সারাদেশ

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি

ডেস্ক রিপোর্ট: বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার প্রখরতা বাড়ছে। এবছর বাংলাদেশজুড়ে দুঃসহ তাপপ্রবাহ বিরাজ করায় এর প্রভাব পড়েছে অনেক গুণ বেশি। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে প্রকৃতির এত বৈরী আচরণ আর কখনও চোখে পড়েনি বলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরা অভিমত পোষণ করেছেন। গরমের কারণে এবছর প্রথম হিট এলার্ট জারি করার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও সীমিত আকারে ক্লাস নেয়া ও ঢাবি, জাবি-তে অনলাইনে পাঠদানের আদেশ জারি করা হয়েছে। ছয়দিন পর দ্বিতীয়বার পুনরায় হিট এলার্ট জারি হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশের নানা স্থানে হিট স্ট্রোকে গৃহবধূ, কৃষক, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ট্রাফিক পুলিশ, বৃদ্ধসহ ষোল জনের প্রাণহানির খবর পওয়া গেছে।

এ অসহনীয় তাপমাত্রায় শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইউনিসেফ বলেছে, ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে শিশুরা। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সী শিশুদের জন্য। হিট স্ট্রোক ও পানি শূন্যজনিত ডায়রিয়ার মতো, উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে সৃষ্ট অসুস্থতায় এই বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।’

শিশু ও বয়স্করা সূর্যের অতি তাপজনিত কারণে বেশি বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় করছে। বড় বড় শহরের অভিজাত এলাকায় বিদ্দ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও বস্তি ও গ্রামের মানুষ বিদ্দ্যুৎহীনতায় হাঁসফাস করছেন। অতি খরার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫-৩৮ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি জমিতে সেচের পাম্পে পনি উঠছে না। গৃহস্থলির কাজে নিত্য ব্যবহার্য্য হস্তচালিত নলকূপে পানি না উঠায় সেগুলো বন্ধ হয়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও বরেন্দ্র এলাকার অনেক জায়গায়। গড়াই, তিস্তা প্রভৃতি নদীতে প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় ডালিয়া, জিকে ইত্যাদি সেচপ্রকল্পে বোরো ধানের জমিতে সেচ দেয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ঝিনাইদহে পাম্প ও প্রকল্পের ক্যানেলে পানি না থাকায় সেচকাজ বন্ধ রয়েছে। শহর এলাকার অগভীর নলকূপে পানি উঠানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহুতল ভবনের ছাদের মধ্যে শখের ছাদবাগান বাঁচানো নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অনেক সৌখিন ছাদবাগানী।

অনেক জেলায় বোরোধান, ভুট্টা, আখ, শাক-সবজির ক্ষেত মরে যাচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রস না থাকায় কাউন ও পাটের চারা গজাচ্ছে না। সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত তাপে নতুন বোরা ধানের শীষ বেরানোর পর চিটা হয়ে যাচ্ছে।

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিদের এবার মাথায় হাত পড়েছে। ব্যাপক হারে আমের মুকুল বের হলেও ফেব্রুয়ারিতে একদিনের টানা বৃষ্টির পর প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ চরম ভ্যাপসা গরমে ৯০ ভাগ আম ও ৭০ ভাগ লিচুর মুকুল ঝরে গছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকার হাজার হাজার আমগাছের ৯৯ ভাগ আম ঝড়ে গেছে। সেগুলোতে তাকালে শুধু মুকুলের শুকনো খালি ডান্ডাটি চোখে পড়ছে! ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা এবার টিফিনের সময় ঘটা করে আম পেড়ে খেতে পারবে না বলে হতাশা প্রকাশ করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় এরপরও যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেগুলো বৈশাখের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্রমাগত ঝরে পড়ছে। তাই এ বছর ফলন বিপর্যয়ে আমচাষি ও আমবাগান লিজ নেয়া ব্যবসায়ীরা দিশেহারা, তাদের গভীর দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

আম ছাড়াও সব ধরনের কৃষি উৎপাদনে প্রায় সারা দেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবারের গ্রীষ্মকালীন ফল-ফসলের ফলন বিপর্যয়ে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের আরো একধাপ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালকসহ সব খেটে খওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে বহুগুণ।

গরমে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পিচ গলে গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গা ও রাজধানীর রাজপথে কার্পেটিং গলে উঁচু-নিচু হয়ে গাড়ির চাকায় তরল বিটুমিন আটকানোর সংবাদ হয়েছে। কর্মচঞ্চল দিন কর্মস্থবির হয়েছে।

এমনকি দিনের বেলা সূর্যের খরতাপে হিটস্ট্রোকের ভয়ে মাঠের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় পাকা দান রক্ষার জন্য কৃষররা রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ধান কাটার কাজ করছেন। যা অনেকটাই অস্বাভাবিক। গরমের কারণে রাতের বেলাতেও মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বের হতে সাহস করছেন না।

এবছর প্রকৃতির এমন বৈরী আচরণকে কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবুও নিরুপায় হয়ে প্রকৃতির এই চরম সিদ্ধান্তকে মানতে মানুষ বাধ্য হচ্ছে।

এরপরও আবহাওয়া অফিস থেকে এখনও বৃষ্টি হবার কোন সুখবর নেই। এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন জেলার খরাক্রান্ত মানুষ বৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ইসতিসকার নামাজ আদায় করে বৃষ্টিভিক্ষা করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। এটাতো গেল আমাদের দেশের বৃষ্টিহীন পরিস্থিতির কথা।

এর মাঝে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হঠাৎ করে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে ফ্লাশ-ফ্লাড ঘটেছে। মরুভূমিতে অবস্থিত উভয় দেশে শতাধিক প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জেনে কেমন জানি অদ্ভুত এক সময়ের কথা মনে হচ্ছে। প্রাচীনকালে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অবাধ্য ও পাপিষ্ঠ জনবসতিতে অতিখরা ও অতিবৃষ্টি বা মহাপ্লাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শাস্তি নাজিল হবার ঘটনা আমরা জানি। দেশে দেশে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ সে ব্যাপারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। এর পরেও কিছু মানুষ বিভিন্ন কারণে সেসব বাণী ভুলে গিয়ে চরম অবাধ্য ও বেপরোয়া জীবন যাপন করে। বিশেষ করে মানুষ আল্লাহ নির্দেশিত সীমা লঙ্ঘণ করে প্রকৃতির ওপর যখন অযাচিতভাবে নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ চালায় প্রকৃতিও তখন মানুষের উপর নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে দেরি করে না।

তাই সৌদি আরব, ওমান বা মরুর দেশের বিলাসী শহর দুবাইয়ে বন্যা, হিমালয়ের পাদদেশে সিকিমে ফ্লাশফ্লাড, রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, জাপান প্রভৃতিতে হঠাৎ বন্যা, সুনামী ইত্যাদি একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কথা হলো, দেশে দেশে এসব দুর্যোগ কেন এত ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে? বাংলাদেশে নাতিশীতষ্ণোমন্ডলে অবস্থিত হবার ফলে কেন এত বেশি তাপমাত্রাবৃদ্ধি সমস্যায় পড়ছে? কেন এমন দুর্যোগ হচ্ছে? জলবায়ুর অভিঘাত কেন এত ভয়ংকর রুপে আবির্ভূত হয়ে মানুষের জানমাল কেড়ে নিতে উদ্যত হচ্ছে?

এসব প্রশ্নে উত্তর মানুষের কাছে জানা। তদুপরি মানুষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে প্রকৃতি বিনাশে অতি তৎপর। বানাচ্ছে কংক্রীটের পাহাড়, বাড়ছে এসি, ফ্রীজের ব্যাপকতা। গাছ উজাড়, ঘাস নেই, জলাধার ভরাট, সূর্যের তাপে ধ্বংস হচ্ছে মাঠের ফসল, মাছ, পোল্ট্রি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা।

বাংলাদেশের প্রবল খরতাপে হিট এলার্ট জারিকৃত সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ন্যাম এক্সপো নামক জলবায়ু সম্মেলণ। চারদিনব্যাপী এই সম্মেলণে ১০৪টি দেশের গবেষক ও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের প্রেক্ষিতে ধ্বংসলীলা সামলানোর জন্য নানা ইতিবাচক সুপারিশ প্রদান করে গেছেন। বাংলাদেশ দাবী করেছে যে, পৃথিবীতে কার্বণ নি:সরণের ১০০ ভাগের মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৩৮ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে এই ক্ষুদ্র দেশটি। এর জন্য দায়ী কে বা কারা?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী দেশগুলো গাড়ি, এসি, ফ্রীজ, ভারী যন্ত্রাংশ, মারণাস্ত্র ও বিষাক্ত কেমিক্যাল তৈরী ও সেগুলোর জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মানবতা বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বিক্রির আয়ের উপর তাদের অর্থনীতি মজবুত হয়ে টিকে থাকার প্রয়াস পায়। মারণাস্ত্র বিক্রির আয় কমে গেলে তারা সেগুলোর বিক্রি বাড়ানোর জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার পায়ঁতারা করে। সেখানে তারা সাফল্য লাভ করে বীরদর্পে টিকে থাকে। তারাই আবার দরিদ্র বিশ্বকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করার প্রেসক্রিপশন বাতলানোর জন্য সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজনের জন্য সহায়তা করে।

এসব ঘৃণ্য কৃতকর্ম ও নীতির বৈপরিত্যের মাঝে বিস্তর শুণ্যতা অবলোকন করে প্রকৃতি মুচকি মুচকি হাসছে। আর বার বার ঘটানো এসব জঘণ্য কার্যকলাপ সহ্য করতে না পেরে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়েছে।

কারণ, মানুষের এতসব অন্যায় প্রকৃতি আর কত সহ্য করবে? মুহর্মূহ: প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ, নির্বিচারে প্রকৃতির সাজানো অবয়ব ও কাঠামোর বিনাশ সাধন প্রকৃতি বার বার সহ্য করবে কেন?

মানুষের কারণে মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে মানুষের জানমালের ক্ষতির ভয়ে লাল সংকেত স্বরূপ হিট এলার্ট জারি করছে। প্রাণভয়ে মানুষ প্রকৃতির স্মরণাপন্ন হয়ে আঁকুতি জানিয়ে হাজারো উন্মুক্ত মাঠে ইস্তিসকার নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে বুক ভাসাচ্ছে। কিন্তু তওবা করেও ফিবছর আবারো প্রকৃতি বিনাশে তৎপর হয়ে উঠছে কেন? আসলে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে বড়ই অকৃতজ্ঞ। যেমন অকৃতজ্ঞ বিভিন্ন আর্থ-সামজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, মানসিক প্রতিজ্ঞার প্রতিপালনের বেলায়। এজন্য প্রকৃতি হঠাৎ করে বড় রুষ্ট হয়ে উঠে।

প্রতিদিন কত বাঁধ বা ড্যামে কত ট্রিলিয়ন কিউসেক পানি প্রকৃতির বুকে চেপে আটকানো হচ্ছে? মহাসাগরের বুকে কত কোটি টন ক্ষতিকর বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে? ভূপৃষ্ঠের আকাশে বাতাসে কত লক্ষ লক্ষ টন বিষাক্ত বোমা ফাটানো হচ্ছে, কত শব্দ কত ঝলকানি দিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে প্রৃকতির নিয়মের উপর বাহাদুরি করা হচ্ছে- অকৃতজ্ঞ মানুষ কি সেগুলোর হিসেব মাথায় রাখতে পেরেছে? প্রৃকতির উপর এত আঘাত, এত নিষ্ঠুর পরীক্ষা, এত ব্যবচ্ছেদ, এত ক্ষত নির্বাক প্রকৃতি সেটা বারংবার সহ্য করবে কেন? তাই হিট এলার্টের কবলে এবার আমাদের চিরসবুজ বদ্বীপ বাংলাদেশ!

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *