আন্তর্জাতিক

পাউলোনিয়া এবং এক রাজকুমারীর গল্প

ডেস্ক রিপোর্ট: ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের প্যারিসের ৬ নম্বর মহল্লায়! গত ৮০ বছর ধরে ডালপালা মেলে ঠাঁয় একইস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়া মাথার বৃক্ষটি নেই। প্রতিবছর বসন্তের শুরুতেই সাদা, নীল ও বেগুনি, তিনটি রং মিলে ঘণ্টির আকারের ফুলে ফুলে ছেয়ে যেতো গাছটির সব ডালপালা।

গাছটি নেই! পৌর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কেটে ফেলা হয়েছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে, ধারালো বৈদ্যুতিক করাতে খণ্ড, খণ্ড করে কেটে ফেলা হয়েছে গাছটিকে।

আট দশকে এ গাছটি অনেক ঘটনার সাক্ষী। অনেক ইতিহাস বুকে নিয়ে সে নিজেই এখন ইতিহাস হয়ে গেল।

খবরটি ছড়িয়ে পড়লো মহল্লায়। একে একে সেখানে জড় হলেন বিষণ্ণ, বিচলিত এলাকাবাসী।

‘অন্যায়, বড় অবিচার’- ২৫ বছরের তরুণী পলিনের অস্ফুট আর্তি!

ছোটবেলায় এক কবোষ্ণ প্রভাতে বাবার হাত ধরে এ গাছটির নিচে দাঁড়িয়েছিল সে। পরম মমতায় গাছটি ছুঁয়ে তার প্রিয় বাবা বলেছিলেন, ‘পাউলোনিয়া’। রাশিয়ার প্রথম জার, পলের কন্যা রাজকুমারী আন্না পাভলোনার নামে এ গাছটির নামকরণ করা হয়েছে।

পাউলোনিয়া ফুল, ছবি- সংগৃহীত

আজ বাবা বেঁচে নেই! পলিনের মন খারাপ হলেই পাউলোনিয়ার শীতল ছায়াতে এসে দাঁড়াতো। যেন তার বাবার ছায়া! অনেক মায়ার ছায়া! মানুষের নিষ্ঠুরতায় তাও হারিয়ে গেল! সকালের শিশিরের মতো পলিনের চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে।

বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী উচ্চকিত স্লোগানে উত্তাল হলো। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সংবাদকর্মীরা।

মেয়রের বরাবরে লিখিত কড়া প্রতিবাদ জানালেন তারা। বিব্রত পৌরপ্রধান এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা এড়াতে পারলেন না তিনি।

তিনি জানান যে, গাছটি ভেতরে ফাঁপা হয়ে গিয়েছিল। যেকোনো সময়ে এমনিতেই ভেঙে পড়তে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে গাছটি কেটে ফেলতে হয়েছে।

পাউলোনিয়াসি পরিবারের পাউলোনিয়ার বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। তবে Paulownia tomenteux প্রজাতিটি বেশি দেখা যায়। ৭০ থেকে একশ বছর অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারে।

পাউলোনিয়া, স্থান- তুলুজ, ফ্রান্স, ছবি সৌজন্যে- ড. মইনুল হাসান

১৮৩৪ সালে অপূর্ব সুন্দর ফুলের এই গাছটি প্রথম জাপান থেকে প্যারিসে পৌঁছে। প্রথম পাউলোনিয়া ১৯৫৬ সাল অর্থাৎ ১শ ২২ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল। পৌর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে প্যারিসে এই প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, প্রায় ১ হাজার ৩শটি।

ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে পাউলোনিয়া বিরল নয়। শুধু ফুলের জন্যই নয়, এ উদ্ভিদটি অনেক কারণে সমাদৃত। অতি দ্রুত বর্ধনশীল এ উদ্ভিদটি সাধারণ উদ্ভিদ থেকে চারগুণ বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। তেমনি চারগুণ বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে। বাতাস নির্মল করে।

খুব উন্নতমানের কাঠের জন্য এর কদর কম নয়! তাছাড়া আমিষসমৃদ্ধ গাছের পাতা উৎকৃষ্ট পশুখাদ্য। অনুর্বর জমিতে জন্মাতে সক্ষম এবং ভূমির ক্ষয় রোধে কার্যকর।

পাউলোনিয়া ফুলের নেকটার মৌমাছিদের খুব পছন্দ। পাতার মতোই, মধুর আছে অনেক ঔষধি গুণ। মিষ্টি ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত সৌগন্ধিকরা এর ফুলের খুব ভক্ত।

এই উদ্ভিদটির আরেকটি নাম ‘রাজকুমারী’। পলিন নিজেও ছিলেন তার বাবার কাছে আদরের এক রাজকুমারী।

ড. মইনুল হাসান: অনুজীব বিজ্ঞানী, প্যারিস, ফ্রান্স

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *