আন্তর্জাতিক

আমাদের মৌটুসি পাখিরা

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রজাপতি বাদে পৃথিবীতে কোনো উড়ন্ত সৌন্দর্য থাকলে তা হলো পাখি। তবে পাখির রাজ্যে কোনটি সুন্দরতম তা বলা কঠিন। কারণ, একেকটি পাখি একেক দিকে সুন্দর। এদেশের কমবেশি ৭২৩ প্রজাতির পাখির মেলায় সুন্দর পাখির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে, অনেকের মতে মধুচুষকি (Nectariniidae) গোত্র বা পরিবারের পাখিরাই সুন্দরতম, বিশেষ করে মৌটুসি পাখিরা (Sunbird)। কারণ, ওদের সৌন্দর্য সবখানেই ছড়িয়ে আছে-কী গায়ের রঙে, কী ওড়ার ঢঙে, কী গান গাওয়ায়, কী বাসা তৈরিতে? আবার মৌটুসিদের মধ্যে পুরুষ নীলটুনিকে (Purple Sunbird) এদেশের সুন্দরতম পাখি হিসেবে গণ্য করা হয়। 

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখির গোষ্ঠি হামিংবার্ডের (Hummingbird) মতো মৌটুসিরাও বাতাসে স্থির থেকে উড়তে পারে। এরা প্রজাপতি, ভ্রমর ও মৌমাছিদের মতো ফুলে ফুলে নেচে নেচে মধু পান করে বেড়ায়। অত্যন্ত চঞ্চল পাখি এরা, বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এগাছ থেকে ওগাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে বেড়ায়। পুরুষ পাখি বা টোনা বেশ আমুদে। ফুলের নির্যাস বা মধু পানের জন্য মৌটুসিদের রয়েছে লম্বা ও নিচের দিকে বাঁকানো ঠোঁট বা চঞ্চু, যা ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে খাঁজকাটা ও রবারের ডগারের মতো জিহ্বাটি দিয়ে মধু পান করে। নির্যাসের অভাবে ছোট ছোট পোকামাকড়ও খেতে পারে। ফুলের বোঁটার ওপর বসে বাদুড়ের মতো ঝুলে পড়ে যেভাবে ফুলের রস চুষে তা দেখতে বেশ লাগে!

ঢাকার রমনা পার্কে হামিংবার্ডের মতো শূন্যে স্থির হয়ে উড়ছে নীলটোনা। ছবি- লেখক

মৌটুসিদের পালক অত্যন্ত বাহারি রঙের। তবে, এই বাহারি রং শুধু পুরুষ বা টোনাদের মধ্যেই দেখা যায় এবং তা শুধু প্রজননকালে সীমাবদ্ধ। বাহারি পালকগুলোর উপর সূর্যের আলো পড়লে চকচক করে উঠে, তখন সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে যায়!

মৌটুসিরা পুরনো বিশ্ব অর্থাৎ আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার পাখি। বিশ্বে সর্বমোট ১৪৬টি প্রজাতির মৌটুসি দেখা যায়। এদের মধ্যে এদেশে রয়েছে ৯টি, যার ৫টি আবাসিক ও ৪টি পরিযায়ী। এদেশের ৯ প্রজাতির মৌটুসি পাখির মধ্যে আমি এ পর্যন্ত ৬টি প্রজাতির দেখা পেয়েছি। বাকি ৩টি অতি বিরল, সম্প্রতি কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। এখানে এই ৬ প্রজাতির মৌটুসি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচরা করা হয়েছে।

১. নীলটুনি (Purple Sunbird): দুর্গাটুনটুনি বা বেগুনটুনি নামেও পরিচিত। এটি এদেশের সুন্দরতম ও বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। যদিও সেই ছোটকাল থেকেই পাখিটিকে দেখছি, কিন্তু ওর প্রথম ছবিটি তুলি ১৯৯৬ সালে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে। ঢাকার আমার বাসার কাঁঠাল গাছে বেশ ক’বার পাখিটি বাসা করেছিল। নীলটুনি মানুষের কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করে। শহর-বন্দর-গ্রাম-বন-জঙ্গল সবখানেই দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Cinnyris asiaticus (সিন্নিরিস এশিয়াটিকাস)।

নীলটুনির দেহের দৈর্ঘ্য অর্থাৎ চঞ্চুর আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, যার মধ্যে চঞ্চুটিই ৪ সেন্টিমিটার। পাখিটির রঙের কি বাহার! দূর থেকে নীলটোনাকে একদম কালো দেখায়। কিন্তু কাছে এলে বোঝা যায় এর গাঢ় নীল রঙ, রোদ লাগলে যা উজ্জ্বল ধাতব বেগুনি-নীল দেখায়। মাথা ও পিঠ ধাতব বেগুনি; বুক বেগুনি-কালো। বুক ও পেটের মাঝখানে পিঙ্গল ও লালচে বলয় থাকে। কালো যে কতটা সুন্দর হতে পারে তা নীলটোনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে এই রূপ শুধু বাসা বাঁধা ও ডিম পাড়ার মৌসুমেই। ছানারা বাসা ছেড়ে উড়ে যাবার পর থেকে এই নীলচে-বেগুনি ও কালো রঙ ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হতে হতে একসময় প্রায় মিলিয়ে যায়, শুধু বুকে একটা কালো চওড়া টান ও ডানার উপরিভাগে কালচে রঙটা থাকে। কিশোর নীলটুনিও দেখতে একই রকম। টোনা এত সুন্দর হলেও স্ত্রী বা টুনি ততটা সুন্দর নয়। টুনির পিঠ হলুদাভ-বাদামি। দেহের নিচের অংশ হালকা-হলুদাভ। লেজ ধূসর কালো।

লেখকের বাসা ঢাকার জিগাতলায় কাঠাল গাছে নীলটোনা। ছবি- লেখক

২. সিঁদুরে মৌটুসি (Crimson/Yellow-backed/Scarlet-throated/Scarlet-breasted Sunbird): সিঁদুরে-লাল মৌটুসি নামেও পরিচিত। ছোট্ট সুদর্শন পাখিটি এদেশের অন্যতম সুন্দর ও দুর্লভ আবাসিক পাখি। এটি এদেশের চিরসবুজ ও পাতাঝরা বন, ক্ষুদ্র ঝোপ ও বাঁদাবনে বিচরণ করে। অনেক সময় গ্রাম ও শহরতলীর সুমিষ্ট মধুসম্পন্ন ফুল বাগানেও ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। পাখিটিকে আমি প্রথম দেখি রংপুরে, ২০১০ সালে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় একসঙ্গে দেখেছি ময়মনসিংহে ২০১৪ সালে। এছাড়াও প্রতিবছরই দেখি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রজাতিটিকে ভারত ও চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এটি সিঙ্গাপুরের জাতীয় পাখির মর্যাদা লাভ করেছে। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Aethopyga siparaja (ইথোপিগা সিপারাজা)।

সিঁদুরে মৌটুসির টোনা লম্বায় প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার ও টুনি ১০ সেন্টিমিটার। ওজনে ৮ থেকে ১১ গ্রাম। টোনা-টুনির পালকের রঙে অনেক পার্থক্য। টোনার গলা, বুক ও বুকের দু-পাশ উজ্জ্বল লাল। চঞ্চুর গোড়া থেকে গলার দু-পাশে গোঁফের মতো ধাতব নীলচে-সবুজ ডোরা রয়েছে। মাথার চাঁদি ধাতব সবুজ। রোদের আলোয় মাথার চাঁদি ও গোঁফ চকচক করতে থাকে। পিঠ কালচে গাঢ় বা মেরুন লাল। কোমড়ের পালক হলুদ। লেজের লম্বা পালক সবুজ যার আগার বাইরের দিকটা সাদা। পেট ও পায়ুর পালক হলদে-জলপাই। ডানার গোড়া লালচে-জলপাই ও বাকিটা গাঢ় জলপাই। টুনির দেহের উপরটা জলপাই-সবুজ ও নিচটা হলদে-জলপাই। লেজ গোলাকার, যার আগা সাদা। গলা ও বুকের উজ্জ্বল লাল আভা ছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে মায়ের মতো। টোনা-টুনি নির্বিশেষে পা, আঙুল, নখ ও বাঁকানো চঞ্চুটি কালচে-বাদামি।

কাঠাল গাছে নিজ বাসায় ডিমে তা দানরত নীলটুনি। ছবি- লেখক

৩. সবুজাভ মৌটুসি (Ruby-cheeked Sunbird/Rubycheek): এটি চুনিকন্ঠি মৌটুসি নামেও পরিচিত। এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ, পাতাঝরা ও বাঁদাবন এবং বনের আশেপাশের ঝোপঝাড়ে দেখা যায়। আমি সর্বপ্রথম ওকে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে দেখেছি। পরবর্তীতে সুন্দরবন ও সিলেট বিভাগে দেখেছি। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাখিটির বিস্তৃতি রয়েছে। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Anthreptes singalensis (অ্যানথ্রেপ্টেস সিঙ্গালেনসিস)।

সবুজাভ মৌটুসির চঞ্চুর অন্যান্য প্রজাতির মৌটুসির তুলনায় খাটো ও ফুলঝুরির (Flowerpecker) থেকে বড়। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১১ সেন্টিমিটার। টোনা ও টুনির দেহের রঙে পার্থক্য থাকে। টোনার মাথার চাঁদি, ঘাড়, পিঠের উপরাংশ, কোমড় ও লেজের উপরটা ধাতব সবুজ বা পান্না। ডানা ও লেজ কিছুটা কালচে। চিবুক চুনি থেকে বেগুনি। গলা ও বুক গাঢ় লালচে-কমলা। পেট ও লেজের তলা হলদে। অন্যদিকে, টুনির দেহের উপরটা অনুজ্জ্বল জলপাই-সবুজ। গলা ও বুক হালকা লালচে-কমলা। পেট ও লেজের তলা হলদে। তবে, টোনার মতো গালে চুনি রঙ দেখা যায় না। টোনা-টুনি নির্বিশেষে চোখ লাল এবং পা, আঙুল ও নখ সবুজাভ-ধূসর। চঞ্চু ছোট, সোজা ও কালচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে হুবহু মায়ের মতো, তবে দেহের নিচটা পরোপুরি হলুদ।

৪. মৌটুসি (Purple-rumped Sunbird): মনচুঙ্গী নামেও পরিচিত। এটি এদেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। নীলটুনির মতো বাগান ও গাছপালাসম্মৃদ্ধ এলাকায় বাস করে। আমি সর্বপ্রথম ওকে ঢাকার রমনা পার্কে দেখেছি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারে দেখা যায়। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Leptocoma zeylonica (ল্যাপটোকোমা জেইলোনিকা)।

মৌটুসির দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটারের কম। নিচের দিকে বাঁকানো চঞ্চুটি মাঝারি আকারের। টোনা ও টুনির দেহের রঙে পার্থক্য রয়েছে। টোনার দেহের উপরটা গাঢ় মেরুন। মাথা নীলাভ-সবুজ, নির্দিষ্ট কোণ থেকে যা চকচকে দেখায়। ঘাড় গাঢ় সবুজ ও পাছা বেগুনি। কালচে গলায় বেগুনি আভা ও বুকে মেরুন ডোরা। দেহের নিচটা সাদাটে। অন্যদিকে, টুনির দেহের উপরটা জলপাই বা বাদামি। গলা সাদা ও বুক হলদে। লেজের উপরের পালক-ঢাকনি কালো। চোখের উপরে একটি হালকা দাগ থাকতে পারে। টোনা-টুনি নির্বিশেষে চোখের মনি লালচে। চঞ্চু, পা ও আঙুল কালচে।

বহুপুষ্পিকা গাছে সিঁদুরে মৌটুসির টুনি। ছবি- লেখক

৫. বেগুনি-গলা মৌটুসি (Purple-throated/Van Hasselt’s  Sunbird): বেগুনি-বুক মৌটুসি নামেও পরিচিত। এটি এদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। বনের কিনারা, ছড়ার আশপাশ, বন লাগোয়া আবাদি জমি ও বাগানের ফুলে ফুলে বিচরণ করে নির্যাস পান করে। ওকে প্রথম দেখি শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। পরবর্তীতে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে এবং সবশেষে এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাখিটির দেখা মিলে। বেগুনি-গলা মৌটুসির বৈজ্ঞানিক নাম Leptocoma sperta (ল্যাপটোকোমা স্পারটা)।

পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ সেন্টিমিটার, যার মধ্যে ঠোঁটই প্রায় ১.৬ সেন্টিমিটার। টোনা ও টুনির চেহারায় কোনো মিল নেই। টোনাটি প্রথম দর্শনে কালচে পাখি। তবে, রোদের আলোয় মাথার চাঁদি ধাতব সবুজ দেখায়। ঘাড়, পিঠ, ডানা ও লেজ কালচে। দেহের পেছনটা ও কোমড় নীল। বুক ও পেটের উপরটা লালচে, তলপেট বাদামি। টুনির দেহের উপরটা জলপাই-বাদামি ও নিচটা হালকা হলুদ। সাধারণ মানুষের পক্ষে অন্যান্য প্রজাতির স্ত্রী মৌটুসি থেকে এটিকে আলাদা করা কঠিন। টোনা-টুনি নির্বিশেষে সরু ও সামনের দিকে বাঁকানো চঞ্চুটি কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল কালো। চোখের মনি বাদামি।

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মান্দার গাছে সিঁদুরে হলুদ মৌটুসির টোনা। ছবি- লেখক

৬. সিঁদুরে হলুদ মৌটুসি (Mrs. Gould’s sunbird): মিসেস গোল্ডের মৌটুসিও বলা যায়। বিখ্যাত বৃটিশ পক্ষীবিদ জন গোল্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ গোল্ডের নামে এই পাখির নাম রাখা হয়েছে, যিনি ছিলেন একজন চিত্রকর। জন গোল্ডের বেশ ক’টি পাখির বইয়ের ছবি উনি এঁকেছেন। অতি সুন্দর বিরল পাখিটি পরিযায়ী হয়ে কালে-ভদ্রে এদেশে আসে। পাখিটিকে প্রথম দেখি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মান্দার গাছে ২০১৯ সালের ৯ মার্চ। পরের দু’বছরও একই সময় ওদের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে দেখলাম। মূল আবাস হিমালয়ের আশপাশের দেশ, যেমন- ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ইত্যাদি। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Aethopyga gouldiae  (ইথোপিগা গোল্ডি)।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বড় ছড়ায় সীমগাছে বেগুনি-গলা মৌটুসির টুনি। ছবি- লেখক

সিঁদুরে হলুদ মৌটুসির টোনা লম্বায় ১৪ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার, যার মধ্যে লেজ ৪ ও ঠোঁট ২ সেন্টিমিটার। তবে, টুনি মাত্র ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। বাহারি এই পাখিটির রঙের মেলা শুধু টোনার দেহেই। অন্যান্য প্রজাতির মৌটুসির মতো টুনির দেহ অনুজ্জ্বল জলপাই। লেজ ছোট ও গোলাকার। পেট হালকা হলদে। মাথা ও মুখম-ল ধূসর বা নীলচে-ধূসর। অন্যদিকে, বাহারি টোনার মাথার চাঁদি, মুখমণ্ডল, কান-ঢাকনি ও গলা ধাতব নীল থেকে বেগুনি। মাথার পিছন, ঘাড়, পিঠ ও দেহের উপরটা সিঁদুরে লাল। ডানার উপরটা জলপাই। বুক-পেট ও লেজের নিচের দিক হলুদ। লেজের পালক নীল। চোখ বাদামি। চঞ্চু, পা, আঙুল ও নখ কালো।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সবুজাভ মৌটুসির টোনা। ছবি- লেখক

প্রায় সব প্রজাতির মৌটুসিই হামিংবার্ডের মতো হোভারিং করে অর্থাৎ শূণ্যে স্থির থেকে ফুলের মধু পান করতে সক্ষম। মধুর অভাবে ছোট ছোট পোকামাকড় ও মাকড়সা খায়। চঞ্চল পাখিগুলো বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এ গাছ থেকে ও গাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে বেড়ায়। প্রজাতিভেদে মার্চ থেকে আগস্টে প্রজনন করে। কোনো কোনো প্রজাতি, যেমন- নীলটুনি, মৌটুসি দু’তিনবার প্রজনন করে। গাছের পাতায় মাকড়সার জাল ও শেওলা দিয়ে ছোট্ট ঝুলন্ত বাসা বানায়। প্রজাতিভেদে দু’তিনটি সাদাটে ডিম পাড়ে, যাতে হালকা লালচে-বাদামি ছিট থকে। ডিম ফোটে ১৪ থেকে ১৫ দিনে। আয়ুষ্কাল ৩ থেকে ৮ বছর।

প্রজাতিভেদে মৌটুসিরা ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে প্রজনন করে। তবে কোন কোন প্রজাতি বছরের যে কোন সময় ডিম-ছানা তুলতে পারে। গ্রামে বাসকারী মৌটুসিরা সাধারণত গেরস্থ বাড়ির আঙিনায় বরই-ডালিম গাছের চিকন ঝুলে পড়া শাখা প্রশাখায় অথবা লাউ-সিম লতানো গাছের ডগায় বাসা বাঁধে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, গেরস্থ বাড়ির আশপাশে ছাড়া এরা বাসা বাঁধতেই চায় না। মানুষের সান্নিধ্য এদের চাই-ই চাই। এই যে মানুষের এত কাছে বাসা বাঁধে তবুও সচরাচর তা চোখে পড়ে না। হঠাৎ দেখলে বাসাটাকে ঝোপ-জঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু মনে হবে না। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতেই এ ধরনের ছদ্মবেশী (Camouflage) বাসা বানায়। নীলটুনি ও মৌটুসির বাসা দেখতে প্রায় একই রকম।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সবুজাভ মৌটুসির টোনা। ছবি- লেখক

তবে মৌটুসির তুলনায় নীলটুনির বাসা খানিকটা বড় হয়। শহরের মৌটুসিরা লতানো গাছে, যেমন- কলকে জবা, বাগান বিলাস, মাধবী লতা, মালঞ্চ, ঝুমকো প্রভৃতি ঝোঁপেও বাসা বাঁধে। বাসা মাটি থেকে দুতিন মিটার উঁচুতে থাকে। সিঁদুরে মৌটুসি ছোট গাছ বা ঝোপঝাড়ের ঝুলন্ত সরু ডালে শিকড় বা চিকন আঁশ দিয়ে ঝুলন্ত বাসা বানায়। এদের বাসা নীলটুনির থেকে লম্বা ও চাপানো এবং দেখতে খোসা ছাড়ানো পাকা ধুন্দল-এর মতো। অন্যদিকে, পাহাড়ে বসবাসকারী বেগুনি-গলা মৌটুসি লম্বা থলের মতো ঝুলন্ত বাসা বানায় গাছের সরু শাখায় ঘাস, আঁশ, পাতা, বাকল, মাকড়সার জাল ইত্যাদি দিয়ে। টোনা-টুনি একসঙ্গে মিলেমিশে বাসা বানায়।

কাপ্তাই বন বাংলোর একটি গাছে বেগুনি-গলা মৌটুসির টোনা। ছবি- লেখক

মৌটুসিদের বাসার গড়নে ও সাজসজ্জায় রুচি ও বিলাসের ছাপ দেখা যায়। সৌন্দর্য ও প্রকৌশলী গুণে বাবুইয়ের পরই এদের বাসার স্থান। মাকড়সার জাল দিয়ে বাসার ভিত রচনা করে। বাসাটা দেখতে অনেকটা থলের মতো। বাসায় ঢোকার পথ উপরের দিকে। ঢোকার পথের মুখের উপরে সানশেডের মতো ছাদ থাকে। বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্যই হয়তো এ ব্যবস্থা। বাসায় ডিম বাচ্চা রক্ষার জন্যও সব ধরনের ব্যবস্থা আছে।

বাসাটি ঝোঁপ-ঝাড়-লতার সঙ্গে ভালোভাবে আটকানো থাকে, বাতাসে দোলে। বাতাসের সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাসার নিচের দিকে মাকড়সার জাল ও লতাপাতা সূতোর মতো ঝুলানো থাকে। এরা অত্যন্ত বিলাসি পাখি। এদের বাসার ভেতরে থাকে চমৎকার অলংকরণ। মিহি ঘাস, সরু পাতা ও কোমল লতাকাঠি দিয়ে বাসা তৈরি করে। বাসার উপরে ফুলের পাঁপড়ি মাকড়সার আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়। গোলাপ পাঁপড়ি, বাগান বিলাসের শুকনো পাঁপড়ি, রঙিন কাগজের টুকরো, শিমুল তুলো, কাশ ফুল, পাটের মিহি সাদা আঁশ ইত্যাদি বাসায় সাঁটা থাকে। বাসার ভেতরে ডিম রাখার জন্য থাকে কোমল বিছানা।

ঢাকার রমনা পার্কে একটি পুরুষ মৌটুসি। ছবি- লেখক

এরা প্রতি মৌসুমে নতুন বাসা বানায়। তবে পুরনো বাসাটি শক্তপোক্ত থাকলে অনেক সময় দু’বারও ব্যবহার করতে পারে। আমার বাসার কাঁঠাল গাছে, আমার ঠিক জানালা বরাবর একজোড়া নীলটুনি বাসা বানিয়েছিল। এরা পরপর দুই মৌসুম সেই বাসাটিতে বাচ্চা তুলেছে। তৃতীয় মৌসুমেও বাসাটিকে একটু ঠিকঠাক করে চালিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু একদিন এক ঝড়ে বাসাটি ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ওরা আর সেটা ব্যবহার করতে পারে নি।

বাসার জায়গা পছন্দ করা ও বাসা তৈরির পুরো দায়িত্ব মেয়ে পাখির। ছেলেটি শুধু মাঝে মাঝে এসে কাজ তদারকি করে। প্রজাতিভেদে স্ত্রী মৌটুসি ২ থেকে ৩টি সাদা, ধূসর বা সবুজাভ সাদা ডিম পাড়ে। তার উপর থাকে লালচে, গোলাপি বা বাদামি ছোপ। টুনি বাসায় বসে যখন ডিমে তা দেয়, তার লম্বা ছুঁচালো ঠোঁটটি দরজার মুখে বেরিয়ে থাকে। এ সময় মৃদু বাতাস এলে অল্প অল্প দোদুল্যমান বাসাটি দেখতে চমৎকার সুন্দর লাগে।

মেহেরপুরে নিজ বাসায় একটি স্ত্রী মৌটুসি। ছবি- লেখক

টোনা কখনোই ডিমে তা দেয় না; এ দায়িত্বটুকু টুনির। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হতে ১৪ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। বাবা-মা একত্রে মিলে বাচ্চাদের খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তোলে। বাচ্চারা বেশ দ্রুত বাড়ে। ডিম থেকে ফোটার ১৬ থেকে ১৭ দিনের মাথায় বাচ্চারা বাসা ছাড়ে। বাসা ছাড়ার পরও এরা সপ্তাহ দুয়েক বাবা-মার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। এরপর একসময় ঘর বাঁধে। আমাদের মৌটুসিরা ৮ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *