সারাদেশ

সামাজিক যোগাযোগে প্রযুক্তির প্রভাব

ডেস্ক রিপোর্ট: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে নির্বাচন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনে জাল ভোট হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অনেকের প্রভাব ছিল সত্য, তবে মোটাদাগে বড়ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ-ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে। তবে বিব্রত হওয়ার প্রধান কারণ ভোটার উপস্থিতি। অনেক আলোচনার মধ্যেও এবারের নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার আসেননি।

ভোটগ্রহণের পরের দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইলেকট্রেনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে ২২ উপজেলায় এবং বাকি ১১৭ উপজেলায় হয়েছে ব্যালট পেপারে। ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেসব জায়গায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি ভোট পড়া এলাকা জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় মোট ভোটার ৯৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৭৩০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ওখানে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল মিয়া সরদার ৩০ হাজার ৩৯০ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা তাইফুল ইসলাম তালুকদার পান ২২ হাজার ৯০১ ভোট।

কম ভোট পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে বগুড়া সোনাতলায় ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩২ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২৮ হাজার ২৭৮ জন। ওখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটন ২০ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. জাকির হোসেন পান ৭ হাজার ৩৪৫ ভোট। মিনহাদুজ্জামান লিটন সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই। আওয়ামী লীগের এই এমপির ভাইই কেবল নির্বাচনে বিজয়ী হননি, জেলার অপর এক উপজেলা সারিয়াকান্দিতে বিজয়ী হয়েছেন তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল।

কম ভোট পড়া আরেক উপজেলা কুষ্টিয়া সদর। এখানে ৪ লাখ ২০ হাজার ৮৩৩ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৭৩ হাজার ২৯৯ জন ভোটার ভোট দেন। কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা ৬৭ হাজার ৪৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আবু আহাদ আল মামুন পেয়েছেন ৩ হাজার ৫৬৪ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া তথ্যের আরেক কম ভোট পড়া উপজেলা হচ্ছে চট্টগ্রামের মীরসরাই। ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭ জন ভোটারের ওই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পান ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, ভোট কম পড়ার কারণ হচ্ছে ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টি, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, শহর এলাকায় ছুটি থাকায় মানুষের বাড়ি চলে যাওয়া, এবং বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে অংশগ্রহণ না করা। এগুলোকে কারণ হিসেবে বললেও এটা যে স্রেফ অজুহাত দাঁড় করানো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন কমিশন ভোট কম পড়ার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে সেটাই কি আসল কারণ মূলত? ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টির ওপর মানুষের হাত নেই, কিন্তু বাকিগুলো নির্ভর করে মানুষের ওপরই। ইসি যেভাবে ঝড়বৃষ্টিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে সেটা মোটেও মূল কারণের মধ্যে পড়ে না, কারণ নির্বাচনের দিন কোথাও উল্লেখের মতো ঝড়বৃষ্টি হয়নি। ধান কাটার মৌসুমেও মানুষ আগে ভোট দিয়েছে, নির্বাচনের দিন প্রতিবারই ছুটি থাকে, এবং একদিনের এই ছুটিতে সচরাচর মানুষ গ্রামে চলে যায় না, বিশেষত ঠিক পরের দিন যেখানে আর কোন ছুটি নাই।

ইসি বলতে চাইছে, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব ছিল নির্বাচনে। এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? দলীয় প্রতীকে এবার নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরাও। যে তিন উপজেলায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বলছে ইসি, সেই তিন উপজেলার অন্তত দুই উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় দুই সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয় হয়েছেন বিজয়ী। তাহলে ইসি কি বলতে চায় নির্বাচন বর্জন করছে যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতারাই মূলত কেন্দ্রে ভোটার টানার মতো প্রার্থী?

ইসিও বলছে, নির্বাচনে ভোটার স্বল্পতার অন্যতম কারণ বিএনপির অংশ না নেওয়া। এটা এমনই অপ্রিয় সত্য যা অস্বীকারের উপায় নাই। হ্যাঁ, নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সকল বা বেশিরভাগ নেতাই বিজয়ী হয়ে যেতেন এমন না, তবে তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দলটির সমমনাদের কেউ অংশ নেয়নি। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের কেউও নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

দলের মধ্যকার কোন্দলকে প্রকাশ্য রূপ না দিতে আওয়ামী লীগ না হয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়নি; কিন্তু কোথায় জাতীয় পার্টি, কোথায় ১৪-দলের শরিক দলগুলো, কোথায় সেই ‘কিংস পার্টি’ যারা বিগত সময়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল? জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের স্বীকৃতি পেলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এই দলটির অস্তিত্ব যে আদতে নেই, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের অংশগ্রহণের ইতিহাস দেখলে সহজেই অনুমেয়। সরকারের অনুকম্পায় টিকে থাকা দলটি নেতাকর্মী সংকটে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেটা আরও একবার প্রমাণ করল।

প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনুমিতভাবে নির্বাচিতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অথচ নির্বাচনে নেই উল্লেখের মতো ভোটার উপস্থিতি। এবারের ভোট প্রদানের হার বিগত সংসদ নির্বাচনের ভোটের হারের চাইতেও কম। এর দ্বারা কি প্রমাণ হচ্ছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এই ব্যর্থতা কি তবে অনাস্থার বিমূর্ত প্রকাশ?

ধান কাটা মৌসুম, ঝড়বৃষ্টিসহ হালকা-ঢঙের যতই অজুহাত দাঁড় করাক না কেন নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সত্যি কি ভোটের হাওয়া বইছিল নির্দিষ্ট ওই ১৩৯ উপজেলাজুড়ে? বাস্তবতা বলছে, কখনই মনে হয়নি ভোট এসেছে। ভোটের প্রতি মানুষের এই অনাগ্রহ কী কারণে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে সেটা বের করা জরুরি।

যারা ভোট দিতে যায়নি, তাদের সকলেই যে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক, এমনটা ভাবার কারণ নাই। দেশে এত এত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তারাও কি ভোট দিতে গেছে? ভোটার উপস্থিতির হার বলছে, তারাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বসেছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি মূলত ‘ভোট দিয়ে কী হবে’ এমন একটা ধারণা কিংবা বিশ্বাস থেকেই।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং বেশিরভাগেরই অভিন্ন মতামত। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার-রাখার হুমকিসম। মানুষ দিন দিন ভোটে অনাগ্রহী হয়ে পড়ার কারণে ‘অন্ধকারের আততায়ীরাও’ যদি কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তবে এখান থেকে মুক্তির পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হতে থাকবে। নির্বাচন এককালে ছিল আমাদের অন্যতম এক উৎসব। ভোট ও প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলত সবখানে, কিন্তু এখন সে দিন হারিয়ে গেছে অনেকটাই।

ভোটবিমুখ মানুষকে ভোটে ফেরাতে হবে, দিতে হবে অভয়, গড়তে হবে সম-মর্যাদা ও সম-সুযোগের মাঠ। ভোট যে অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার; এই বোধের জাগরণ দরকার। দরকার কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ। আস্থার পরিবেশ না ফিরলে মানুষ ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বিমুখ হতেই থাকবে!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *