সারাদেশ

থার্ড টার্মিনাল: ৩০০০ কোটি টাকার ব্যবসায় চোখ বিদেশিদের  

ডেস্ক রিপোর্ট: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ১ ও টার্মিনাল-২ এর তুলনায় নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি। পুরোনো দুটি টার্মিনালের আয়তন এক লাখ বর্গমিটার, আর তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। গত বছরের ডিসেম্বরে এর আংশিক উদ্বোধন হলেও যাত্রীরা এর সব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন আগামী বছরের ডিসেম্বরে। সে লক্ষ্যে এগোচ্ছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

আগের দুটি টার্মিনাল দিয়ে বছরে ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়া সম্ভব। আর নতুন টার্মিনাল দিয়ে এক কোটি ৬০ লাখ যাত্রীকে সেবা প্রদান করা যাবে।

তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের পর থেকেই আলোচনায় আসছে কে পাচ্ছে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ। কারণ সরকার যাত্রীদের জন্য অবকাঠামো তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু যদি যাত্রী সেবা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে এই টার্মিনাল নিয়ে যাত্রীদের পুরাতন টার্মিনালের মতো দুর্ভোগে পড়তে হবে।

পরিসংখ্যান বলছে, পুরোনো দুটি টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং থেকে বিমান বছরে ১৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। আর তৃতীয় টার্মিনাল যেহেতু এর চেয়ে দ্বিগুনের বেশি বড় তাই এখান থেকে কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব। আর তাই তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ পেতে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি দৌড়ঝাঁপ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বড় একটি ব্যবসার সুযোগ সবাই নিতে চাইবে। আর এজন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব কারা পাবে এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আগেই জানিয়েছে – এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জাপান। এখন এই সেবা খাতে শেষ পর্যন্ত জাপান কাকে সঙ্গে নেবে তা পর্যবেক্ষণ করছে সবাই।

এই কাজে সবার আগে আলোচনায় আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নাম। কারণ এই খাতে বিমানের দীর্ঘদিনের একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং খাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একমাত্র সেবাদাতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিমান।

তবে বিমান ছাড়া আরও অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান এই কাজ পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে। জাপানের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কোন সংস্থা এই কাজ পায় তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

বিমানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ জাপান করবে। এক্ষেত্রে বিমানকে নেয়া হলে দেশীয় স্বার্থ রক্ষা হবে। আমরা তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিতে বিমানকে সেভাবে প্রস্তুত করেছি। 

অন্যদিকে বেবিচকের চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলছেন, জাপানই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেবে। বিমানের নামও আলোচনায় রয়েছে। বিমানের পক্ষে আমরাও কথা বলেছি।

তবে যে পরিমান যাত্রী ও উড়োজাহাজ তৃতীয় টার্মিনাল দিয়ে চলাচল করবে সেই সক্ষমতা যাচাই করছে জাপান। বিমানের সক্ষমতাও বেড়েছে। এরে মধ্যে জাপান যাদের যোগ্য বলে মনে করবে তাদের নির্বাচন করবে।

তবে কেউ কেউ বলছেন, এক্ষেত্রে দুই থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বিভাগে নিয়োগ দিলে ভালো হবে। এতে করে সেবার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি এটি প্রতিযোগিতামূলক হবে। এতে করে যাত্রীরাও ভালো সেবা পাবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বড় টার্মিনাল সামলানো জাপানের একার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা অংশীদার খুঁজবেন। এরই মধ্যে তুরস্কের সেলিবি, যুক্তরাজ্যের মেঞ্জিস, সুইজারল্যান্ডের সুইসপোর্টসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি এই কাজ পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার বিমানমন্ত্রী ও বেবিচকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতে তার দেশের মেঞ্জিসের কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তুরস্কের সেলেবী কাজ পেতে তৎপর রয়েছে। সুইসপোর্টও এই দৌড়ে রয়েছে। তারাও বেবিচকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত প্রেজেন্টেশন দেবে।  

জাপান পিপিপি পদ্ধতিতেই তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় আগ্রহী। এজন্য আইএফসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান সমীক্ষাও চালিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বিমানের সেবা নিয়ে যেসব অভিযোগ

দেশের প্রধান প্রবেশদ্বার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। যাত্রীদের অভিযোগ বিমানবন্দরকেন্দ্রিক যতগুলো বিভাগ রয়েছে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা। অথচ বিমান কখনোই এই খাতে সেবার মনোবৃত্তি তৈরি করতে পারেনি। দশকের পর দশক ধরে এই খাতের সেবা নিয়ে অজস্ত্র অভিযোগ থাকলেও কখনোই তারা তা সমাধানে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

সময়মতো সেবা না পাওয়ার কারণে অনেক সময় বিদেশি এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট ছাড়তে বিলম্ব হওয়ার ঘটনাও কম নয়। বিভিন্ন সময়ে বিদেশিরা এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং পেতে জোরদার লবিং করলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের আশীর্বাদ পেয়ে বিমানই থেকে গেছে। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেই বিভিন্ন সময়ে সরকার এই সমর্থন দিলেও এবার আর সেই অবস্থানে নেই। সরকার চাইছে বিমান থাকুক। তবে যেহেতু জাইকার সহায়তায় থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করেছে জাপান, তাই অংশীদারত্বের মাধ্যমে যাতে বিমানও কাজ করতে পারে সে বিষয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বিমান বলছে, তৃতীয় টার্মিনালের কাজ পেতে তার এক হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছে। গেল এক বছরে এক হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বিভাগে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু যন্ত্রপাতি কিনলেই চলবে না, বিমানের কাজে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব রয়েছ। সেই সাথে কর্মীদের প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। সর্বোপরি যেটি দরকার তা হলো সেবা দেয়ার মানসিকতা। এই মানসিকতায় পরিবর্তন না হলে সেবার মানে গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না। 

কেন বিদেশিরা চায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই খাত থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব বিমান বছরে ১৫০০ কোটি টাকা আয় করে থাকে। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের আয়ের একটি বড় খাত গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং। স্বাধীনতার পর থেকে বিমান এই খাতে একক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। আসায় এই খাতটির ওপর বরাবরই বিদেশিদের নজর ছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা এদেশীয় ব্যবসায়িক পার্টনারের মাধ্যমে এই ব্যবসা পেতে জোর চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে অন্যতম মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ডানাটা, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সুইসপোর্ট ও তুরস্কের সেলিবি।

তবে বিমান শুধু শাহজালালই নয়, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুরু থেকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে আসছে। বছরের পর বছর ধরে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের যেমন ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি শাহজালাল থেকে পরিচালিত বিদেশি ৩০টি এয়ারলাইন্সেরও নানা অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিকমানের সেবা দিতে বিমান ব্যর্থ বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া সময়মতো লাগেজ ডেলিভারি দিতে ব্যর্থতার দায়ও এসে পড়তো এসব বিদেশি এয়ারলাইন্সের ওপর। লাগেজ চুরি, সুটকেস ভেঙে যাওয়াসহ এসব অভিযোগের বিষয়ে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বারবার বিমানের দিকে আঙুল তুলেছে। তাদের অভিযোগ, এসবের জন্য দায়ি বিমান। অথচ তাদেরকে এজন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

কি বলছে বিমান     

তৃতীয় টার্মিনালের কাজ পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম বলেন, তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার সক্ষমতা, দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বিমানের রয়েছে। আগামীতে আরো যন্ত্রাংশ কেনা হবে এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। 

‘বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কর্মীরা অত্যন্ত দক্ষ। তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সনদ রয়েছে। বিদেশেও বিমানের কর্মীদের অনেক চাহিদা রয়েছে।

তিনি বলেন, পুরাতন টার্মিনালের লাগেজ বেল্টের পরিমান সীমিত থাকার কারণে সেবার দিতে সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তবে নতুন টার্মিনালে লাগেজ বেল্টের সংখ্যা অনেক বেশি থাকবে, তাই লাগেজ পেতে যাত্রীদেরকে আর লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না। এছাড়া পুরাতন টার্মিনালে চেক ইন কাউন্টারের সংখ্যাও কম। এতে যাত্রীদের চাপ তৈরি হয়। নতুন টার্মিনালে এই সমস্যা থাকবে না। নতুন যন্ত্রাংশ  কেনা ও নতুন কর্মী নিয়োগের ফলে বিমানের সক্ষমতা বেড়েছে। তাই বিমানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়।

কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে না নতুন এয়ারলাইন্স। ২০৩৫ এ দুই কোটি ৩৫ লাখ যাত্রী হ্যান্ডেল করবে শাহজালাল। বিমান তৃতীয় টার্মিনালের কাজ না পেলে বড় ব্যবসা হারাবে।

তিনি বলেন, এটি দেশের জন্য কিংবা দেশের স্বার্থের জন্য ভালো হবে না। তবে বিমানকে সেবার মান বাড়াতে হবে। নতুবা এই ব্যবসায় রাষ্ট্রায়ত্ব এয়ারলাইন্সের একক ব্যবসা হারাতে হবে।

তিনি এও মনে করেন, ডিসেম্বরে এই যদি চালু করে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। আর যেহেতু এখানে ভালো ব্যবসার সুযোগ রয়েছে তাই বিদেশিরা আকৃষ্ট হতে পারে।   

যাত্রী বান্ধব সেবা দিতে থাকতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা। তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় প্রয়োজন হবে প্রায় ৬ হাজার জনবল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু অত্যাধুনিক মেশিন থাকলেই হবে না, মেশিনের পেছনের যে লোকগুলো কাজ করবেন তাদের দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমবে না।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রীরা সুপরিসর জায়গা ও ভালো পরিবেশ পাবেন। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরের সেবায় নিয়োজিত থাকবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, একই সাথে বাড়াতে হবে সেবার মান।  

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *