বিনোদন

কম ভোটের রেকর্ড: আস্থার সংকট না প্রতিকূল পরিবেশ?

ডেস্ক রিপোর্টঃ আশঙ্কাজনক হারে কমছে নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হার। গত দেড় দশকে উপস্থিতি নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। সাধারণ মানুষ ক্রমশ ভোটারবিমুখ হলেও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই কারও মধ্যে। সরকারদলীয় নেতারা ভোটের এই হারেই সন্তোষ প্রকাশ করছেন।

কেন্দ্রে ভোটার টানতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েও সুবিধা করতে পারছে আওয়ামী লীগ। ভোটের মাঠ জমাতে নামাতে পারেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতকে। যার ফলাফল আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়জয়কার এবং মানুষের ভোটকেন্দ্রবিমুখতা।

ইতিহাসের সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ছিল স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে। নির্বাচন এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের প্রভাবমুক্ত রাখতেও ছিল কেন্দ্রীয় নির্দেশনা। শেষ পর্যন্ত কোনো নির্দেশনাই কাজে আসেনি। খোদ প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতারা লাইভ করে দেখিয়েছেন ভোটারশূন্য কেন্দ্র। যদিও ভোটের পর নির্বাচন কমিশনের দাবি, ৩৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর দলটির সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘ভোটার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক।’

এতকিছুর পরও ভোটার উপস্থিতি কেন কম? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। রাজনৈতিক অঙ্গনও সরব। তবে কি নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা দায়ী, নাকি প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ?

ভোটার কম হওয়ার মূল কারণ হলো- একদিকে ধান কাটার সময়, অন্যদিকে প্রচণ্ড গরম। আবার অনেক জায়গায় প্রার্থীও একটা কারণ। আর কিছু জায়গায় তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করেছেন কিছু প্রার্থী, সেখানে ভোটার উপস্থিতিই হয়নি।- শাজাহান খান

ভোটার উপস্থিতি কমের রেকর্ড নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য অভিন্ন। তারা বলছেন, প্রতিকূল পরিবেশ ও কাজের ব্যস্ততায় মানুষ ভোটে আসেনি। তবে বিশিষ্টজনরা বলছেন, মূল কারণ আস্থার সংকট। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনসহ নির্বাচন আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা না থাকায় মানুষ ভোটে আসেনি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ নিয়ে চতুর্থবার উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। প্রথমবার ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এরপর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা ভোটে ৬১ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়ে গড়ে ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০২৪ সালে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হয় ৮ মে। সেখানেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। সারাদিন ভোটারের উপস্থিতি নেই এমন সচিত্র প্রতিবেদন এলেও দিনশেষে নির্বাচন কমিশন দাবি করে, ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশ। যদিও পরদিন ব্রিফিংয়ে তারা বলেছে, ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। উপজেলা নির্বাচনের ইতিহাসে এটি ভোট কমের দিক দিয়ে রেকর্ড।

জাতীয় নির্বাচনে ভোটের শতাংশ হিসাব করলেও স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। সে বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও ভোট পড়ে ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এরপর ২০০৮ থেকে টানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। সে বছরের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোটের হার ছিল ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেটা কমে ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ৮০ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। তবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের শতকরা হার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ দাবি করলেও তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন মহলে।

নির্বাচন কমিশন বলছে ৫ কারণ
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের এই চিত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশনও বিব্রত। তারাও বলছে, ভোটের এই হার কম। ৯ মে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নিজ কার্যালয়ে বিফ্রিংয়ে বলেন, মোটাদাগে পাঁচ কারণে ভোট কম পড়েছে- বৈরী আবহাওয়া, বিএনপির ভোটে অংশ না নেওয়া, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, ধান কাটার মৌসুম এবং সাধারণ ছুটি থাকায় শ্রমিকদের নিজ এলাকায় চলে যাওয়া।

তিনি বলেন, ধান কাটার মৌসুম চলছে। বিশেষত হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটায় সবাই ব্যস্ত এখন। সেসব এলাকার মাঠ প্রশাসন থেকে আমাদের আগেই জানানো হয়েছে, ধান কাটার মৌসুমের কারণে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। গত কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। আবার একটি বড় রাজনৈতিক দল (বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে) নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ভোট কম পড়েছে।

আরও পড়ুন:

উপজেলা নির্বাচন কি প্রভাবমুক্ত হলো?
স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও পরিবারতন্ত্র, দুর্বল হচ্ছে আওয়ামী লীগ
প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফর/বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে খুলছে অর্থনীতির নতুন দ্বার

এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, শহর এলাকায় ছুটি থাকলে শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। গাজীপুরে কিন্তু ভোট কম পড়েছে। শুধু ধান কাটা নয়, নানা কারণে ভোট কম পড়েছে। আরও কোনো কারণ থাকলে তা গবেষকরা বলতে পারেন।

প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশকে দায়ী করছে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোটার কম হওয়ার মূল কারণ হলো- একদিকে ধান কাটার সময়, অন্যদিকে প্রচণ্ড গরম। আবার অনেক জায়গায় প্রার্থীও একটা কারণ। আর কিছু জায়গায় তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করেছেন কিছু প্রার্থী, সেখানে ভোটার উপস্থিতই হয়নি।’

দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী জাগো নিউজকে বলেন, ‘৩৬ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। আমরা এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচনের পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তেমন আগ্রহ থাকে না মানুষের। এটাই বাস্তবতা। বিশেষ করে, দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, সেটাও বিষয়। ওপেন করে দেওয়া হয়েছে। আবার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাও ভোটার না আসার একটা কারণ।’

তিনি বলেন, ‘৪০-এর ওপর তাপমাত্রা ছিল গত কয়েকদিন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। উল্লেখ করার মতো সংঘাত হয়নি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’

সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ার কারণে হয়তো ভোটাররা স্থানীয় নির্বাচন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমাদের সময়ে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের ওপরেও ভোট পড়েছিল। তারপরেও আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমাদের সময়েও ধান কাটার মৌসুমে ভোট হয়েছে। তবে এত কম ভোটার উপস্থিতি ছিল না।- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে সব উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সেসব উপজেলায় ভালো ভোট কাস্ট হয়েছে। যে সব উপজেলায় একজন প্রার্থী অন্য সব প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন, বিজয় নিশ্চিত ছিল সেসব উপজেলায় ভোট কম পড়েছে। যেমন আমার নিজ নির্বাচনী এলাকার ক্ষেতলাল ও কালাই উপজেলায় যথাক্রমে ৭৩ শতাংশ ও ৬৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, কিন্তু আক্কেলপুর উপজেলায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ।’

‘একই নির্বাচনী এলাকা, পাশাপাশি তিনটি উপজেলা। রাজনৈতিক চরিত্র, সংস্কৃতি প্রায় অভিন্ন। কিন্তু প্রথম দুটি উপজেলায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, শেষ উপজেলাটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোটেও ছিল না। সবাই কনফার্ম ছিলেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সাহেব অনায়াসে বিজয়ী হবেন। ফলে গরমের মধ্যে কষ্ট করে খুব কম ভোটার ভোট কেন্দ্র গেছেন। উপরন্তু যে সব দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যত বাড়ে, ভোট দেওয়ার হার তত কমে- এটাও একটা কারণ।’

মূল কারণ আস্থার সংকট?
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এর মূল কারণ মানুষের আস্থাহীনতা। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না, ভোট দিতে পারবে কি না, ভোট দিলেও ভোট সঠিকভাবে গণনা হবে কি না- এসব ব্যাপারে তাদের মধ্যে আশঙ্কা ছিল। এর কারণ হলো- নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনের চরম পক্ষপাতদুষ্টতা। যার কারণে মানুষ তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাই, তারা ভোটকেন্দ্রে গেলো কি না গেলো, কিছু আসে যায় না। এজন্য ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থেকেছে বলে আমার বিশ্বাস। এটাই মূল কারণ।’

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ করতে হবে, তাদের জনকল্যাণে কাজ করতে হবে, তাদের পক্ষপাতমুক্ত আচরণ করতে হবে এবং সর্বোপরি আমাদের বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন সুজন সম্পাদক।

ভোটের হার কমের পেছনে কারণ জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ার কারণে হয়তো ভোটাররা স্থানীয় নির্বাচন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমাদের সময়ে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের ওপরেও ভোট পড়েছিল। তারপরেও আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমাদের সময়েও ধান কাটার মৌসুমে ভোট হয়েছে। তবে এত কম ভোটার উপস্থিতি ছিল না।’

প্রথম ধাপে ১৩৯টির মধ্যে ১১৯ উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া স্বতন্ত্র থেকে আটজন, বিএনপির পাঁচজন, জাতীয় পার্টির তিনজন, জাতীয় জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) দুজন, ইসলামী আন্দোলনের একজন ও আল ইসলামের একজন বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপি থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের এরই মধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গাজীপুর সদরে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা ইজাদুর রহমান মিলন জয়ী হন।

এসইউজে/এএসএ/এএসএম

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় জাগো নিউজ ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *