খুলনায় পাটের গোডাউনে আগুন: নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৭ ইউনিট
ডেস্ক রিপোর্ট: চলতি বছরের ৪ মার্চ। দিনটা এখনও ভুলতে পারেন না আবুল বাশার। কক্সবাজারের চকরিয়ার আজিজনগরের এই বাসিন্দা চাইলেও দিনটা হয়তো ভুলতে পারবেন না কোনোদিন। কীভাবেই বা ভুলবেন!
সেই দিন যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল তারই ২৯ বছরের টগবগে ছেলো মো. হামিদের লাল রক্তে। সন্তান হারানোর সেই স্মৃতি বৃদ্ধ আবুল বাশার আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন দুই নয়নের জলে।
কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে কদিন পরেই, ১ ডিসেম্বর থেকে। তারই আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার (১১ নভেম্বর) উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের দ্বার খুলে দিচ্ছেন।
সেটি জানার পর থেকে আবুল বাশারের মনের এক পাশটা আনন্দে ভরে উঠেছে, অন্য পাশটা অবশ্য ছেয়ে আছে বিষণ্নতায়ও।
মনের সেই মিশ্র অনুভূতি আবুল বাশার শব্দ দিয়ে খোলাসা করলেন এভাবে, ‘ছেলেটা এখানে ওখানে কাজে যেত নিয়মিত। ট্রেন থাকলে হয়তো ও গাড়িতে নয়, ট্রেনে চড়েই যাতায়াত করত। কিন্তু গাড়িতে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ মহাসড়কে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ দিতে হয়েছিল আমার ছেলেসহ চারজনকে। ট্রেনে তো তেমন দুর্ঘটনা কমই ঘটে।’
ছেলের কথা বলতেই স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলেন আবুল বাশার। কিছুক্ষণ ঝরঝর করে কেঁদে একটু শান্ত হলেন দুর্ভাগা বাবা। এরপর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বাশার বললেন, ‘ট্রেন চলিলে আর বাস-টেক্সিত ন চইরগম। তহন আঁরার প্রাণ বাঁচিব, বুকের ধনও ন হারাইয়্যম। (ট্রেন চললে আর বাস-অটোরিকশায় চড়ব না। তখন আমাদের প্রাণ বাঁচবে, বুকের ধনও হারাব না)।’
একইভাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক কেড়ে নিয়েছে মোহাম্মদ সিদ্দিকের বড় আদরের ধন মোহাম্মদ রাসেলকেও। রাসেলের কথা জানতে চাইতেই ছেলের লাশ নিজের কাঁধে বহনের মতো কঠিন পরিস্থিতি পার করে আসা এই বাবার গলা স্যাঁতস্যাতে হয়ে উঠল।
তিনি বললেন, ‘শুনেছি আর কদিন পরেই চালু হবে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ।
এখন থেকে আর আমার মতো অনেককে হয়তো ছেলের লাশ বহন করার মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। কেননা এখন মানুষের ট্রেন নির্ভরতা বাড়বে, ফলে নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এই মহাসড়কে যান চলাচলের ওপর চাপ কমবে। ফলে আগের মতো দুর্ঘটনা ঘটবে না। এটা ঠিক, জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতেই। তবে ট্রেন যেন যাতায়াতের ক্ষেত্রে আমাদের জীবন বাঁচার উসিলা হয়ে এসেছে।’
দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মহাসড়ক বলা হয়ে থাকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটিকে। এর কারণও বহু। একদিকে সরু, অন্যদিকে বিপজ্জনক বাঁক-সড়কটিকে হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কক্সবাজার অংশেই ১১৪টি বাঁক রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি বাঁক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
অপ্রশস্ত সড়ক ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের কথা তো বলা হলো। এছাড়া সড়ক লবণের পানি ও মাটির মিশ্রণে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া, অদক্ষ চালক, বোপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে নামানো, চলন্ত অবস্থায় বাসে যাত্রী ওঠানামা করা, যানবাহন ক্রস করার সময় গতি না কমানো, সংকেত না দিয়ে ওভারটেকের চেষ্টায় প্রায় প্রতিদিনই এই মহাসড়কের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে।
এক হিসেবে দেখা গেছে এই মহাসড়কে বছরে অন্তত ২৫০-৩০০ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন।
বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক- উপসড়কে ৬৪টি দুর্ঘটনায় ৬৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ১০৮ জন।
মূলত দেশের প্রধান পর্যটননগরী হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক কক্সবাজারে ঘুরতে আসেন। কিন্তু তাঁরাও নিরাপদ নন, ঘুরতে এসে প্রাণ দিতে হচ্ছে বেঘোরে। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান পর্যটকবাসের দুই যাত্রী। একই দুর্ঘটনায় আহত হন ৬ জন।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মহাসড়কে প্রতিদিন বৈধ বাস-ট্রাক চলে প্রায় ১ হাজারের মতো। পাশাপাশি অবৈধ গাড়ি চলে ২ হাজারের (অনুমোদনবিহীন নছিমন-করিমন, চার চাকার ট্রলি, ইজিবাইক সিএনজি, চার চাকার খোলা পিকআপ) মতো। সবমিলে প্রতিদিন ৩ হাজার গাড়ি চলাচল করে।
এখন পুরোদমে ট্রেন চলাচল শুরু হলে প্রতিদিন অন্তত দশটি ট্রেন আসা-যাওয়া করবে। তখন কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ ট্রেনে আসা-যাওয়া করতে পারবেন বলে জানিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এর ফলে মহাসড়কের ওপর দিয়ে অনেকটাই গাড়ির চাপ কমে যাবে। এর ফলে কমবে দু্র্ঘটনাও।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. এরফানও মনে করেন ট্রেন চালু হলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ট্রেন চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল কমবে। সড়কের ওপর চাপ কমলে দুর্ঘটনাও অনেকটা কমে আসবে মনে করছি।’
আর মাত্র কটা দিন। এরপরই ঝক ঝক ঝক করে ঢাকা থেকে ট্রেন ছুঁটবে সমুদ্রনগরীর পথে। সেই ট্রেনের হুইসেলের শব্দে হয়তো ঘর থেকে বেরিয়ে রেলপথের দ্বারে চলে আসবেন সন্তান হারানো আবুল বাশার আর মোহাম্মদ সিদ্দিকেরা। ট্রেনের চলে যাওয়া দেখে দেখে সন্তানহারা বাবারা হয়তো ভাববেন, ‘ইশ আরও আগে যদি ট্রেন আসতো কক্সবাজারে, বুকের ধন বুকেই থাকত!’
সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।