সারাদেশ

জিম্মি নাবিকের মা: ছেলে ফিরলেই আমার ঈদ

ডেস্ক রিপোর্ট: চট্টগ্রাম নগরীর আসকারদীঘির পশ্চিম পাড় ধরে সামনে পা ফেলতেই চোখে পড়ল ঈদের সাজ সাজ রব। নতুন জামা পরে মানুষের আনাগোনা, কোলাকুলি, খুনসুটি। ঘরে ঘরে সেমাই-বিরিয়ানি খাওয়ার কত শত আয়োজন। কিন্তু সেই পথেরই শতদল ক্লাবের পেছনের তিন তলা বাড়িটির ওপরের একটি বাসায় আনন্দ-উৎসবের ছিটেফোঁটাও প্রবেশ করেনি।

ওই ঘরের আনাচেকানাচে এখন মন খারাপের আনাগোনা, রাজ্যের সব নীরবতা। একটু পর পর সেই নিস্তব্ধতা ভাঙছে লুৎফে আরা বেগমের বিলাপে, ‘বাবা কবে মুক্তি পাবি, কবে আসবি বুকে। তুই আসলেই যে আমার ঈদ।’

শোকের অতলে ডুবে থাকা এই নারী সোমালিয়ায় জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক আইনুল হকের মা। আইনুলসহ ২৩ নাবিক পড়ে রয়েছেন সোমালিয়ার উপকূলে, দস্যুদের কড়া পাহারায়। ছেলের এমন দুর্দিনে ঈদের সব খুশিই যেন বৃথা মা লুৎফে আরা বেগমের কাছে। নতুন শাড়ি পরা দূরে থাক, মা রাঁধেননি ঈদের কোনো খাবারও।

বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) বেলা ১২টার দিকে বাসায় গিয়ে বিষণ্ন মাকে পাওয়া গেল এভাবেই।

২০০১ সালে করোনার সময় স্বামীকে হারান লুৎফে আরা। এরপর থেকে দুই ছেলেই তার পুরো পৃথিবী। বড় ছেলে জাহাজি বলে এই বন্দর থেকে ওই বন্দরে ঘুরে বেড়ান। ছোট ছেলে মাইনুল হককে নিয়ে তাই এই বাসাতে থাকা হয় মায়ের।

আইনুল পাশে নেই, তাই ঈদের দিনেও মা আর ছোট ভাইয়ের মনের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শোকের শান্ত নদী। মায়ের দিন কাটছে ছেলের ফ্রেমে বাঁধা ছবি, নানা ক্রেস্ট ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আর অন্তহীন অপেক্ষায়- কবে আসবে ছেলের ফোন।

শোক কিছুটা প্রশমিত হতেই মা খুলে দিলেন ছেলেকে ঘিরে থাকা স্মৃতির জানালা। বললেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলে সবসময় চেষ্টা করে ঈদের দিন অন্তত আমার কাছে থাকতে। এইবারও সেই কথায় বলেছিল। গত ঈদে সে আমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছিল। আমার পছন্দ হয়েছে জানানোর পর সে কি যে খুশি হয়েছিল। এবার ছেলেও কাছে নেই, আমারও ঈদ নেই। আমরা তাই কেউ কিনিনি নতুন জামা। আসলে আমার দুটি ছেলে ছাড়া কেউ নেই। তার মধ্যে বড় ছেলেটা দস্যুদের হাতে বন্দী, বোঝেন মায়ের মনের অবস্থা।’

মায়ের চোখের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে দস্যুরা। বললেন, ‘আজ একমাস ধরে ছেলের দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। দস্যুরা প্রতি শুক্রবার শুধু কথা বলার সুযোগ দেয়। বাকি সময় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে রাখে ভারি অস্ত্র বহনকারী দস্যুরা। মাঝে মাঝে তারা ফাঁকা গোলাগুলিও করে। তখন পুরো জাহাজ নাকি কেঁপে ওঠে। ওই সময় নানা কাজে ব্যস্ত নাবিকেরা ভয়ে আৎকে ওঠেন। এসব শুনলে বলুন, ঘুম আসে?’

সর্বশেষ গত শুক্রবার ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল লুৎফে আরার। তখন আইনুল মাকে বলেছিলেন, ‘মা যতদিন না দস্যুরা জাহাজ থেকে নামছে, ততদিন আমাদের মনে শান্তি নেই। তারা ফাঁকা গোলাগুলি করে আমাদের ভয় দেখায়, যাতে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়।’

একমাস ধরে সোমালিয়ার উপকূলে নোঙর করে রাখা জাহাজটিতে এখন পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নাবিকদের তাই পানি পানে যেমন মিতব্যয়ী হতে হচ্ছে, তেমনি গোসল করতেও ভাবতে হচ্ছে। এখন তারা সপ্তাহে এক-দুবার গোসল করছেন। এক মাসের খাবার কমিয়ে কমিয়ে খেয়ে দুই মাস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছেন তারা। কিন্তু দুই মাসের মধ্যে যদি মুক্তি না মিলে তখন কি হবে সেই ভাবনায় নাবিকদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যরাও অসহায় হয়ে পড়েছেন।

আইনুলের ছোট ভাই মাইনুল সেই দুশ্চিন্তা থেকেই বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার ভাইসহ সব নাবিক যেন আমাদের কাছে ফিরে আসেন। সেই অপেক্ষায় প্রহর গুণছি আমরা। আগে ঈদের নামাজ শেষে বাসায় এসে বাবাকে সালাম করতাম, ভাইকে সালাম করতাম, কোলাকুলি করতাম। হঠাৎ বাবাকে হারানোর পর ভাই ছিল মা ও আমার শেষ ভরসা। সেই ভাইকে ছাড়া ঈদের কোনো আনন্দই নেই আমাদের মনে।

সরকারি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৬ সালে কবির গ্রুপের জাহাজে যোগ দেন আইনুল হক। ৯ বছরের জাহাজি জীবনে এবারই প্রথম জিম্মিদশার পড়েছেন আইনুল হক। জিম্মি হওয়ার পর এখন সপ্তাহে একবার বাড়িতে যোগাযোগের সুযোগ দেয় দস্যুরা। ছেলেও সুস্থ আছে জানিয়ে মাকে বারবার নির্ভার রাখার চেষ্টা করেন। তবু মায়ের মন মানছে না কিছুতেই।

জাহাজি জীবনে নাবিকদের ঈদ কোথায় কাটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়তো গভীর সাগরে চলন্ত জাহাজে কিংবা কোনো বন্দরে নোঙর করা জাহাজে। অবশ্য জিম্মি নাবিকেরা সবাই জাহাজে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, নতুন জামা পরে ছবিও তুলতে পেরেছেন।

২৩ নাবিকের শোকাতুর স্বজনদের কাছে হাসিমুখে তোলা ওই ছবিটাই এখন ভালো থাকার অনুপ্রেরণা!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *