সারাদেশ

বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা: গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়া না অন্য কিছু?

ডেস্ক রিপোর্ট: বিজয় এক্সপ্রেসের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা আবারও দেশজুড়ে রেলের জরাজীর্ণ অবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোববার (১৭ মার্চ) কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় ট্রেনের প্রায় ৩০ জন যাত্রী আহত হন।

হাসানপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মঙ্গু মারমা তাৎক্ষণিকভাবে জানান, গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে দুর্ঘটনার পরপরই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান জানান, গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন না তিনি।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, যখন দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল, আমি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম এবং দেখলাম কুমিল্লায় তাপ ছিল প্রায় ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমার মনে হয় না রেললাইন বেঁকে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

তিনি বলেন, পরিবেশের তাপ যদি ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে রেললাইনের তাপ সর্বোচ্চ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হতে পারে কারণ রেললাইন তাপ শোষণ করে। যদি এই পরিমাণ তাপ নিয়ে রেললাইন বেঁকে যায়, তাহলে এটা উদ্বেগের বিষয়। কারণ, গ্রীষ্ম এখনও শুরু হয়নি বলা যায় এবং আগামী মাসগুলোতে আরও গরম বাড়বে। সেক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ট্রেন বন্ধ রাখতে হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হতে পারে হুক ভেঙে যাওয়া, যেটি দিয়ে বাকি বগিগুলো লোকোমোটিভের সঙ্গে লেগে থাকে। কারণ তাপ থেকে রেললাইন বাঁকানো থাকলে ট্রেনটির ইঞ্জিনও লাইনচ্যুত হওয়ার কথা। ট্রেনটির ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়নি। আশপাশের লোকজন বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছেন বলে জানা গেছে। হয়তো ইঞ্জিনের সঙ্গে বগিগুলোর সংঘর্ষ থেকে শব্দটি হয়েছে।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০০ মিটার রেললাইন উপড়ে গেছে । ফলে রেললাইন বেঁকে গেছে কি না তা এখন বলা খুব কঠিন।

নড়বড়ে লাইন এবং লাইনচ্যুতি

তিনি বলেন, রেলের যত দুর্ঘটনা ঘটে তার ৭০ শতাংশই লাইনচ্যুতির মাধ্যমে। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বই অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দুর্ঘটনা কমে এসেছে। ২০০৮-২০০৯ সালে, সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল ৭টি, লাইনচ্যুত হয়েছে ৪০৮টি এবং ট্রেনগুলো ৩৪ বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১৯-২০ সালে, সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল একটি। লাইনচ্যুতির সংখ্যা ছিল ৭২টি এবং বাধাগ্রস্ত ট্রেনগুলো দাঁড়িয়েছে ৭টিতে। মোট ৮০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে ওই বছরে।

তাছাড়া, বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে, সারাদেশে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার পুরানো রেললাইনের ৬৩ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

হাদিউজ্জামান বলেন, রেলওয়ে নতুন প্রকল্প গ্রহণে খুবই আগ্রহী কিন্তু তারা পুরানোগুলোকে অবহেলা করছে বলে মনে হচ্ছে, যার রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের উষ্ণ অঞ্চলের রেললাইনগুলো গরম পরিবেশে বাকলিং (বেঁকে যেতে ) দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের রেললাইনেও বাকলিং দেখা যায়। পার্শবর্তী ভারতে রেললাইনে বাকলিংয়ের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব দেশ সমস্যা কমানোর জন্য নানা ব্যবস্থা নেয়।

রেললাইনের তাপ কমানোর জন্য, রেললাইনটি রঙ দিয়ে সাদা করা হয়। রেললাইনে সাদা রঙ দিলে তাপ অনেক কমে যায়। ভারতে, কখনও কখনও তারা উত্তাপ কমাতে রেল লাইনের ওপর ভেজা কচুরিপানাও ব্যবহার করে।

হাদিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েকে তাপ-প্রবণ এলাকাগুলো খুঁজে বের করে নজরদারি করতে হবে। রেললাইনের সাথে তাপ সেন্সর স্থাপন করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশ তাপ সেন্সর ব্যবহার করে, যা রেললাইনের তাপমাত্রা সম্পর্কে কর্মকর্তাদের সতর্ক করবে। এরপর রেললাইনের তাপমাত্রা কমাতে রেলওয়ের কর্মকর্তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, পুরনো রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হবে, অন্যথায় আগামী বছরগুলোতে লাইনচ্যুতির সংখ্যা বাড়বে। তিনি মনে করেন, পুরনো রেললাইনগুলো ঠিক করতে রেলওয়ের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা লাগতে পারে। রেলওয়েতে যেসব প্রকল্প আছে তার তুলনায় এটি খুব একটা বেশি টাকা না।

রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের কথার সঙ্গে একমত। তারা মনে করেন, বিজয় এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা এটা রেললাইনের তাপমাত্রা ও বাকলিং নয়। কারণ অন্য কিছু।

এখন গ্রীষ্মের এমন তাপ তৈরি হয়নি যে রেললাইন বাঁকা হতে পারে, আমি মনে করি অন্য কিছু দুর্ঘটনার কারণ, বলেছেন রেলের একজন কর্মচারী যিনি প্রায়শই দুর্ঘটনার পরে উদ্ধারকারী ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেন।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *