে তিনি এই মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পান। সেই থেকেই মক্কা-মদিনার আদলে আন্দরকিল্লা শাহী জামের মসজিদে ইফতারের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি মনস্থির করেছেন। এরপর থেকে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রথম পাঁচ বছর ছোট পরিসরে এই আয়োজন করা হয়। পরে ২০০১ সাল থেকে বড় পরিসরে নিজস্ব ১০ জন বাবুর্চি ও ৩০ জন কর্মচারী দ্বারা ৯টি আইটেমে এই ইফতারে আয়োজন করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে জন্য নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক অনেকেই মজলিসের সঙ্গে পরামর্শ করে ইফতারের জন্য অনুদান দেয়। ইফতারের পণ্যগুলো আমাদের নিজস্ব স্টোররুমের সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। সেখান থেকে রান্না করা হয়। এবং আসরের পর থেকে মুসল্লিরা আসতে শুরু করেন। প্রথমদিনে আমরা আকে ২ হাজার লোকের ইফতারের প্রস্তুতি নিয়েছি। পর্যাক্রমে সেটি সামনে বেড়ে ৫-৭হাজার মানুষের ইফতারে ব্যবস্থা করা হবে। এখানে শুরু হতদরিদ্র মানুষ না, ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও এখানের ইফতারে সামিল হন।’

মসজিদে খবিত ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসাই তাহের জাবেরী আল-মাদানী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মাহে রমজান শুরু হয়েছে। এমাসের অনেক সম্মান ও গুরুত্ব রয়েছে। আমরা রোজাদারকে সম্মানিত করার জন্য ১৯৯৬ থেকে এই আয়োজন করছি। বর্তমানের ২০২৪ পর্যন্ত চলমান রয়েছে। আল্লাহর বান্দারা গোপনে অনুদান দিচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করি প্রত্যেক রোজাদারের মুখে তার ইফতারি পৌঁছে দেওয়ার। দেশের অন্য কোতারও এরকম ইফতাররে আয়োজন হয় কিনা আমার জানা নাই। তবে শাহী মসজিদের তরফ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ মুসল্লিদের খেদমতের জন্য আমরা ইফতারির ব্যবস্থা করি। সেই ধারা থেকে এখনো চলতেছে আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ যতদিন এই ব্যবস্থা রাখেন শাহী মসজিদের তা চলবে।’

প্রসঙ্গত, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ চট্টগ্রামসহ তার আশপাশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার মসজিদে রূপ নেয়। বিশেষ করে জুমআর নামাজ পড়তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা উপস্থিত হন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান।

চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি। এ মসজিদের মূল ভবনের প্রবেশপথে কালো পাথরের খোদাই করে সাদা অক্ষরে ফার্সি ভাষায় যা লেখা রয়েছে, তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘হে জ্ঞানী! তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি। এখানেই খোদাই করা রয়েছে তার প্রতিষ্ঠার নামও।

নিজস্ব ছবি: ইফতার নিয়ে অপেক্ষা করছেন মুসল্লিরা, থরে থরে প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ইফতার, অস্থায়ী মঞ্চে চলছে রমজানের তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *