সারাদেশ

বৃষ্টির পরও ঢাকার বাতাস নিয়ে দুঃসংবাদ

ডেস্ক রিপোর্ট: আরিফ-শিমু দম্পতি; রাজধানীর লালবাগ শহীদনগর এলাকার বাসিন্দা। এক মাস বয়সী ছেলে আব্রাহামের ঠান্ডাজনিত সমস্য নিয়ে জাতীয় শিশু হাসপাতালে আসেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের দেখা পান তারা। নিউমোনিয়া হয়েছে জানালেও হাসপাতালের ‘সিট খালি’ না থাকায় আব্রাহামকে ভর্তি রাখতে পারেননি কর্তব্যরত চিকিৎসক। অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

নিরুপায় হয়ে যখন ভাবছিলেন, অন্য হাসপাতালে যাবেন। ঠিক তখনই ত্রাতা হয়ে আসেন এক আনসার সদস্য! হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা সিট না দিতে পারলেও আনসার সদস্য জানালেন ‘সিট দিতে’ পারবেন। বিনিময়ে শিশুটির বাবাকে গুণতে হবে এক হাজার টাকা! এই টাকা পেলে তিনি সিটের ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি।

এমন অবস্থায় সিট নিয়ে সিন্ডিকেট বাণিজ্য হচ্ছে বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করেন আরিফ। আর এতেই কয়েকজন আনসার সদস্য আরিফ ও তার স্ত্রীকে মারধর করেন। আনসার সদস্যদের হামলায় কোলে থাকা এক মাস বয়সী শিশুটিও মাটিতে পড়ে যায়। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারটি থানায় অভিযোগ করলে গ্রেফতার করা হয় আব্দুল কাশেম ও শহিদুল ইসলাম নামের দুই আনসার সদস্যকে। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।

এমন ঘটনার শিকার শুধু আরিফ-শিমু দম্পতিই নয়। শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে আনসার সদস্যদের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় প্রায়ই ঘটে। সম্প্রতি দুই আনসার সদস্য রোগীর স্বজনদের ওপর হামলার ঘটনার পরে শিশু হাসপাতালে অনুসন্ধান চালায় বার্তা২৪.কম। অনুসন্ধানে উঠে আসে আনসার সদস্যদের হামলার কৌশল ও রোগী ভাগিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠাতে পারলে কমিশনের হিসাব। এমন কি আনসার সদস্যদের অনিয়ম ও দালালদের সঙ্গে

হাত মেলানোর ঘটনায় বিব্রত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল থেকে আনসার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও তারা ভাবছেন।

বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) দিনভর শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীর স্বজনদের মারধর ও দুই আনসার সদস্য গ্রেফতার হওয়ায় অনেকটা আতঙ্কিত দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। অনেকটা চুপচাপ দায়িত্ব পালন করছেন। রোগীর স্বজনদের অন্য হাসপাতালে পাঠানো বা হাসপাতালে সিট দেওয়ার বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে অনেকটা সতর্ক। কেউ কেউ কোনো কথাই বলতে চান না। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ও দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে আনসারদের সখ্যতার বিষয়টা যাতে প্রকাশ না পেয়ে যায় তাই তারা ঘটনার পর থেকেই চুপচাপ কাজ সারছেন।

শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আনসার সদস্যদের অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই নির্যাতন নেমে আসে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষের ওপর। এমন কি দায়িত্ব প্রাপ্ত আনসার সদস্যদের কাঁধে থাকা অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টার অপবাদ দিয়ে সাধারণ মানুষকে মারধরের মতো বহু ঘটনা ঘটেছে শিশু হাসপাতালে। ফলে আনসারদের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশও শুনতে চায় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে আনসারদের রোগী প্রতি আয়ের হিসাব দিয়েছেন একটি সূত্র। সূত্রটি জানিয়েছে, রাজধানীর শ্যামলী, আগারগাঁওসহ আশাপাশের এলাকায় কয়েকটি হাসপাতালে নিয়মিত রোগী পাঠান আনসার সদস্যরা। হাসপাতালগুলো হলো- শ্যামলী এলাকার আমার প্রাণের বাংলাদেশ, লালমাটিয়ার মাদার কেয়ার হাসপাতাল, আগারগাঁও ৬০ ফিট এলাকার মুনিরা হাসপাতাল, ধানমন্ডি ২৭ এর ৭১ হাসপাতাল ও সাত মসজিদ রোডের রেনেসা হাসপাতাল। দিনের আলোয় আনসারদের কর্মতৎপরতা স্বাভাবিক মনে হলেও রাত হলেই তারা আসল রূপে ফেরেনে। হাসপাতালগুলো থেকে রোগী প্রতি কমিশনের লোভে রাতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাতে ব্যস্ত থাকেন আনসার সদস্যরা। রোগী বেসরকারি হাসপাতাগেলেই ১০ হাজার টাকা পেয়ে যান আনসার সদস্যরা। এই টাকার চারটি ভাগ হয়। ১০ হাজার টাকার ৫০ ভাগ অর্থাৎ পাঁচ হাজার টাকা পান আনসারদের প্লাটুন কমান্ডার বা পিসি। রোগী প্রতি দেড় হাজার টাকা যায় জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয়, এক হাজার টাকা জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার। বাকি ২৫০০ টাকা যায় রোগী ভাগাতে সহায়তা করা আনসার সদস্যের। এতো গেলো একজন আনসার সদস্যের আয়ের হিসাব।

তবে সপ্তাহে আনসার সদস্যদের বড় একটি ব্যয়ও রয়েছে। যার পুরোটাই যায় আনসারদের প্লাটুন কমান্ডারের পকেটে। শিশু হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে ডিউটি পেতে হলে সাপ্তাহিক হিসেবে ডিউটি কিনে নিতে হয় তাদের। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামি ডিউটি শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে। জরুরি বিভাগের ডিউটি পেতে হলে প্রত্যেক আনসার সদস্যকে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ডিউটি কিনে নিতে হয়। ওয়ার্ডে সপ্তাহে ডিউটি কিনতে হলে গুনতে হয় ৩ হাজার টাকা ও হাসপাতালের পার্কিংয়ের ডিউটি পেতে হলে কমান্ডারকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। মূলত সপ্তাহিক ডিউটি কোর টাকা তুলতেই মরিয়া হয়ে ওঠেন আনসার সদস্যরা। ফলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করতেও পিছপা হন না তারা।

যদিও টাকা দিয়ে আনসার সদস্যদের ডিউটি পাওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন শিশু হাসপাতালের দায়িত্বরত আনসারের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) হালিম শেখ। তিনি বলেন, আনসারের ডিউটি বা নিয়োগ পেতে কোনো টাকা লাগে না। আমার কোনো টাকা লাগে নাই। অন্যদের লাগে কি না জানা নেই। আমরা বাহিনী থেকে বেতন পাই। তাই টাকা দিয়ে ডিউটি পাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।

রোগীর স্বজনদের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনসার সদস্যরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে। হাসাতালের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করে। সেদিনের ঘটনা একটা দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।

এ দিকে আনসার সদস্যদের টাকা দিয়ে ডিউটি নেওয়া ও রোগীর স্বজনদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়িদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে আনসারের পশ্চিম জোনের কমান্ডার আম্মার হোসাইন বলেন, রোগীর স্বজনদের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। কমিটিতে দুইজন থানা অফিসার ও একজন টিআইকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। আজই তাদের সময় শেষ হবে।

কি কারণে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের ওপর এমন হামলার ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই আমরা বুঝতে পারব কি কারণে এই ঘটনা ঘটছে। আমরা ভিডিও ফুটেজও দেখেছি। তবে ফুটেজ দেখে আমার মনে হয়েছে আনসার সদস্যদের যে দায়িত্ব ছিলো সেটি তারা সঠিকভাবে পালন করেছে।

বিভিন্ন অনিয়ম ও দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে আনসার সদস্যদের নাম জড়িত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যখনই অভিযোগ পাই। তখনই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। আমরা কোনো ঘটনায় ছাড় দেওয়া হয় না। তবে আপনি যতটা ঢালাওভাবে বলছেন অতটা না। এটা যদিও সঠিক হতো তাহলে আনসার সদস্যরা বছরের পর বছর এভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতো না। আনসারের সেবা যদি মানসম্মত না হতো তাহলে টাকা দিয়ে এই সকল প্রতিষ্ঠান আনসারদের সেবা নিতো না। তবে যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

আনসার সদস্যদকে সপ্তাহে টাকা দিয়ে ডিউটি কিনে নিতে হয়। এই বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টা আমিই আপনার কাছ থেকে জানলাম। এটা আমাদের অফিসিয়াল কোনো নির্দেশনা বা সম্পৃক্ততা নয়। এটা অনৈতিক ও বিধি বিরুদ্ধ কাজ। এই বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানাবো। তাদের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতে বলবো। যদি এমন কিছু থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ দিকে আনসারদের সেবায় অতিষ্ঠ শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার জাহাঙ্গীর আলম। আনসার প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার বিষয়ে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আনসারদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এর আগেও এক ঘটনায় দুইজন গ্রেফতার হয়েছে। আমরা বোর্ড মিটিংয়ে এসব আলোচনা করেছি। অপরাধের পরিধি তাদের বাড়ছে। আসলে তাদের (আনসার) কোন চরিত্র নেই। তারা এমন অপরাধ করছে, যা সিকিউররিটি গার্ডদের থেকেও নিচের কাজ করছে। আমরা আনসারের বিপরীতে ভাবছি। সম্ভব হলে আনসারের সেবাটি অন্য ভাবে ব্যবস্থা করার আহ্ববান করব হাসপাতালের বোর্ডে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *