সারাদেশ

সোমালি জলদস্যুদের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত আলোচিত পাঁচ সিনেমা

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট হইয়াও কাহারও মৃত্যু কামনা করা উচিত নয়’ শৈশবে কোন এক সময় শোনা কবিগুরুর এই অমিয় বাণী হৃদয়ে গেঁথে আছে। কাব্যগ্রন্থ ‘কড়ি ও কোমল’ এ ‘প্রাণ’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন জীবনের জয়গান, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।’

জীবনের জয়গান গাওয়া এই কালজয়ী কবির দর্শনকে যিনি জীবনের আদর্শ করে তুললেন, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদের স্বেচ্ছা মৃত্যুকে আলিঙ্গনের দুঃখজনক খবরটি জানার পর থেকে রাতভর মনোজগতে তীব্র আলোড়ন হয়েছে। কেন তিনি এমনটা করলেন? সঙ্গীত ও সংস্কৃতিজগতে যিনি বহু মানুষের আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন কেনইবা তাকে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো? প্রতিনিয়ত কত মানুষই তো আত্মহননের পথ বেছে নেয়, আমরা তাচ্ছিল্য বা খানিকটা আক্ষেপ করে পরক্ষণেই ভুলে যাই।

কিন্তু সাদি মহম্মদের এই সিদ্ধান্ত কেউই মেনে নিতে পারছেন না। পারছেন না, কারণ তিনি জীবনকে শত উপলব্ধির ভেতর দিয়ে আত্মপ্রচেষ্টা ও আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে বিরাট এক উচ্চতায় আসীন করেছিলেন। বাঙালির অখণ্ড সাংস্কৃতিক যে পরিমণ্ডল, সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্য আরাধ্য বিষয়। রবীন্দ্র ভাব-দর্শন জনমানসে বিপুল প্লাবন যারা সৃষ্টি করেছেন, সাদি মহম্মদ নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক নাম। তাঁর গায়কী, ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য ও নিরাভরণ-নিরাবারণ যাপিত জীবন বহুজনের মাঝে তাকে অনন্য করে তুলেছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের উজ্জ্বল আভা বিকিরণে যেই নাম সমস্বরে উচ্চারিত হয়ে এসেছে বহু যুগ ধরে সেই হেমন্ত মুখ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে কিংবা বাংলাদেশের হেমন্ত হিসেবেও সাদি মহম্মদের ঈর্ষণীয় যে অবস্থান তা তাকে অপ্রতিদ্বন্ধী করে তুলে। প্রচারের আলো থেকে দূরে নিভৃতে বাস ছিল তাঁর। গণমাধ্যমে যতখানি এসেছেন, তাঁর পরিমিতিবোধে আমরা নত হয়েছি। যে সাদি মহম্মদকে আমরা কয়েক দশক দেখে-শুনে এসেছি তিনি এক বিরাট উচ্চতার মানুষ আমাদের কাছে। পার্থিব জীবনকে এভাবে ঠেলে দিয়ে অনন্তের পথে তাঁর পাড়ি জমানো আমাদের মনে গভীর বেদনার সঙ্গে বিস্ময়েরও জন্ম দিয়েছে। আমরা কেউই মানতে পারছি না, এই অপমৃত্যু।

গণমাধ্যমগুলো যে খবর দিচ্ছেন তাতে অনেক পরিচিতজনদের মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ আমরা জানতে পারছি। তাদের অনেকেই বলেছেন, সাদি মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ (৯৬) প্রয়াণের পর তিনি ক্রমেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সেইসঙ্গে যথাযোগ্য স্বীকৃতি না পাওয়ার চাপা ক্ষোভও ছিল তাঁর মধ্যে। এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যাপিত জীবনে যে আদর্শকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন তাঁর এমন মৃত্যুকে বরণ করার কথা তো নয়!

আগাগোড়া সংস্কৃতিমনস্ক এক অগ্রজকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা বেজে ৫ মিনিটের দিকে আমরা পৌছাই মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে শিল্প সাদি মহম্মদের পারিবারিক বাসভবনের সামনে। মূল সড়কের পাশের একটি শাখা সড়কে অনেকগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা, তাতে বসে আছেন আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অনেক পরিচিত মুখ। সঙ্গী অগ্রজের জায়গাটা আগে থেকেই চেনা। কেননা মাস ছয়েক পূর্বে তিনি এসেছিলেন এখানেই, শিল্পী সাদি মহম্মদের সান্নিধ্যে। তাকে নিয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে বড় অনুষ্ঠানও করিয়েছেন। এদিন মোহাম্মদপুর যাওয়ার পুরো পথে ছিল সেই স্মৃতিচারণ।

পূর্বেই যোগাযোগ হয়েছিল পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে, সেখানে পৌছার পর তিনি আমাদের নিয়ে চললেন সাদি মহম্মদের নিথর দেহের পাশে। একটি ফ্রিজিং এম্বুলেন্সে শায়িত। মোহনীয় মুখচ্ছবিটা কেবল যেন নিকষ কালো দেখাচ্ছিল। চোখ দুটি খানিকটা উন্মীলিত। একগুচ্ছ সাদা তাজা ফুল দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় খানিক্ষণ দাড়িয়েছিলাম দরাজকণ্ঠের সেই শিল্পীর নিথর দেহের পাশে। যিনি গতকাল এই সময়েও এই চরাচরে বিচরণ করছিলেন।

২ মিনিট পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো শিল্পীর পারিবারিক বাসভবনের নীচতলার একটি কক্ষে। যেখানে তাঁর প্রিয়স্বজনরা আহাজারি করছেন। ভারী হয়ে উঠা পরিবেশে প্রবেশ করে আমরাও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। শিল্পীর ছোটভাই বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ আমাদের পেয়েও হাউমাউ করে শিশুর মতোন কেঁদে ফেললেন। কয়েক মাস পূর্বের স্মৃতি হাতরে বলছিলেন শিলাইদহ যাওয়ার স্মৃতি। আমরা স্তব্ধ হয়ে স্বজনদের বিলাপে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম, নীরব অভিমানে শিল্পী সাদি মহম্মদের এভাবে চলে যাওয়ার হেতু। শিবলী বলে যাচ্ছেন আর্তস্বরে, ‘ভাইকে তাঁর যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি’ ‘ভীষণ অভিমানী ছিলেন, আমি কোন সম্মান পেলে লুকিয়ে রাখতাম যদি দেখে তাঁর কষ্ট হয়!’

সম্পর্কে তাঁর বোন হবেন এমন একজন নারী চিৎকার করে বলছিলেন, আজ কেন তাকে কিংবদন্তি শিল্পী বলা হচ্ছে? কেন তাকে জাতীয় সম্মান দেওয়া হয়নি? মানবপাচারে জড়িত থাকা ব্যক্তিও জাতীয় পদক পেয়ে যান, ফরমায়েশি গান লিখে। সাদি মহম্মদ কি কোন বিচারেই যোগ্য ছিলেন না? ইত্যাদি বিস্তর অভিযোগ ধ্বনিত হলো বোনের কান্নাজড়িত কণ্ঠে। তিনি বলছিলেন, এখন যেন কোন মরণোত্তর সম্মান তাকে দেওয়া না হয়।

এক বাস্তব উপলব্ধি নিয়ে খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে এলাম আমরা। বুঝতে বাকী রইল না, কতটা অভিমানে একজন এই মাপের প্রতিভাধর শিল্পীকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়! নিজের কাছেও বড় প্রশ্নবোধক হয়ে ধা দিল, যেই শিল্পীর গান কয়েক দশক ধরে বাঙালির অন্তরে ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছে, পহেলা বৈশাখে কিংবা নানা উৎসবে যাঁর কণ্ঠের মোহময়তায় আমরা উদযাপনে মেতেছি; তাকে কেন জাতীয় সম্মানে ভূষিত করতে পারিনি আমরা? এই ব্যর্থতার দায় বয়ে বেড়ানো সমাজ-রাষ্ট্রকে কি সজোরে চপোটাঘাত করতেই কি এই নীরব প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিল্পী? কিন্তু আমরা কি সেই রকম মূল্যবোধ সম্পন্ন হতে পেরেছি আদৌ? আর হতেই যদি পারতাম তাহলে কি এমন অভিমানে সাদি মহম্মদকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো? এই জিজ্ঞাসা আমাদের বহুদিন ঘুমাতে দিবে না, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু তাতেও কি রাষ্ট্রও জাগবে?

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *