সারাদেশ

অন্য বাংলাদেশকে দেখে গেলেন ডোনাল্ড লু

ডেস্ক রিপোর্ট: আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ আন্দোলনের সময়ে গত অক্টোবরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিষয়ে অবস্থান নিয়েছে, তা আমাদের সাহস যোগাচ্ছে। তাই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো দেশে আর নির্বাচন হবে না’। আগের দুই নির্বাচনের মতো নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এই আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেই যায়নি বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। দলটির আশা ছিল নির্বাচন হবে না, পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা যেভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, তাতে নির্বাচন করার সাহস হবে না আওয়ামী লীগের। আর নির্বাচন করলেও পশ্চিমা বিশ্ব সরকারকে সমর্থন দেবে না, সরকার টিকতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তাদের সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনের পর এরই মধ্যে চার মাসের বেশি সময় পার করে ফেলেছে সরকার। এই সময়ে দেশি-বিদেশি সকল প্রতিবন্ধকতা প্রায় অতিক্রম করেও ফেলেছে। অর্থাৎ দেশে সরকারের জন্যে অস্বস্তিকর বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। বিএনপিও নেই আন্দোলনে। যদিও নির্বাচনের আগে যারা কারান্তরীন হয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছাড়া পেয়েছেন। তারা ছাড়া পেলেও দলকে সংগঠিত করতে পারেননি। কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছেন না।

যে আমেরিকা নিয়ে এত উচ্চাশা ছিল বিএনপির, তারাও শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে। নির্বাচনের আগে অতি-তৎপর থাকা পিটার হাসের রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক দৌড়ঝাঁপ এখন নেই। তিনিও ফিরেছেন স্বাভাবিক কূটনৈতিক কার্যক্রমে। অন্য সকল রাষ্ট্রদূতের যে কার্যক্রম সেটা তার মাঝেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গত নির্বাচনের আগে আলোচিত ছিল আমেরিকার অবস্থান। এটা প্রতি নির্বাচনের আগেই থাকে। তবে ওই সময়ে তারা যে প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছিল তাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের পর্যায়েই যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সরকারের কঠোর অবস্থান এবং ভারতের ভূমিকায় তারা নমনীয় হতে বাধ্য হয়। এরপরেও আশঙ্কা ছিল নতুন সরকারের সঙ্গে আমেরিকার কাজ করা নিয়ে, যা দূরীভূত হয় মূলত গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ‘আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক’। চিঠিতে বাইডেন বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

‘যুক্তরাষ্ট্র–বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে’ জো বাইডেন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বাইডেনের সে চিঠির বাস্তবায়ন-পর্বে ঢাকা সফর করে গেছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। গত মঙ্গলবার কলম্বো থেকে ঢাকায় এসে বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা ত্যাগ করেছেন এই কূটনীতিক।

সফর প্রসঙ্গে ডোনাল্ড লু বুধবার প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অহিংস নির্বাচন নিশ্চিতে গত বছর জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরিশ্রম করেছে; যা আমাদের সম্পর্কে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি করেছিল। যদিও এটি আমাদের সম্পর্কে খুবই সাধারণ বিষয়। কিন্তু এখন আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই, মোটেও পেছনে ফিরতে চাই না। আমরা আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করার উপায় খুঁজে বের করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘কীভাবে দু’দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়, আমরা সে বিষয়গুলোতে আগ্রহী। এরই অংশ হিসেবে আমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের মধ্যকার অস্বস্তিকর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করেছি।’ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক ও আস্থা নতুন করে তৈরি করতে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন।

ডোনাল্ড লুর এই সফর এবং তার বক্তব্য সরকারের জন্যে ‘স্বস্তির’ অনেকটাই। দেশ দুটোর মধ্যকার অবিশ্বাস, সন্দেহ সেটা দূর করতে সহায়ক হতে পারে। বিশেষত তিনি যখন বলছেন, দেশে-দেশের উত্তেজনা তাদের জন্যে ‘খুবই সাধারণ বিষয়’, তখন! নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা যে দেশে-দেশে উত্তেজনা ছড়ায়, এবং বাংলাদেশের বিষয়টি তেমনই এক, বক্তব্যে স্বীকারোক্তি আছে এর। বক্তব্যে তিনি যখন পেছন ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন, তখন এটাকে ইতিবাচকভাবে নেওয়া যেতে পারে।

ডোনাল্ড লুর এই সফরে একাধিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠক হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চেয়েও পাননি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগের দেশি-বিদেশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি, ফলে নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা থাকলেও নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আগের সেই ঋজু অবস্থান ধরে রেখেছেন। ডোনাল্ড লুর ‘সম্পর্কোন্নয়নের’ সফরেও সাক্ষাৎ দেননি তাকে। এরবাইরে সফরসূচির কোন পর্যায়েই বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয়নি। অর্থাৎ এই সফরকে আমেরিকা স্রেফ কূটনৈতিক সফর এবং সম্পর্কোন্নয়নের এক সফর হিসেবে নিয়েছে।

ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বিএনপির কোন পর্যায়ের কারো দেখা হয়নি। তাকে ও তার দেশকে নিয়ে ‘হতাশ’ বিএনপি নেতারা এই সফরকে গুরুত্বহীন বলতে চাইছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সফর শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘কে আসলো আর কে গেলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’ স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘ডোনাল্ড লুর আসা-না আসায় কিছু যায়-আসে না।’ সফর চলাকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত নির্বাচনের আগের তাদের আশাবাদের ভিন্ন ব্যাখ্যায় এবার বলছেন, ‘আমি জানি না আপনারা কী অবস্থানে তাদের ভেবেছিলেন। আমরা যেটা দেখেছি, সেটা হচ্ছে তারা একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন। এটা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন।’ তবে বিএনপির বোধোদয় হয়েছে এবার হয়ত। নির্বাচন হলেও সরকার টিকতে পারবে না বিএনপির সেই আশাবাদের বিপরীতে এবার তিনি বলছেন, ‘যেকোনো দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে হয় সবাইকে। সে জন্য তারা (আমেরিকা) সেটাকে অব্যাহত রাখেন। এমনকি সামরিক শাসকদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক রাখতে হয়। আজকে বাংলাদেশের যে অবস্থাটা, সে অবস্থার প্রেক্ষাপটে তারা তাদের দেশের প্রয়োজনে যেটা উপকারী মনে করছেন, সেটা করছেন।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, ‘তারা তাদের দেশের প্রয়োজনে যেটা উপকারী মনে করছেন, সেটা করছেন’, একইধরনের কথাও উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও। ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার দিন তিনি বলেছেন, ‘ডোনাল্ড লুকে দাওয়াত করে আনা হয়নি। তিনি নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলোচনা করতে এসেছেন।’ প্রায় অভিন্ন কাদের-ফখরুলের ভাষ্য, তবে দুজন দুই অবস্থান থেকে একজন আশা আর আরেকজন হতাশা থেকেই এসব বলছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

তিনদিনের সফর শেষে ফিরে গেছেন ডোনাল্ড লু। তবে তার এই সফর সরকারের জন্যে আশাব্যঞ্জক নিঃসন্দেহে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই অঞ্চলের নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি যখন পেছন ফিরে না যাওয়ার কথা বলছেন, উত্তেজনাকে যখন খুবই সাধারণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন তখন ধারণা করা যায় ভিসা-বাণিজ্যসহ বিবিধ নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা অনেকটাই দূর হতে শুরু করবে। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, ব্যবসায়িক পরিবেশের সংস্কারসহ নানা বিষয় নিয়ে ইতিবাচক পথ প্রশস্ত হবে।

ডোনাল্ড লুর হয়ত পুরো দেশের নীতি বদলানোর ক্ষমতা নেই, তবে যেটুকু ক্ষমতা তার সেখান থেকেই আশাবাদের বাণী রেখেছেন এখানে। এটা স্বপ্রণোদিত তার। আমেরিকা নিজেদের প্রয়োজনে এমনটা করে থাকে। তবে আমরা আমরা যারা কিনা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে দেখেই পুরো আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত নেওয়া লোক, তারা তারচেয়ে অন্তত বেশি ক্ষমতার ডোনাল্ড লুকে দেখে খানিকটা আশাবাদী হলাম! যদিও এটা আমাদের জন্যে খানিকটা অপমানের, তবু…। বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে যে অপমান গায়ে মেখে এসেছি আমরা এতদিন সে অপমান উগরাতেও পারছি না সহসা।

তবু কথা থাকে, কেন তিনি এত আলোচনার? তাকে অতি-আলোচনায় নিয়ে আসলাম তো আমরাই। বিবিধ চাপে নতজানু না হওয়া সরকার এবারও তার অবস্থান ধরে রেখেছে বলে দৃশ্যমান। যা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যে স্পষ্ট; ‘দাওয়াত করে আনা হয়নি।’

‘বিনা-দাওয়াতে’ আসা ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করে চলেও গেছেন। যাওয়ার আগে দেখেছেন নিশ্চয়ই আত্মসম্মানবোধে ঋজু হয়ে থাকা দেশটাকে। বিবিধ চাপে নতজানু না হওয়া বাংলাদেশকে চিনেছেন তিনি এবার অন্যভাবে। বাংলাদেশে এসে যে বার্তা পেলেন তিনি, দিতে চাইলেন যে বার্তা সেটা দুই দেশের সম্পর্ককে ভিন্ন মাত্রা দেবে নিঃসন্দেহে; কিছু শিক্ষণীয় আছে বৈকি!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *