সারাদেশ

‘পুনর্জন্ম’, ‘দ্য সাইলেন্স’, ‘আরারাত’-এর নির্বাহী প্রযোজকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ডেস্ক রিপোর্ট: আজিজ মোহাম্মদ ভাই, পরিচিত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী হিসেবে। তাকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য। নামের সঙ্গে ‘ভাই’ শব্দটি এই রহস্যময়তাকে আরো আলোচনায় নিয়ে এসেছে। পারিবারিক এ পদবী তিনি পেয়েছেন পিতা মোহাম্মদ ভাই এর কাছ থেকে। যুবক বয়স থেকেই প্লে-বয় হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ে, তৈরি করেন নানা বিতর্ক, আলোচনা। মুখরোচক অনেক গল্পও রয়েছে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে। অভিনেতা হত্যা ও নায়িকাদের নিয়ে কেলেঙ্কারিসহ চলচ্চিত্র জগতের সব অপরাধে যেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম। এছাড়াও রয়েছে মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ। তবে এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ না থাকায় সবসময় তিনি থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বর্তমানে থাইল্যান্ডে প্রবাসী আজিজ মোহাম্মদ ভাই। বেশ কিছুদিন আলোচনার বাইরে থাকলেও, বৃহস্পতিবার দীর্ঘ ২৫ বছর পর চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২ এর বিচারক। এবার আবারও আলোচনায় এসেছেন রহস্যময় এ ব্যক্তি।

প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা জানিয়েছিলেন, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাইয়ের একটি ঘটনা থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আজিজের আত্মীয় বান্টি ইসলাম, বান্টির বন্ধু আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সোহেলের বিরোধের শুরু। এর জেরেই ট্রাম্প ক্লাবের সামনে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে।

এর আগে ২০১৯ ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় আরেকবার আলোচনায় এসেছিলেন বহুল আলোচিত এই ব্যক্তি। ওই বছরের ২৮ অক্টোবর আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের মালিকানাধীন গুলশান-২-এর বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বাড়ির ছাদে মিনি বার ও ক্যাসিনোর সন্ধান পেয়েছিল। এছাড়া বিপুল পরিমাণে বিদেশি নামি-দামি ব্র্যান্ডের মদ, গাঁজা, সিসার উপকরণ এবং ক্যাসিনো সামগ্রীও জব্দ করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।

আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ আসামির যাবজ্জীবন কে এই আজিজ মোহাম্মাদ

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ঠিকুজি অনুসন্ধানে জানা যায়, শিয়া মুসলিম ও প্রিন্স করিম আগা খানের ইসমাইলি সম্প্রদায়ভুক্ত তারা। মোহাম্মদ ভাই পরিবার নিয়ে ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসেন। ধণাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় বসবাস শুরু করে।

পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত থাকলেও ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র জগতে ঢুকে পড়েন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। অলিম্পিক ব্যাটারি, বেলপেন অলিম্পিক ব্রেড, বিস্কুট ইত্যাদি ছিল তাদের পারিবারিক ব্যবসা।

আজিজ মোহম্মদ ভাই এরশাদ জামানায় লাইমলাইটে আসেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের কন্যা মুনমুন সেনকে ঢাকায় এনে। এক সময়ের টালিগঞ্জের হার্টথ্রব এ নায়িকা বহুবার ঢাকা আসেন।

কথিত আছে, সার্ক চেম্বারের আজীবন সদস্য আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা আছে উপমহাদেশের কুখ্যাত ডন দাউদ ইব্রাহিমের সাথে। তার পরামর্শে আজিজ মোহাম্মদ ঢুকে পড়েন সিনেমা ব্যবসায়।

পরিবারের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাই তার প্রোডাক্টশন হাউস এমবি ফিল্মস ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছে। শুরুতেই নায়িকাদের নিয়ে মুখরোচক খবরে আসে এই প্রযোজকের নাম। আশির দশকের বাংলা সিনেমার নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে আসে তার নাম। এই হত্যাকাণ্ডটি বনানীর কামাল আতার্তুক সড়কের তৎকালীন ট্রাম্পস ক্লাবে সংঘটিত হয়।

জনশ্রুতি আছে, জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহের মৃত্যুতেও তাঁর হাত রয়েছে। এ নিয়ে মোহাম্মদ আজিজ ভাইকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

জানা যায়, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে নারীঘটিত বিতর্কে জড়িয়ে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তবে তাকে মুক্ত করতে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের ধর্মীও নেতা প্রিন্স করিম আগা খান নিজেই বাংলাদেশে এসেছিলেন।

তবে এতসব অভিযোগে যার নামে, তার এসব বিষয়ে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ! দিব্যি থাইল্যান্ডে বসে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা। গুলশানের বাসা দেখাশুনা করেন তার ভাই-বোন।

নায়ক সোহেল চৌধুরীকে হত্যায় যেভাবে জড়িত আজিজ মোহাম্মাদ

সোহেল চৌধুরীকে হত্যার কারণ হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে যে সুপার ট্রাম্পস ক্লাবে আসামাজিক কার্যকলাপকে ঘিরেই মূলত আজিজ মোহাম্মদের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর গোলমাল হয় এবং পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ড ঘটে।

সেই দিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল ও তাঁর বন্ধুরা। গান বন্ধ করা নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর ক্ষেপে যান। তখন সোহেলের বন্ধু কালা নাসির আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গুলি করতে যান। এ সময় ক্লাবের বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এই ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ও আশীষের। বিরোধের শুরু এখান থেকেই।

তদন্ত কর্মকর্তার অভিযোগপত্রে বলেন, ‘বনানী জামে মসজিদের পাশে আবেদীন টাওয়ার। সেই টাওয়ারের আট তলায় সুপার ট্রাম্পস ক্লাব। এই ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ কুমার রায় চৌধুরী। সেই ক্লাবে আসামাজিক কার্যকলাপ, নাচ গান, মদ্য পান ও নারী দিয়ে অশ্লীল নাচ হতো। সেখানে আপত্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হতো।’

মামলার এক সাক্ষীর তথ্যমতে, খুন হওয়ার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝগড়া হয়। এ ছাড়া ট্রাম্প ক্লাবের বান্টি ইসলামের সঙ্গে সোহেলের দুই থেকে তিনবার ঝগড়া হয়। পরে তা মিটেও যায়। তবে আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতলের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। আশীষ চৌধুরীই সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। ভবিষ্যতে সোহেলকে ক্লাবে না আসার জন্য হুমকিও দেন।

এছাড়া সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তাঁর মা নূরজাহান বেগম আদালতকে জানিয়েছিলেন যে, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।

তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের দিন রাত দুইটায় সোহেল বাসায় ফেরেন। ক্লাবের সামনে জামে মসজিদ। পরে সোহেল আবার ক্লাবে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে দুটি গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

মামলার অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন সময় বান্টি ইসলাম ও আশীষ কুমার রায় চৌধুরীর সঙ্গে ট্রাম্পস ক্লাবে সোহেল চৌধুরীর বাকবিতণ্ডা হয়। সোহেল চৌধুরীর কারণে ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। তারা তখন সোহেল চৌধুরীকে ভয়ভীতি দেখান। ঘটনার দিন সোহেল চৌধুরী বনানীর সেই ট্রাম্পস ক্লাবে যেতে চান। তখন তাকে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আবার রাত ৩টায় ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে এলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা পেশাদার খুনি দিয়ে গুলি করে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করান।‘

২৩ বছর আগে ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের সামনে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে ডিবির তদন্তে উঠে আসে, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের জেরে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে খুন করা হয়।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *