সারাদেশ

সামাজিক মাধ্যমের যুগে প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম আরও অপরিহার্য

ডেস্ক রিপোর্ট: সামাজিক মাধ্যমের যুগে প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম আরও অপরিহার্য

ছবি: বার্তা২৪.কম

ডিজিটাল যুগে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অপ্রতিরোধ্য একটি শক্তিই হয়ে উঠেছে। এই মিডিয়া সমাজটাকে বদলে দিচ্ছে আর যোগাযোগে ঘটিয়েছে বিপ্লব। কিন্তু ব্যাপক বিস্তৃত এই মিডিয়া আমাদের তথ্যচাহিদার সমগ্রপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এবং পারবেও না। মিডিয়ার যে দীর্ঘ প্রচলিত ধারা তার স্থান দখল করে নেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না সামাজিক মাধ্যমের পক্ষে। আর সেটা হয়তো সামাজিক মাধ্যম করবেও না। প্রচলিত গণমাধ্যম আমাদের তথ্য ব্যবস্থার মূলভিত্তি হিসেবেই থেকে যাবে। আর তা বহুবিধ কারণেই থাকবে।

দীর্ঘ প্রচলনে এই মিডিয়া ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রিন্ট, রেডিও ও টেলিভিশন। যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েই সমাজকে সেবা দিয়ে আসছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। সাংবাদিকতার মূল প্রপঞ্চ সততা, সঠিকতা ও নিরপেক্ষতাকে উচ্চে তুলে ধরেই এই মাধ্যমগুলো সামনে এগিয়েছে। এটা বলছি না যে, এসব মাধ্যম ব্যর্থ হতেই পারেনা। তবে এ কথা অবশ্যই বলা যায়, এই মিডিয়াগুলো জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা বজায় যেমন রাখতে পারে, তেমনি একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সও তারা নিশ্চিত করতে পারে।

পক্ষান্তরে সামাজিক মাধ্যম এক ভিন্ন প্যারাডাইম নিয়েই হাজির হয়েছে, এবং পরিচালিত হচ্ছে। সঠিক তথ্য সরবরাহ এর প্রাথমিক লক্ষ্যই নয়। বরং ব্যবহারকারীকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, ব্যস্ত রাখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে যেখানে তারা কনটেন্ট তৈরি করে ভাইরাল করবে, এটাই লক্ষ্য। আর এই ‘ভাইরাল’ মানসিকতাই সামাজিক মাধ্যমকে ভুলতথ্য ও অপতথ্য ছড়ানোর দিকে ধাবিত করছে। যার মারাত্মক পরিণতিও ঘটা সম্ভব, বিশেষ করে সঙ্কটময় সময়গুলোতে।

প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের প্রধান শক্তিগুলোর একটি হচ্ছে এর সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ। তাদের নিয়োজিত সম্পাদকরা রয়েছেন, ফ্যাক্টচেকার রয়েছেন, যারা কোনো কনটেন্ট প্রকাশের আগে যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে নেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের প্রকাশিত তথ্য নির্ভরযোগ্য যেমন হয়ে ওঠে তেমনি তা বিশ্বাসযোগ্যও হয়। সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর এমন সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একটি পোস্ট কোনো ধরনের ফ্যাক্টচেকিং ছাড়াই ভাইরাল হয়ে যেতে পারে, আর তার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে কোনো অপতথ্য।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ অতিমারির সময় প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোয় সঠিক তথ্য প্রবাহের প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। সংবাদমাধ্যমগুলোর কারণেই তখন আমরা ভাইরাসটির বিস্তার, ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেয়েছি। ফলে এই সময়ে অপতথ্য ছড়ানোর প্রচেষ্টাগুলোকে ভন্ডুল করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

তবে, এটা নয় যে সামাজিক মাধ্যমের কোনো মেরিট নেই। এটি প্রত্যেকের মনের কথা বলার, মতামত প্রকাশের একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে কমিউনিটিকে এনগেজ করে রাখা সম্ভব। তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ও মিথষ্ক্রিয়ার সুবিধার কারণে এটি জনমত গঠন ও সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায়ও একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা।

উপরন্তু, প্রচলিত গণমাধ্যমের জন্য এই মিডিয়া সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিস্তৃতি পেতে পারে, পৌঁছে যেতে পারে আরও বিস্তৃত পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কাছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত তথ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হতে পারে, কনটেন্টের সাথে পাঠক, দর্শক হয়ে উঠতে পারে আরও বেশি সম্পৃক্ত। তাতে বিষয়ভিত্তিক গভীরতর বোধগম্যতার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আরেকটি বিষয়, সামাজিক মাধ্যমের এই উত্থান কিছু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও ডেকে এনেছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষার ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করার মতো। ভাইরালের সংস্কৃতি আর দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে, বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এমন তথ্য ও বিশ্লেষণ এই মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে যা সমাজকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেছে তার সবগুলোর পেছনেই সামাজিক মাধ্যমের কোনো না কোনো ভূমিকা থেকে গেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে সমাজে মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিভিন্ন মিডিয়ার ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর ব্যাপারে সঠিক বোধ থাকলেই নাগরিক সমাজ তথ্যের যথার্থ গ্রাহক হয়ে উঠতে পারবে। আর তাতেই রোধ করা সম্ভব হবে ভুল তথ্য ও অপতথ্যের বিস্তার।

তথ্যের বাতাবরণকে যদি আমরা আরও শক্তিশালী করে তুলতে চাই, তাহলে সরকার, প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। সংলাপের সংস্কৃতি ও পারষ্পরিক সম্মানবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমেই আমরা এই সম্পর্ককে ত্রিধাবিভক্তি এড়িয়ে যুথবদ্ধতার দিকে এগিয়ে নিতে পারি।

স্বাস্থ্যকর তথ্য বাতাবরণ নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক নয় বরং একটি সহযোগিতার সম্পর্কে রূপ দিতে হবে। সমন্বিত সম্ভাবনাগুলোর বাস্তবায়নে পারস্পরিক নির্ভরতার দিকগুলো স্বীকার করে নিয়েই এগুতে হবে। ডিজিটাল যুগে আমরা যত এগিয়ে যাবো, ততই আমাদের নতুন নতুন বিষয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তবে সাথে সাথে নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ যেনো থাকে ভাইব্র্যান্ট, বহুমুখী ও গণতান্ত্রিক।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম, নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটি (এনএসইউ)

দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত নিবন্ধটির ভাবানুবাদ করেছেন মাহমুদ মেনন, এডিটর এট্ লার্জ; বার্তা২৪.কম

মেট্রোরেলের ভাড়ায় করারোপ জনগণের পকেট কাটতে সবাই তৎপর

ছবি: বার্তা২৪.কম

কিছুদিন আগেই নির্বাহী আদেশে বাড়লো বিদ্যুতের দাম। অংশীজনদের সঙ্গে শুনানি পর যৌক্তিকতা পর্যালোচনার করে মূল্য বাড়ানোর সুপারিশ প্রদানে ‘এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাকে পাশ কাটিয়ে মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে জনঅসন্তোষের মাঝেই গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন আরেক খবর জনগণকে আবারও শঙ্কিত করে তুলেছে। খবর অনুযায়ী, রাজধানীর যানজট নিরসনে নাগরিকদের যোগাযোগে নতুন মাত্রা নিয়ে আসা মেট্রোরেলের ভাড়ায় ১৫ শতাংশ করারোপ করা হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের প্রথম দিন (১ জুলাই) থেকে ভ্যাট আরোপ হচ্ছে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএল’কে চিঠি দিয়েছে। খবরটি গণমাধ্যমে আসার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগগুলোতে সাধারণের অগণিত প্রতিক্রিয়া এসেছে, বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষ-যারা প্রতিদিন এই মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন। অধিকাংশই এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে যা বলছেন, তার মর্মার্থ মোটামুটি একই রকম, ‘নিরুপায় জনগণের পকেট কাটতে সবাই তৎপর’।

বলার অপেক্ষা রাখে না, যানজটের শহর ঢাকায় মেট্রোরেল এক নতুন আশার সঞ্চার করে। বিশেষ করে কর্মজীবীদের জন্য এই মেট্রোরেল এক বিরাট আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। যদিও শুরুতেই ঢাকার মেট্রো রেলের ভাড়া বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে যাত্রীদের অভিযোগে ছিল। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১০০টাকা জনপ্রতি ভাড়া অনেকের জন্য অতিরিক্ত মনে না হলেও যারা স্বল্প আয়ের মানুষ, তারা একে সাধারণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে বর্ণনা করেন।

প্রতিবেশি দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পৌছে ৫০ টাকারও কম ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ আছে। সাধারণ যাত্রীরা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, যানজট হ্রাস পাওয়ায় একদিকে বিপুল পরিমাণ জ¦ালানি যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, তেমনি কর্মঘণ্টাও বেড়ে যাচ্ছে; যার প্রভাব পড়ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে। এমন বাস্তবতায় বছর না গড়াতেই মেট্রোরেলের ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর আরোপের সিদ্ধান্তকে তারা ‘গরীবের পকেট কাটার’ নতুন ফন্দি হিসবে আখ্যা দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মেট্রোরেল কি কোন পণ্য? সেবা প্রদানকারী নতুন একটি যোগগাযোগের মাধ্যমকে কেন মূসকের আওতায় আনা হবে?’

স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে মতামত তুলে ধরা বেশির ভাগই তরুণ, যাদের অনেকেই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে চাকুরির আশায় ঘুরছেন কিংবা নতুন কাজে যোগ দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সিস্টেম লস কমিয়ে না এনে, কর্মচারী ও কর্তাব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের লাগাম না টেনে খুব সহজেই মূল্যবৃদ্ধির খড়গ জনগণের ওপর চালিয়ে দিতে খুবই তৎপর।

এনবিআর মেট্রোরেলে করারোপের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছে, ‘রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে। সেজন্য সরকারকে প্রতিনিয়ত অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে, যা মূলত আহরিত হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে। দেশীয় শিল্পের বিকাশ, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি লক্ষ্য সামনে রেখে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। উন্নয়নের বিপুল কর্মযজ্ঞে অর্থের জোগান অব্যাহত রাখাসহ দেশের এলডিসি উত্তরণ এবং কর-জিডিপি অনুপাত কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন খাতের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে প্রদত্ত অব্যাহতি সুবিধা ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে।’-বোঝা গেল সব দায় জনগণইে নিতে হবে।

মেট্রোরেলের ভাড়ায় করারোপের খবর জানার পরদিন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সরকারের সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানালেন, ভ্যাট নির্ধারণের বিষয়টি সরকার অবগত নয়। স্বভাবতোই আমাদের প্রশ্ন জাগে, সরকার তাহলে কে চালায়? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কি তবে সরকারের বাইরের কোন অংশ? সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক যখন এমন কথা বলেন, তখন জনগণের কাছে কি বার্তা যায়? এটি বলে সরকারের মন্ত্রীরা কি তবে জনগণের সঙ্গে উপহাস করেন?

আমরা জানি, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষদের কি অসহায়ত্ব! কাওরান বাজারে মাছের বদলে মাছের কাটা ও উচ্ছিষ্ট কিনে নেওয়ার খবরও সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে! স্বল্প আয়ের মানুষেরা চুলচেরা হিসেব কষেও খরচের হিসেব মেলাতে পারছেন না। প্রিয় সন্তানের আবদার মেটাতে না পেরে অসহায় বাবা-মায়েরা নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। আর্থ-সমাজিক এই সংকটের চিত্র লুকানোর তো সুযোগ নেই।

ক’দিন আগেই আমরা মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছি মহাসমারোহে। এবারের স্বাধীনতা দিবসে অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠেই আমরা ধ্বনিত হতে শুনেছি, সমতার যে বাংলাদেশের জন্য একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, সেই স্বদেশের স্বপ্ন আজও অধরাই থেকে গেছে। অর্থনীতিবিদরা এই প্রশ্নও তুলেছেন যে, একটি শ্রেণি যারা তাদের বিপুল অপ্রদর্শিত আয় করে সম্পদ কুক্ষিগত করেছেন, তাদের আর সাধারণ জনগণের কেন একই রকম করের বোঝা টানতে হবে? সম্পদে বৈষম্য থাকলে করারোপেও এই বৈষম্য প্রজোয্য হওয়া উচিত।

অবকাঠামোগত কিংবা নানা সূচকে আমাদের উন্নতি ঈর্ষণীয় হতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকারের যে সুরক্ষা তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি। সেকারণেই সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমভাবে বেড়ে গেছে। এই বৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রের উদ্যোগ সামান্যই চোখে পড়ছে, বরং রক্তশূণ্য শরীরের রক্ত শুষে নিতেই যেন সবাই তৎপর। ঢাকায় মেট্রোরেলের ভাড়ায় করারোপের সিদ্ধান্ত ও সরকারের মন্ত্রীদের এ নিয়ে লুকোচুরি খেলার প্রবণতা সেই বাস্তবতাকেই যেন মেলে ধরছে।

;

বুয়েটে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দায়িত্ব ছাত্রলীগের

ছবি: বার্তা২৪.কম

স্বাধিকার-স্বাধীনতা আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাত্রলীগ—এই পরিচয় এখন মূর্ত নয়। এখনকার পরিচয় কেবলই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পরিচয়ের সঙ্গে ক্ষমতাসীনের নামের যোগ থাকায় এখানে ক্ষমতার (অপ)ব্যবহার, দখল বাণিজ্যসহ বহুবিধ অন্যায্য কাজের দেখা মেলে। এখন তাই নামটি যতটা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তারচেয়ে বেশি হয় ভয়ের সঙ্গে। বাস্তবতা এমনই।

ছাত্রলীগের দখলে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাস। তারা নিজেরা আবার নিজেদের মধ্যে বহুধা-বিভক্ত। ব্যতিক্রম কেবল ছিল বুয়েট। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে ছাত্রশিবিরের মতো ঘৃণার চোখে দেখা হয়। ওখানে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ-সম কিছু। কারণ অজানা নয়। ছাত্রলীগে নিকট অতীতের নৃশংসতা তাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৯ সালে ক্যাম্পাসের মধ্যে আবরার ফাহাদ নামের এক শিক্ষার্থীকে অমানুষিক নির্যাতনে হত্যার পর সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের কাছে ভয়ের এক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যদিও মামলা-বিচার হয়েছে, তবু সেই ক্ষত শুকায়নি।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রবিক্ষোভ হয়েছে। দেশব্যাপী এটা ছড়িয়েছে। বুয়েট কর্তৃপক্ষ এরপর আবেগের বশে অতি-কঠোর সিদ্ধান্তে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বসে। বুয়েট প্রশাসনের সে সিদ্ধান্ত যতটা না যৌক্তিক, তারচেয়ে বেশি আবেগের, বলা যায় অতি-আবেগী। দেশের অধিকাংশ ক্যাম্পাসেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, অথচ বুয়েটে নিষিদ্ধ। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ইগোর প্রকাশের পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারিতারও প্রকাশ ঘটেছে। বুয়েট প্রশাসন যেখানে এই বিষয়ে স্থির-চিন্তার প্রকাশের কথা ছিল, সেখানে তারাও হয়ে পড়েছিল অতি-আবেগী। এই কারণে গত চার বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়েছে। রাজনীতির উদ্দেশ্য যে জনকল্যাণ সে ধারণা তাদের থেকে দূরে সরেছে। ‘হেইট পলিটিকস’ বাসা বেঁধেছে শিক্ষার্থীর মাঝে। অনতি-তরুণ শিক্ষার্থীরা যেখানে পাঠান্তে দেশ গড়ায় মনোনিবেশের প্রস্তুতি নেবে, সেখানে এসেই দেখছে এমন পরিবেশ, যেখানে রাজনীতিকে দেখা হয় ঘৃণার চোখে। অথচ কর্মজীবনে এরাই আবার সেই রাজনীতি-রাজনীতিকের মাধ্যমে পরিচালিত ‘জনকল্যাণে’ নিয়োজিত হবে। এখানে তাই নিয়োগ হবে, কিন্তু নিবেদনের দেখা মেলা কঠিন অনেকটাই।

গত চার বছর রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এমন চোখে দেখছিল যাতে তারা নিষিদ্ধ বস্তু! এবারের এই আন্দোলন কিংবা নানা কর্মসূচির শুরু হয়েছে মূলত রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ কয়েকজন বুয়েটে প্রবেশ করায়। যদিও সাদ্দামরা বলছেন, বৃষ্টি কারণে কিছু সময়ের জন্যে তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তবে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগ সভাপতির এই বক্তব্য মানতে রাজি নয়। প্রতিকূল প্রকৃতিতে বুয়েট ক্যাম্পাসের কোথাও আশ্রয়ও নিতে পারবে না ছাত্রলীগের কেউ—ঘৃণার এমনই উদ্‌গিরণ; ভাবা যায়! অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচি হলেও ছাত্রলীগ সভাপতি যদি মিথ্যা বলেও থাকতেন, তবু এটাকে নিজেদের জয় ভেবে মেনে নিয়ে কথা না বাড়ানোই উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সেটা তারা করেনি। অতি-প্রতিক্রিয়া কিংবা অতিরিক্ত ঘৃণায় ফেটে পড়ে বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাব্বির সিট বাতিল এবং তাকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে বসে তারা। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, বুয়েট প্রশাসনও ইমতিয়াজ রাব্বির সিট বাতিল করে দেয়।

এসব অতি-প্রতিক্রিয়া, নাবালক-সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। ইমতিয়াজ রাব্বি বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে জিতে গেছেন। উচ্চ আদালত বুয়েট-প্রশাসনের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে স্থগিত করেছে। এখন তাই দেশের অন্য ক্যাম্পাসের মতো বুয়েটেও ছাত্ররাজনীতি করা যাবে। যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন- তারা আইনি লড়াই চালাবেন। তবে এখানে আইনি লড়াইয়ে তাদের জয়ী হওয়া কঠিন, কারণ এক দেশে দুই নীতি দেশের উচ্চ আদালত গ্রাহ্য করবে বলে মনে হয় না।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিক ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে ওখানে ক্রিয়াশীল আছে একাধিক সংগঠন। এদের সকলেই প্রতিক্রিয়াশীল। জামায়াত-শিবির থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরির বুয়েট ক্যাম্পাসে বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল আছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত।

এবারের এই যে আন্দোলন, সেখানে বড় আওয়াজ ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চাই না’। কিন্তু যারা আছে এর নেপথ্যে, তারা কি সত্যি রাজনীতির বাইরের। বলা হচ্ছে, এই আন্দোলনে ইন্ধন যোগাচ্ছে ছাত্রশিবির-হিযবুত তাহরির; কিন্তু এটা বের করতে কোনোরূপ তদন্ত হচ্ছে বলে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। যদিও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল গত ৩০ মার্চ বলেছেন, ‘কিছুদিন আগেও অনেকে অভিযোগ করেছিলেন, কিছু জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী গোপনে সেখানে (বুয়েট) কার্যক্রম চালায়। বিষয়টি নিয়েও গভীরভাবে তদন্ত করবেন। তবে সব পক্ষের প্রতি তার আহ্বান, শিক্ষার পরিবেশ যাতে কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয়। আর ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ যদি এমন মানসিকতা রাখে যে, সেটা মনে হয় মৌলবাদী বা জঙ্গি গোষ্ঠীর কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো হচ্ছে, সেটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা আছে, যারা তদন্ত করছে, তারাও সেগুলো নিয়ে কাজ করবে। সেটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানেই নয়, সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।’ মন্ত্রী যখন বলেছেন তখন আশাবাদী হতে চাই যে, এর তদন্ত হবে, এবং জঙ্গিবাদী কোনো গোষ্ঠী বুয়েটে ক্রিয়াশীল থাকলে তা সমূলে উৎপাটন করা হবে।

গত কয়েকদিন ধরে আমরা দেখছি, বুয়েট শিক্ষার্থীদের উচ্চকিত একটা অংশ ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এটা তারা নিতেই পারে। তারা ছাত্ররাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে। তবে কেউ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করতে পারবে না এমন স্বেচ্ছাচারমূলক দাবি তাদের করা উচিত নয়। শিক্ষার্থীদের কেউ চাইলে রাজনীতি করবে, কেউ না চাইলে করবে না—এমনই তো হওয়া উচিত। ধারণা করা যায়, তারা ছাত্রলীগ-জুজুর মধ্যে আছে। বিশেষত ২০১৯ সালে বুয়েট-শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। একটা ট্রমা ভর করেছে। সেখান থেকে অনেকেই বের হতে পারছে না।

এই ট্রমা কিংবা চাপ এমনি-এমনি আসেনি। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা, সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটির নিকট অতীতের কীর্তিকলাপ অনেক শিক্ষার্থীকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে। ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য, দেশ স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ছাত্রলীগের পূর্বতন যে ভূমিকা সেটা এই প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে। ধূসর বর্তমান ঐতিহ্যের অতীতকে আড়াল করে দিয়েছে। এটা থেকে বের হতে সময় লাগবে; লাগুক। তবে প্রকাশ্য রাজনীতির এমন বিরুদ্ধাচরণ কোনোভাবে শোভন নয়।

রাজনীতি চাই আমরা সবখানে। কারণ সত্যিকার অর্থে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থাকলে মানুষের গুরুত্ব বাড়ে ক্ষমতাসীনদের কাছে, বিরোধীদলের কাছে, সকল রাজনৈতিক দলের কাছে, প্রশাসনের কাছে। প্রকাশ্য রাজনীতি না থাকলে মানুষের গুরুত্ব ক্রমে কমতে থাকে। এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা গণ-রাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখানে তাই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পথ রুদ্ধ করার পক্ষে থাকা উচিত নয় কারোরই।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীনদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কারণে কোনো ছাত্র সংগঠন বুয়েটে টিকতে পারবে না—এই ভয়ে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে পিছিয়ে যাওয়া কিংবা ছাত্ররাজনীতি চালুর বিরোধিতা করা উচিত হবে না। তাদেরকে নিজস্ব ক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখা দরকার, কোনো ছাত্র সংগঠন না থাকলে ‘অন্ধকারের আততায়ীরা’ আরও শক্তিশালী হবে বুয়েটে। মাঠ তাই খালি রাখা যাবে না। ছাত্রলীগেরও উচিত হবে বুয়েটে তাদের নেতিবাচক যে ভাবমূর্তি সেখান থেকে উত্তরণের জন্যে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো বিশেষত বামধারার সংগঠনগুলোর জন্যেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। কেবল সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের দাবি জানানোই নয়, নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির স্বপক্ষে ব্যাপক জনমত গড়তে প্রথমে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোকে সংলাপ বা আলোচনার আহ্বান জানানো। এটা আগে কখনই হয়নি বলে কখনোই হবে না বা করা যাবে না, এমন না; কিছু হোক বা না হোক অন্তত উদ্যোগ নেওয়া। এই উদ্যোগের ফলাফল যা-ই হোক, এটা অন্তত তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হতে পারে।

হাইকোর্টের আদেশের পর ধরে নেওয়া যায়, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরছে। উচ্চ আদালতের এই আদেশের পর ছাত্রলীগ যদি ধূসর বর্তমান থেকে উত্তরণের পথ না খুঁজে নিজেদের বিজয়ী ভাবে, তবে আদতে প্রাপ্তির কিছু নেই। বরং আছে শঙ্কার কালো মেঘ। মেঘ কাটুক; ফিরুক আলো!

;

বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি: কী বার্তা দিচ্ছে সশস্ত্র কেএনএফ বাহিনী?

ছবি: বার্তা২৪.কম

২৪ ঘণ্টার কম সময়ে বড় আকারের দুটি ব্যাংক লুট অবশ্যই নিরাপত্তাগত বিবেচনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ঘটনাটিকে ‘ব্যাংক ডাকাতি‘ আখ্যা দেওয়া হলেও তা নিছক চোর-ডাকাতের মামুলী অপরাধকর্ম নয়। এসব আক্রমণের পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট জাতিগত অসন্তোষ, পার্বত্য চট্টগ্রামের এলিট নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির ব্যর্থতা এবং মতাদর্শগত প্রণোদনা, যার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এসব সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম করছে। এসব সশস্ত্র পন্থায় তারা ডাকাতিকে উপলক্ষ্য করেছে বটে, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য আরো বড় ও সুদূরপ্রসারী।

শান্তিচুক্তি বিরোধী এই সংগঠনের সাথে যখন সরকারের শান্তির আলোচনা চলমান এবং আগামী ১৬ তারিখ চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে বলে প্রকাশ, তখন এই ধরনের হামলার মাধ্যমে কেএনএফ কী বার্তা দিতে চায়? শান্তি ও চুক্তির প্রতি তারা কী অনাস্থা প্রদর্শন করলো এই ব্যাপাক আকারের অপারেশনের মাধ্যমে? তাছাড়া অতীতে ব্যক্তি বা পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে আক্রমণ করলেও এই প্রথমবারের মতো কেএনএফ প্রশাসন ও সরকারি স্থাপনায় সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়েছে। তারা বিপুল সংখ্যক মানুষকে জিম্মি করেছে। সরকারি অস্ত্র ও ব্যাংকের টাকা লুটপাট করেছে। মসজিদ ও বাজারের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ করেছে। চাইলে বড় আকারের কিছু করাও কেএনএফ-এর পক্ষে সম্ভব ছিল। কারণ, প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তার ব্যবস্থা আদৌ সন্তোষজনক ছিল না।

মঙ্গলবার (০২ এপ্রিল) রাতে রুমায় ব্যাংক লুটের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়ার দাবি করা হলেও তা ছিল কথার কথা। বাস্তবে ঘটনাটির গুরুত্ব ও গভীরতা অনুধাবন করা উপজেলা পর্যাযের জুনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারিদের থাকার কথাও নয়। ফলে পরের দিন (বুধবার, ৩ এপ্রিল) দুপুরের মধ্যেই আরও দুটি ব্যাংকে লুটপাট ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে সীমান্ত-সংলগ্ন ও সংঘাত-প্রবণ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোও সামনে চলে এসেছে।

অতীতেও কেএনএফ নাশকতা চালিয়েছে। তাদেরকে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে আস্থায় আসার জন্য দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এতে কিছুদিন স্তিমিত থাকলেও কেএনএফ তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এবার প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধভাবে বড় আকারে আক্রমণ করে কেএনএফ নিজের শক্তির প্রদর্শনী করেছে এবং প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। মসজিদ, বাজার ও পাবলিক প্লেসে আক্রমণ করার সাহস দেখিয়েছে। এমনকি, আক্রমণের একদিন যাওয়ার আগেই এই ধরনের দ্বিতীয় আক্রমন, ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও মানুষকে জিম্মি করার ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা যে প্রস্তুত এবং নিঃশঙ্ক, এই বার্তা সহজেই পাঠ করা যায় কেএনএফ’র অ্যাকশনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এসব আক্রমণ প্রমাণ করে সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তাদের বিশ্বাস নেই। থাকলে আলোচনা চলমান সময়ে এবং রমজানের মতো পবিত্র মাসে কেএনএফ আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো না।

তাদের উদ্দেশ্য আরও বড়। সায়ত্ত্বশাসন কিংবা বাংলাদেশের সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ারমান অংশের কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে বড় আকারের ঐক্য গড়া ও বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।

মিয়ানমারে যে জাতিগত সশস্ত্র সংঘাত চলছে, সেখানে কুকি-চিন বা তাদের সমগোত্রী পক্ষগুলো সক্রিয়। এসব পক্ষকে দেশি-বিদেশি শক্তির ইন্ধন দিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করছে। মিয়ানমারে তারা সরকারি সামরিক বাহিনীকে পর্যুদস্তু করছে। ভারতের মণিপুর ও নাগাল্যান্ডকে সংঘাতময় করে তুলছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অংশের বান্দরবানে অবাধে সশস্ত্র হুমকি দিচ্ছে।

ফলে কেএনএফ কেবল বাংলাদেশ নয়, আন্তদেশীয় পর্যায়ে তৎপর। তাদের দ্বারা অনেক দেশই নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এবং কেএনএফ যত না দেশীয় সংগঠন, বরং একটি আঞ্চলিক সংগঠন। ফলে তাদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদেরকে দমনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

বিশেষ করে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে ভবিষতে আরও বড় আকারের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, এবার বান্দরবানে সিরিজ ডাকাতি কালে কেএনএফ নির্বিঘ্নে অপকর্ম করেছে। তাদেরকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি ও শক্তি প্রশাসনের ছিল না, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দেয়।

পার্বত্য রাজনীতি ও নিরাপত্তা কৌশলের ক্ষেত্রেও নীতি নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। গতানুগতিক পন্থায় পাহাড়ের অন্য সংগঠনগুলোর মতো কেএনএফ’কে বাগে আনা সম্ভব কিনা, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। বান্দরবানে একজন সাবেক মন্ত্রী সামরিক-বেসামরিক লোকজনদের নিয়ে যখন রাজকীয় ইতফার পার্টি করেন, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কেএনএফ প্রকাশ্যে বড় আকারে আক্রমণ করলো। ফলে পাহাড়ের ক্ষমতার রাজনীতি এই রেডিক্যাল ফোর্সকে সামাল দিতে পারবে বলে মনে করার কারণ নেই।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরিএসবিডি)।

;

সমকালীন রাজনীতির দ্বিচারিতা ও রিজভীদের ‘প্রত্যয়’

ছবি: বার্তা২৪.কম

লোকজ এক প্রবাদ শুনেছিলাম অনেক বছর আগে। একটি আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক প্রায়শঃই বলতেন, ‘গাঁজাখোরের বিচার হবে, করবে বিচার আফিম যে খায়’। তাঁর এই উক্তির মর্মার্থ তখন সেভাবে বুঝতে চেষ্টা না করলেও দেশের সমকালীন রাজনীতির হালচাল পর্যবেক্ষণে কথাটি মনে পড়ে গেল। আজ বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভী রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক কর্মসূচিতে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে কঠিন প্রত্যয় জানিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে আরেকটি কাশ্মীর হতে দেবেন না’।

সরল বিচারে কথাটি নিয়ে বলতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ কেন আরেকটি কাশ্মীর হতে যাবে? যে দলের নেতা হিসেবে তিনি এই হুঁশিয়ারি দিলেন সেই বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালেই আমরা দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে দেশকে ‘আফগানিস্তান বা পাকিস্তান’ করার প্রচেষ্টা দেখেছি। আলোচিত সেই দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার পর বিচারে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের জড়িত থাকার প্রমাণ বেরিয়ে এলে এটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে যে দেশের রাজনীতিতে কারা সার্বভৌমত্বের হুমকি।

নিঃসন্দেহে আমাদের সমকালীন রাজনীতির গুণগত মান কিংবা রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা নিয়ে সাধারণের অনেক প্রশ্ন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনতুষ্টি অর্জনে রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ, এটি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু দেশের কোন রাজনীতিবিদ যখন সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন তুলেন তখন নৈতিক জায়গা থেকে তার রাজনৈতিক দলের অবস্থান সেই বিষয়ে স্ববিরোধী কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সুশাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতায়নের যে জনদাবি রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে তা নিয়ে আমরা কেউই ভিন্নমত নই। যৌক্তিকভাবে এসব মৌলিক দাবির স্বপক্ষে সরকার বিরোধী দলগুলি অব্যাহত আন্দোলন-সংগ্রাম করবে। রাজনৈতিক দলগুলির এ ধরণের ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে শ্যাডো সরকারের ভূমিকা পালন করা হয়। এ ধরণের বিরোধিতায় জনগণ লাভবানই হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের চিরপ্রতিবাদী মানুষেরা নিজেদের স্বাধিকার-স্বায়ত্বশাসন কিংবা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবিতে বহু যুগ ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছে। জনগণের হৃদয় উৎসারিত সেই সংগ্রাম-প্লাবনে ঔপনিবেশিক দানবরা হার মেনেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ও পরবর্তী যুগে দেশের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের যে পরম্পরা তাতে লড়াই সংগ্রামের এই প্রবণতা বজায় থেকেছে সব সময়। কিন্তু সমকালীন রাজনীতিকে কিছুতেই আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরার সঙ্গে মেলাতে পারছি না।

একজন রুহুল কবির রিজভীই যে এমন অর্বাচীন মন্তব্য করেন তা কিন্তু নয়। এই সময়ে রাজনীতির মাঠে-ময়দানে এমন অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য আমরা প্রায়শই শুনি। এতে করে মোটাদাগে দুইটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়; প্রথমতঃ রাজনীতির মানুষদের অন্তঃসারশূন্যতা, দ্বিতীয়তঃ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা, তা যে পন্থাতেই হোক না কেন। তৃতীয়তঃ জনস্বার্থের চেয়ে ক্ষমতায় আরোহণের তীব্র আকাঙ্খা।

দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলির মতো বিএনপি ও এর নেতৃত্বের মাঝেও এইসব প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের উন্নত দেশে রূপান্তরে দলগুলি নিজেদের মত করে জনগণকে নানা আশার ফুলঝুরি শুনিয়ে বেড়ান। কিন্তু বর্তমান বিশে^র উন্নত দেশগুলির রাজনীতিবিদদের জ্ঞাননির্ভর ও দূরদর্শী প্রাকটিসের মডেল তারা গ্রহণ করেন না। যদিও আমাদের রাজনীতিবিদরা হরহামেশাই উন্নত দেশে সফর করে বেড়ান। শোনা যায়, অনেকে সেসব দেশে সেকেন্ড হোমও গড়ে তুলেছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয় যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি, তা আহরণে বা কাজে লাগানোর কোন সদিচ্ছাই তাদের মধ্যে দেখা যায় না।

আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র ও প্রধান মিত্র ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও অভিন্ন ভাষা এবং সাংস্কৃতিক যে গভীর সম্পর্ক তা যেমন ঈর্ষণীয়, তেমনি বিরলও বটে। কিন্তু সেই মধুর সংহতিতে চিড় ধরানোর প্রাণপণ চেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকেই প্রবল। ধ্রুব সত্য হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিম-লের একাংশ এই সংহতি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। একাত্তরের হানাদার পাকিস্তানিদের ভাবাদর্শের সঙ্গে তাদের বক্তব্যে ঐকতান খোঁজে পাওয়া যায়। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে এই বিরোধ বহুলাংশে আদর্শিকও। যার জন্য একাত্তরে গোটা জাতি স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও ক্ষুদ্র একটি অংশ বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় এবং মাতৃভূমির শত্রুদের সঙ্গে বাঙালি নিধনে শামিল হয়। সেই ক্ষুদ্র অংশটি গেল অর্ধশতাব্দিতে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে অনেক হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, হয়েছে বলবান। সেই কারণেই বাংলাদেশকে কাশ্মীর হতে না দেওয়ার মত অর্বাচীন বক্তব্য আসে।

এই রাজনীতিবিদদের বাস্তবতার সঙ্গে একটুকু যোগ নেই যে, বাংলাদেশের অখ-তা রক্ষা করা ভারতের নিজের প্রয়োজনেই অত্যাবশ্যক। এবং এই অত্যাশ্যক কাজ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকারই করে গেছেন, ভবিষ্যতেও করে যাবেন। দেশটির বিদেশনীতি, আরও স্পষ্ট বললে ‘বাংলাদেশ নীতিতে’ কোনো পরিবর্তন আসেনি; বরং ‘নেইবারহুড ফার্স্ট বা প্রতিবেশী প্রথম’ ধরণের আরও বলিষ্ঠ কর্মসূচি যোগ হয়েছে।

সেখানে ‘দিনে আন্ধা’ টাইপের বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা বেশিদূর হালে পানি পাবে না, এটাই বলাই যায়। তাই আমাদের সমকালীন রাজনীতিতে গুণগত মান ও দূরদৃষ্টির যে শূণ্যতা প্রকট হয়েছে সেটা কাটাতে দলগুলিকে আরও মনোযোগী হওয়া জরুরি। এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর না হয়ে সবার আগে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের অন্দরে মানসিকতা এবং মূল্যবোধে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কেননা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না এলে উন্নত দেশের রূপান্তরের নেতৃত্ব কিভাবে তৈরি হবে?

;

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *