বিনোদন

ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প কি ছিল, যা জানালেন ড. বিরূপাক্ষ পাল

ডেস্ক রিপোর্টঃ এক লাফে ডলারের দাম ৭টা বাড়ানোর ফলে দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্ট উভয়সংকটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে দায়ী করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি পলিসি অস্থিরতার ফল। বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ উল্লেখ করেন, ‘এই পরিস্থিতি তখনই আসে যখন কেউ পলিসি সম্পর্কে দৃঢ় নয়, জ্ঞানলব্ধ, প্রজ্ঞাশীল কিংবা স্থিতপ্রজ্ঞ নয়’।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক এর অর্থনীতির অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল সাম্প্রতিক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি দুর্বলতা, সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, একাডেমিয়ার সঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিরোধ ছাড়াও সমকালীন অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়েও তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বার্তা২৪.কম: ডলারের দাম এক লাফে ৭টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে পুরো আর্থিক খাতেই বড় ধরণের সংকট তৈরি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এর বিকল্প আসলে আর কি ছিল?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: বিকল্প ছিল একটাই, সময় থাকতে কাজ করা। গেল সেপ্টেম্বরে (২০২৩) আমি লিখেছিলাম যে, টাকার মান কমলে জাতির মান কমে না। টাকার মানকে রিয়েল এক্সচেঞ্জ রেটের সঙ্গে এডজাস্ট করা। সেটা তো তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) কখনো করেনি। এক লাফে বাড়িয়ে এখন প্রশংসা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এটাকে বলছে ‘ক্রলিং পেগ’ কিন্তু আসলে এটা তো ক্রলিং নয়, তারা সবকিছু ফোর্সড করেন আন্ডার ভলান্টারি। মার্জারের মত, করছে ফোর্সড নাম দিচ্ছে ভলান্টারি। এককালীন ডলরের দাম বাড়িয়েছে শুধু আইএমএফ এর শর্তপূরণের জন্য। আইএমএফ এর ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ এর যে লিমিটটা ছিল তা তারা পূরণ করতে পারেনি, সুতরাং থার্ড গ্রেডে তারা কোয়ালিফাই করতে পারে। কোয়ালিফাই করতে পারেনি, যোগ্যতা না থাকায় বাধ্য হয়ে এখন এই কঠোর সিদ্ধান্তটা নিয়েছে এবং বলতে গেলে নিতে বাধ্য হয়েছে। এর বিকল্প ছিল একটাই-যা ইতিমধ্যে অর্থনীতিবিদরা যেটা বলেছেন সেটা অনুসরণ করা ।

বার্তা২৪.কম: পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: গভর্নর নিজে এই উভয়সংকটের জন্য দায়ী। উনি প্রথমে একবার গত জুলাই মাসে মনিটারি পলিসি দিয়ে বলেছেন, আমরা এক্সচেঞ্জ রেট বাজারভিত্তিক করব। ডিসেম্বরের দিকে সম্ভবত একটি অনুষ্ঠানের গিয়ে তিনি ভেতরের কথা বললেন যে এক্সচেঞ্জ রেটকে কোনভাবেই বাজারের উর্ধ্বে করা যাবে না। অর্থাৎ তাদের ভেতরের মধ্যে পলিসি ডিলেমা, নীতি অসংবেদনশীলতা। মুখে একটা বলা আর তা না করার শাস্তি হিসাবে এই এক লাফে ৭ টাকা বাড়াতে হল। জানা মতে, স্বাধীনতার পরে একবার এমন হয়েছিল বিশেষ একটি অবস্থায় ১৯৭৫ সালের দিকে। তাছাড়া এমন এক লাফে এভাবে ৭ টাকা আর বাড়েনি। যেখানে ৪ আনা, ৮ আনা করে বাড়ানো হয়-সেখানে ৭ টাকা বাড়ানোর কোন কারণ নেই। দ্বিতীয় আরও একটি হিপোক্রেসি তারা করেছেন, কিছুদিন আগে ডলারকে ১১০টাকা থেকে কমিয়ে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা করেছে, এটা এক ধরণের হিপোক্রেসি। এর মানেটা কি বোঝাতে চাচ্ছেন? মানেটা কি টাকা ডলারের সঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠছে! এটা ফেইক সিগন্যাল। আসলে এই ফেইক সিগন্যাল দেওয়ার কোন দরকার ছিল না । তখনও বাজারে ১২০ টাকা দিয়ে ডলার কেনা লাগতো। এটা পলিসি হিপোক্রেসি। সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন যেটি বলেছেন, আমি সেটাকে আশ্রয় করে বলছি, উনি তো অনেক কথাই বলেছেন, যেটা কোন সাবেক গভর্নর বলেন না। যার সারমর্ম হচ্ছে কিছুসংখ্যক আমদানিকারককে খুশি করতে ডলারকে কৃত্রিমভাবে অবমূল্যায়ন করে রাখা হয়েছে, টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছে। এই আমদানিকারকদের ফোর্সটা এখানে স্ট্রং, এটা বুঝতে পারছি। তারা জিনিসপত্র আমদনি করবে এবং এই গোষ্ঠীটা এক্সচেঞ্জ রেটটা বাজারের সঙ্গে আসতে দিচ্ছে না। তারা বিগত দীর্ঘসময় দেয়নি, আসতে আসতে একটা বিল্ডিংয়ের মধ্যে চাপ নিতে নিতে কোভিডের সময় ফেটে পড়ে। এর জন্য কোভিডেরও দোষ নেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেরও দোষ নয়। এগুলো খামোখা অজুহাত।

বার্তা২৪.কম: এটাকে কি তাহলে নীতিগত ব্যর্থতা বলা যায়?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: হ্যা অবশ্যই। তারা জ্ঞানভিত্তিক পলিসি নির্ধারণ করে না। তারা কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে কাজ করে। অর্থনীতিবিদদের কথা তারা কোনভাবেই শোনে না। আরেকটা মকারি তারা করেছেন, সমস্ত খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেকে নিয়ে উপদেশ শুনেছে, একটা উপদেশও তারা রাখেনি। উনি (গভর্নর) আমদানি করেছেন ‘স্মার্ট’, এটা আসলে একটা ভুয়া জিনিস। স্মার্ট মানে কি আমাদের ক্ষমতাকে অন্যের হাতে দিয়ে দেওয়া? পৃথিবীতে এমন উদ্ভট কাজ কেউ করে না। শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। এখন যে মার্জার নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি মার্জার নিয়ে পড়াশোনা করেছি। এ নিয়ে আমিও লিখেছি, এটা হল ‘সামন্তবাদী বিয়ের’ মতন ব্যাপার। জোর করে বিয়ে দেওয়ার মতো। অলরেডি মার্জার থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরেকটা জিনিস তারা শুরু করল, ক্রলিং পেগ। এটি যেভাবে শুরু হওয়ার কথা, সেটা কিছুই না। চাপে পড়ে করে এখন বলছে আমি করে ফেলেছি। ঘটনাটি বোঝাতে একটি গল্প বলা যেতে পারে, জাহাজের কিনারায় দাঁড়িয়ে একটা লোক দৃশ্য দেখছিল। হঠাৎ হইচই হচ্ছে, কেউ একজন পড়ে গেছে নীচে। হইচই, কান্নাকাটি। কিছুক্ষণ পর আরেকটা মানুষ ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করল। তারপর ওই মানুষকে যখন মেডেল দিচ্ছে, তখন তিনি বললেন, ‘আমি তো আসলে মেডেল নেওয়ার যোগ্য নই। আমি দেখলাম কেউ আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে, এর জন্য আমি মহান হয়ে গেছি।’ এখন ধাক্কাটি মেরেছে আইএমএফ, আর এক ধাক্কায় ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বলছে ‘ক্রলিং পেগ’। ‘জাম্পিং পেগ’ কখনো ক্রলিং প্যাক হয় না। আরেকটা ভুয়া নামের আশ্রয় তারা নিয়েছেন। কেন করলেন? কারণ তারা কমিট করেছিলেন এটা তারা করবেন। এত কথা, কবিরাজি, টুটকা চিকিৎসার প্রয়োজন কি? ঝাড়ফুঁক দেওয়ার প্রয়োজন কি পড়ল? যেটা মানা উচিত সেটা মেনে চললেই তো হয়। তারা ভুয়া জিনিস আমদানি করে চমক লাগায়। ‘স্মার্ট’, ‘সোয়াপ’, ‘এক্সচেঞ্জ রেট’ ইত্যাদি নানাকিছু। এজন্যই আমি বলছি, বর্তমান পরিস্থিতিটা হল পলিসি অস্থিরতা। এটা কখন আসে যখন কেউ পলিসি সম্পর্কে দৃঢ় নয়, জ্ঞানলব্ধ-প্রজ্ঞাশীল বা স্থিতপ্রজ্ঞ নয়, এমন অবস্থাতেই এই অস্থিরতাগুলো ভিতরে আসতে থাকে। হঠাৎ করেই কিছু টার্ম নিয়ে আসেন, যা আমদানির কোন দরকার ছিল না।

বার্তা২৪.কম: এই পলিসি অস্থিরতা কিংবা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কি কি প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিতে…

ড. বিরূপাক্ষ পাল: প্রভাবটাই বড় কথা নয়, যদি করতেই হল, তবে এত দেরি করে কেন? লাফ দিয়ে বাড়ানোর প্রয়োজন কেন পড়ল? কোন শিক্ষার্থী পড়াশোনা না করলে পরীক্ষার আগে সারারাত পড়লে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়-বিষয়টি তেমনি। ইট ইজ মুভিং টোয়ার্ড দ্য কামিং স্টিল এওেয়ে ফর্ম মার্কেট…‘যদি সেই নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’…মাঝে আবার ডলারের বিপরীতে টাকাকে শক্তিশালী করে দেয়। ব্যর্থতার জন্য হোচট খেয়ে এখন নানা অজুহাত নিতে হচ্ছে। মূল কথা আইএমএফ এর চাপে এটা করেছে। কোন দিন যেটা করেনি। বিকল্পটা ছিল ধীরে ধীরে জিনিসটাকে এডজাস্ট করা। মার্কেটে কি হয়েছে দেখুন, মানি চেঞ্জাররা বলছে, ‘ডলার নাই’ আসলে তো সব লুকিয়ে রেখেছে। তারা বলছে-‘আমাদের কাছে কোন ডিরকেশন নেই আমরা কত করে বিক্রি করব?’ এই ক্রলিং পেগের মার্জিন কত হবে তাও কি বলেছে? মার্জিনটা আবার কেন টানা হচ্ছে? যদি বাজারের ভিত্তিতে করা হয় তাহলে মার্জিন নিয়ে কথার প্রয়োজন কি? রেট যেটা আছে সেটা ঘোষণা করুন ‘অফিসিয়াল রেট’। বাজারের ওপরই একটা প্যানিক ক্রিয়েট করে দিয়েছে হঠাৎ করে।

বার্তা২৪.কম: আর্থিক সংকটের মাঝেই নতুন করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে সংকট সৃষ্টি হল সেটা কি তবে অদূরদর্শিতার ফল?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: অদূরদর্শিতা তো বটেই। ‘ক্রলিং পেগ’ বলে তারা আবার ক্রেডিট নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটা ক্রলিং হয় নাকি? ক্রলিং করার কথা ছিল ১০-১৫টা দেশের ট্রেডিং পার্টনারের এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে একটা কম্পোজিট রেট বের করে তা নিয়ে অংক কষে বা গবেষণার মাধ্যমে নিরূপণ করা।

বার্তা২৪.কম: কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়াকে কিভাবে দেখেন?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর যদি মুখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়? বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পৃথিবীর উল্টো পথে চলছেন। যেমন ইন্টারেস্ট রিট নিয়ে বেশ কিছু দিন দ্যোদুল্যমান থেকে তারপর শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক সংবাদ প্রদানের বড় উৎস। সচিবালয়ে তো রাখঢাক করে কিন্তু সেন্ট্রাল ব্যাংক পৃথিবীজুড়েই সংবাদের উৎস। সেই উৎস যদি রুদ্ধ করে দেয় তাহলে দৈনিক পত্রিকাতেই বা কি পড়ব আমরা?

বার্তা২৪.কম: একাডেমিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারকদের যদি এত দুরত্ব থাকে তাহলে দেশের অগ্রযাত্রায় কি ধরণের প্রভাব পড়ে?

ড. বিরূপাক্ষ পাল: আজকাল একাডেমিয়া লাগে না। আমরা অর্থনীতিবিদরা ফোরকাস্ট করি পসিবিলিটি দেখে..অন্যদের তা লাগে না। তারা যখন স্থির করেন কাজটি করবেন, ব্যস্হ-য়ে গেল! ড. ফরাসউদ্দিনও বললেন, ‘রিটায়ার্ড আমলাদের পলিটিক্সে আসা উচিত নয়। এতে কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যায় সার্ভিসে।’ কিন্তু এখন প্রবণতাটি হয়ে গেছে, সার্ভিসে বসেই চিন্তা করে কিভাবে রাজনীতিতে আসা যাবে…। নিয়োগেও যোগ্যতা হচ্ছে আনুগত্য। কটু কথা বলা লোকও যে অনেক বেশি উপকার করতে পারেন সেটা বোঝা হয় না। গেল আড়াই বছরে অর্থনীতিতে যে দূর্যোগটা হচ্ছে সেটা এই সকল অনুগত মানুষদের সৃষ্ট। এটা কোভিডেরও দোষ নয়, যুদ্ধেরও দোষ নয়। সংকটগুলো নীতি বিভ্রান্তির জন্য সৃষ্টি।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪ এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *