খেলার খবর

নান্দাইলের প্রীতির দেশ সেরা ফুটবলার হওয়ার গল্প

ডেস্ক রিপোর্ট: কৃষাণী এক সংগ্রামী মায়ের সংগ্রামী কন্যা সুরভী আক্তার প্রীতি। মেয়েদের ফুটবল খেলা হবে না। তা কেন আমরা মেয়েরা শুধু বাড়িতে থাকব, রান্না করব তা কি হয়!  পুরুষ শাসিত এই সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৩য় শ্রেণীতে পড়ালেখার সময় প্রীতি ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে শুরু করে। শুরুতে তাকে গ্রামের এক শ্রেণির লোকজন বাজে মন্তব্য করে বাধা দিলেও তাদের মুখেই শোনা যায় সুরভী আক্তার প্রীতির প্রশংসা।

প্রীতি বলেন, আমার বল খেলা ছোটকাল থেকেই। আমার স্বপ্ন ছিল নিজ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে খেলা শুরু করে ভবিষ্যতে বড় ফুটবলার হব। শুরু থেকেই কিছুটা বাধা পরে। ২০১৮ সালে নিজ বিদ্যালয় থেকে খেলতে না পেরে আরেক ইউনিয়ন পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা গোল্ড কাপে রংপুর বিভাগকে হারিয়ে ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হয়। 

তখন থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল একাদশে খেলব। একাদশে প্রথমবারের মত সুযোগ পেয়ে সৌরভী আকন্দ প্রীতি বুঝিয়ে দিলেন এর পরের ম্যাচ থেকে তাকে শুরু থেকেই মাঠে না নামানোর বিকল্প নেই। যেই কথা সেই কাজ। কমলাপুরে সৌরভ ছড়িয়ে প্রীতি হয়ে উঠলেন সকলের মধ্যমনি।

প্রীতি বলেন, আগের দুই ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন বদলি হিসেবে। ভুটানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক পেলেও নেপালের বিপক্ষে গোল পাননি। সেদিন হার দেখেছিল বাংলাদেশ। ভুটানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে একাদশে প্রথমবারের মত সুযোগ পেয়ে বুঝিয়ে দিলেন, পরের ম্যাচ থেকেই তাকে শুরু থেকেই মাঠে না নামানোর বিকল্প নেই কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের। সাফ অনূর্ধ্ব ১৫ নারী সাফে ভুটানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৮-০ গোলে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ ২২ মিনিটে হ্যাটট্রিক করেছিল সুরভী। একই দলের বিপক্ষে শুরু থেকেই খেলছেন এই ফুটবলার।

সুযোগটা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। অনুর্ধ্ব ১৬ সাফ জয়ী সুরভী আক্তার প্রীতি বলেন, ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৯-০ গোলে বিশাল ব্যবধানে জয়ের  ৬-০ গোল একাই করেছেন সুরভী আকন্দ প্রীতি। অন্য তিন গোল নুসরাত জাহান মিতু, আশা আক্তার ও থুইনু মারমা। সব মিলিয়ে তিন ম্যাচে সুরভির গোল ৯।

সুরভীর আলো ছড়ানোর ম্যাচে শিরোপা জেতার স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখলো বাংলাদেশ। সুরভী বলেন, আমাদের পণ ছিল ১১ই নভেম্বরের শেষ ম্যাচে নেপালকে হারাতেই হবে।

ছবি: সংগৃহীত 

সেদিন কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে সুরভীকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের কোচ ছোটন। নেপাল ম্যাচে সুরভীকে খেলানো হলে ম্যাচে বাংলাদেশ জিততো কিনা এমন প্রশ্ন শুনতে হয় তাকে। তখন তিনি নাকি বলেছিলেন আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কোচের পরিকল্পনা ছিল শুরু থেকেই আমাকে মাঠে নামানোর এবং মাঠে নেমে আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছি।

সৌরভী আকন্দ প্রীতি বলেন, একবার এমন অবস্থা হয়েছিল। অসুস্থতার কারণে ক্যাম্প ছাড়ার অবস্থা হলে নিজেকে বদলিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আমার বড় ভাইয়ের সহযোগিতা আমার শারীরিক উন্নতি হয়েছে। আমার বড় ভাই না থাকলে হয়তো আমি অসুস্থ হয়েই পরে থাকতাম। আমাদের কোচ, সালাউদ্দিন স্যার, কিরণ ম্যাডামের সহযোগিতায় আমার এতদূর আসা। আমি ভেবেছিলাম আমার অনেক বন্ধুদের মত আমাকেও ঝড়ে পড়তে হবে কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার ভাই আমাকে সব সময় সাহস শক্তি ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা এতদূর নিয়ে এসেছে। আমি আমার পরিবার এলাকাবাসী ও নান্দাইলবাসির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে নিজের বিদ্যালয়কে সেরা করেছি। পরের বছর বাফুফের প্রতিভা অন্বেষণমূলক টুর্নামেন্টে ইউনিসেফের কাপ দিয়ে বাফুফের ক্যাম্প এ আসি। যে দিন ডাবল হ্যাটট্রিক করেছি ফুটবল খেলায় পারিবারিক কোনো চাপ ছিল না। পরিবার পাশেই ছিল সবসময়। এক ভাই চার বোনের পরিবারে সৌরভী আক্তার প্রীতি সবার ছোট। 

চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। এই ম্যাচেও গোল করেন সৌরভি আক্তার প্রীতি। তার আগে এপ্রিলে সিঙ্গাপুরে এএফসি  অনুর্ধ্ব-১৭ উইমেন্স এশিয়ান কাপ ২০২৩ বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয় । সেখানে প্রথম খেলায় তুর্কমেনিস্তানের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। পরের খেলায় স্বাগতিক সিঙ্গাপুরকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় সুরভী আক্তার প্রীতিরা । এই খেলায় প্রীতির পা থেকে আসে দুই গোল। দেশে ফিরে প্রস্ততি শুরু করে দ্বিতীয় পর্ব খেলার জন্য।

প্রীতি বলেন, আমার পরিবার দরিদ্র পরিবার। আয় -রোজগার করার মতো কেউ নাই। আমি ফুটবল খেলে যা পাই এবং নিজের অল্প জমিতে চাষাবাদ করে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই চলে আমার সংসার। আমার বড় ভাই বেকার। এ অবস্থায় কষ্ট করেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। আশঙ্কা করছি বোধ হয় লেখাপড়া আর করতে পারবো না।
আমার প্রত্যাশা একদিন বাংলাদেশ মূল জাতীয় দলে খেলার। অনেক বড় খেলোয়াড় হতে চাই । 

বড় ভাই জহুরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ছোট বোন সুরভী আক্তার প্রীতিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। সরকার প্রধান তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন যেন আমাদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন।  

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪ ডট কম-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *