সারাদেশ

শ্রমজীবী মানুষের জন্য আলাদা বাজেট চান শাজাহান খান

ডেস্ক রিপোর্ট: চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে ১২৫ শতক জায়গার ওপর নির্মিত দেশের একমাত্র ’জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘর’। রক্ষণাবেক্ষণ, প্রচার-প্রচারণা ও দেখভালের অভাবে আজ এটির বেহালদশা। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা ভবনটির ভিতর থেকে দেখলে এটিকে ভূতের বাড়ি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বোঝার উপায় নেই, পুরো এশিয়া মহাদেশের দুইটি জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের মধ্যে এটি অন্যতম আন্তর্জাতিক চাহিদা সম্পন্ন একটি জাদুঘর। অথচ, এখানে রয়েছে চারটি বিদেশি জাতিগোষ্ঠীসহ ২৯টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা, ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার উপকরণ প্রদর্শনী। রয়েছে বার্লিন প্রাচীরের কয়েকটি ভাঙা টুকরা, একটি গ্রন্থাগার ও চিত্রশালা।

শুক্রবার (১৭ মে) জাদুঘরে প্রবেশ করতেই প্রথমেই চোখে পড়বে হলঘর। হলঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রথম গ্যালারির প্রথম কক্ষটি বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ ও আলোকচিত্রের সাহায্যে সাজানো হয়েছে। কক্ষটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীর আলোকচিত্রসহ জাতীয় ফুল, ফল ও পশু-পাখির প্রতিকৃতি তৈরি করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

দ্বিতীয় কক্ষে ৪টি বিদেশি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নিদর্শন উপস্থাপন করা হয়েছে। এই কক্ষে চোখে পড়বে, মাঝখানে বাটিযুক্ত বড় আকৃতির কাঠের থালা, সহজে দুই ভাঁজ করা যায় এমন কাঠের নকশা খচিত জায়নামাজ, নকশাযুক্ত কাঠের সিন্দুক ও জানালা। এ কক্ষে আরও আছে পাঠানদের ব্যবহৃত তরবারি, বর্শা, তীর ও ধনুক। এছাড়া বাকি ৯টি কক্ষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিধেয় অলংকার প্রদর্শিত হচ্ছে।

নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা দুই নম্বর গ্যালারির ক কক্ষে প্রবেশ করলে একজন দর্শনার্থী দেখতে পাবেন, পাঙান, মণিপুরী, ওঁরাও জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার আলোকচিত্র, মান্দাই জনগোষ্ঠীর বাসগৃহ ও তাদের হস্তশিল্পজাত উপকরণ। খ নম্বর কক্ষে সাঁওতাল আর পলিয়া জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ ও ঘরোয়া জীবনের প্রতিকৃতি দেখা যাবে। তাদের ব্যবহৃত গৃহস্থালী জিনিসপত্রও রয়েছে সেখানে।

তিন নম্বর গ্যালারির ক নম্বর কক্ষে মুরংদের গ্রাম্য জীবন এবং ব্যবহারের জন্য নিজেদের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। খ এবং গ নম্বর কক্ষে ত্রিপুরাদের জীবন ধারার আলোকচিত্র রয়েছে। তাদের ব্যবহৃত টুপি, ঝুড়ি, কাপড়-চোপড়, বম জনগোষ্ঠীর চরকা, কম্বল, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর কাপড়-চোপড়, ত্রিপুরাদের বাজার ব্যবস্থার আলোকচিত্র দেখা যাবে।

প্রাচীন ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বিশাল সংগ্রহশালা চবি জাদুঘর চার নম্বর গ্যালারির ক নম্বর কক্ষে খুমিদের জীবন ধারা, চাকমাদের ব্যবহৃত পোশাক পরিচ্ছদ, শিকারের অস্ত্র-শস্ত্র, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পোশাকপরিচ্ছদ দেখা যাবে। খ নম্বর কক্ষে আছে মারমাদের ঘরোয়া জীবনের আলোকচিত্র এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্র।

তবে, এসব প্রদর্শনীর মাঝে-মাঝেই দেখা মিলেছে জাদুঘর ভবনটির জরাজীর্ণ অবস্থা। ছাদ চুইয়ে, দেয়াল বেয়ে গ্যালারিতে পানি পড়ছে। তাই সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করে রাখা বাক্সগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে, অযত্ন-অবহেলায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে জাদুঘরে সংরক্ষিত সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো। খসে পড়ছে জাদুঘর ভবনটির দেয়ালের পলেস্তারা। দেখভালের জন্য নেই পর্যাপ্ত লোকবলও।

ছুটিরদিন হওয়া সত্ত্বেও দর্শনার্থী খরা দেখা গেছে দেশের পূর্বকোণে অবস্তিত এই জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরে। এদিন বিকেলে জাদুঘরের ১১টি কক্ষে দর্শনার্থী দেখা গেছে হাতে গোনা কয়েকজন।

উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া তিন বান্ধবী আরজু, সিনথিয়া ও জোনাকি হালিশহর থেকে ঘুরতে এসেছে বাংলাদেশের একমাত্র জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরে। তিন বান্ধবী মিলে নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনাচার ও বিভিন্ন নিদর্শনগুলো এক এক করে দেখছে। এসময় তাদের সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের এই প্রতিনিধির।

তারা বলে, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে এসে জানতে পারছি, বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। প্রকৃতির সাথে সমন্বয় করে তারা কীভাবে এখনো টিকে আছে, তার নিদর্শন এখানে রয়েছে। এরমধ্যে আমাদের চোখ যাচ্ছে বারবার মনিপুরী, গারো, সাওতালদের বিভিন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ-অলংকারে। কেননা, তারা খুব সুন্দর সুন্দর পোশাক-অলংকার পরে।

জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি সোম থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তবে, রোববার বন্ধ থাকে জাদুঘর। আর অন্যান্য দিন দুপুর ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিরতি থাকে। এখানে স্কুলশিক্ষার্থীরা জনপ্রতি ১০ টাকা, সাধারণ দর্শনার্থী ৩০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থী ২০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের দর্শনার্থীরা ৪০০ টাকা করে প্রবেশমূল্য দিয়ে পরিদর্শন করতে পারেন।

খসে পড়ছে ভবনের পলেস্তারা পাশে থাকা দোতলা বিশিষ্ট পুরোনো অফিস ভবনটিও বেহালদশা। ওই ভবনের ওপরতলার এক কোণে থাকা গ্রন্থাগারের অবস্থা আরও নাজুক। কক্ষটিতে কয়েকটি কাঠের ও স্টিলের আলমারিতে কিছু বই থাকলেও বসে পড়ার মতো ভালো পরিবেশ নেই। তাছাড়া, জাদুঘরে জায়গা স্বল্পতার কারণে সংগৃহীত অধিকাংশ নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে, প্রায় তিন হাজার নিদর্শন গ্রন্থাগারের পাশের স্টোরে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু সেখানেও যথেষ্ট অবহেলার ছাপ দেখা গেছে। ধুলাবালি জমে নষ্ট হওয়ার পথে এসব নিদর্শন।

জাদুঘরের প্রশাসনিক দফতর জানিয়েছে, গত মাসে (এপ্রিল) ১ হাজার ২৯৩ জন দর্শনার্থী পরিদর্শনে এসেছেন। বিদেশি ৯ জন এবং সার্কভুক্ত দেশের আরও ২ জন দর্শনার্থী এখানে এসেছেন। এতে এপ্রিল মাসে টিকেট বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার ১৩০ টাকা। তবে, এই জাদুঘরের পেছনে সব মিলিয়ে প্রতিমাসে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকা। এতে আয়ের চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় প্রায় কয়েকগুণ।

ফারুক আহমেদ নামের আরেকজন দর্শনার্থী বার্তা২৪.কমের কাছে খুলে দেন তার অভিযোগের বাক্স। তিনি বলেন, এখানে যে জাতিগোষ্ঠীর জীবনচরিত্র রয়েছে, তা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষের উচিত রক্ষণাবেক্ষণে আরও যত্নবান হওয়া, সংগ্রহশালা বাড়ানো। তাছাড়া, এখানে দেখছি, এটা-সেটা ভেঙে আছে, ঠিক করা হচ্ছে না। ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন সবকিছু। বৈদ্যুতিক তারের পাইপ পড়ে আছে। এতো গুরুত্বপূর্ণ এই জাদুঘরটিকে এরকম অযত্নে-অবহেলায় রাখলে অচিরেই আমরা জাতি-তাত্ত্বিক জাদুঘরের ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবো। যে নিদর্শনগুলো আছে, তা-ও ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইকবাল হোসেন নামের আরেক দর্শনার্থী বলেন, এখানে মাত্র ২৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত ধারণা আছে। অথচ, প্রায় ১০০টির মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে। প্রতিষ্ঠার এতো বছর পরেও সেগুলো এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি যা আছে সেগুলোর সংগ্রহশাল, স্থান, সংগ্রহকারী ইত্যাদির কোন তথ্যও নেই। যার কারণে দর্শনার্থীদের এসে বিভ্রান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের নিয়ে জানাশোনার জন্য এটি এশিয়া মহাদেশে অন্যতম। এছাড়া, এই ডিজিটাল যুগে এসেও জাদুঘরের আধুনিকায়ন নেই। পর্যাপ্ত লাইট, ফ্যান বা আলো-বাতাস নেই। নেই আসবাবপত্রে নতুনত্ব।

হলঘরের উপরের দেয়ালে থাকা পাকিস্তান আমলের তৈলচিত্রগুলোর দিকে আঙুল ইশারা করে তিনি বলেন, এগুলো পাকিস্তান সময়ের। পলেস্তরা খসে পড়ায় এগুলো এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু টাকা খরচ করে এগুলো আবার সুন্দর আর্ট করে চকচকা করতে পারে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এই ছবিগুলো আর পাওয়া যাবে না। নতুন করে তৈরিও সম্ভব না।

এসব অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে জাদুঘরের উপ-পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমানের সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের। তিনি বলেন, এখানে নিদর্শন সংগ্রহ বাড়ানো ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন কোন বাজেট নাই। টিকিটের টাকাও সরকারের রাজস্ব খাতে চলে যায়। গতবছর দেড় লাখ টাকা বাজেট পেয়েছি মাত্র। এতে কিছুই হয় না। লোকবলেরও সংকট আছে।

তিনি জানান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কেয়ার টেকারসহ ৩০ জনের পদ থাকলেও আছে কেবল ১৭ জন। যে টাকা বরাদ্দ আসে চাইলেই একজনকে রাখা যায় না। জাদুঘরের অনেক কিছু সংস্কার করা প্রয়োজন। সেজন্য দরকার পর্যাপ্ত অর্থ। কিন্তু ঢাকা থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি না। এসব বিষয়ে আমি মহাপরিচালককে কয়েকবার বলেছি। কিন্তু, সাড়া নেই। তবুও আমরা সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করছি।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *