সারাদেশ

পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ ১২ দাবি

ডেস্ক রিপোর্ট: আসন্ন বাজেটটি হতে হবে কৌশলী ও সুদূরপ্রসারি: ড. আতিউর

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় রেমিটেন্স আর রপ্তানিখাত আরও শক্তিশালী করা গেলে বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএম’র সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

আগামী ৬ জুন সংসদে জাতীয় বাজেট উত্থাপনের প্রাক্কালে মঙ্গলবার বার্তা২৪.কম-কে বাজেটপূর্ব প্রত্যাশার কথা বলতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।

এবারের বাজেটকে নানা কারণেই ‘বিশেষ’ উল্লেখ করে সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মেরুকরণের প্রভাব আমাদের এবারের জাতীয় বাজেটে অবধারিতভাবেই পড়বে। লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ হুথি বিদ্রোহীদের কারণে আক্রমণের শিকার হওয়ায় অনেক ঘুরে সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল করতে হচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই পন্যের দামও বেড়ে চলেছে।আমদানি খরচ বেড়ে যাবার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, ইতিপূর্বে তা হয়নি কখনো।’

তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়েছে, যার প্রতিফলন জাতীয় বাজেটেও পড়বে। এই জায়গাটিতে আমরা যাঁরা অর্থনীতির মানুষ তাদের অর্থনীতির ভাষাতেই বিষয়গুলোকে বর্ণনা করতে হবে, আতঙ্ক তৈরি না করে।’ বাস্তবতার কারনেই আগামি বাজটের মূল লক্ষ্য হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্হিতিশীলতা অর্জন, প্রবৃদ্ধি নয় বলে মন্তব্য করেন ড. রহমান। তাছাড়া বাজেটটি হতে হবে বাস্তবানুগ। উচ্চাভিলাষী নয়।

‘যে আলোচনাটি আমি আনতে চাই-তা হচ্ছে, পূর্বের বাজেটগুলোতে যে সব খাতের অর্থ অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে, তা কেন সংশোধিত কিংবা পরবর্তী বাজেটে আমরা সামাজিক সুরক্ষায় কাজে লাগাতে পারি না? সংশোধিত বাজেটের আগে এই আলোচনাটি প্রধান্য পাওয়া উচিত’-যোগ করেন ড. রহমান।

বাজেটকে সম্ভাব্য ধরনের কথা বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে ‘আমরা যদ্দূর জানতে পারছি, এবারের সংকোচনমূলক জাতীয় বাজেটের আকার প্রায় ৪ শতাংশ বাড়তে পারে। নিশ্চয় আমাদের আয় দেখে ব্যয় করবার প্র্যাকটিস করতে হবে। নয়তো বাজেট ডেফিসিট বাড়বে।বাস্তবতা হচ্ছে-চাহিদা কমিয়ে দাম পুরোপুরি ঠিক করা যাবে-এটা ঠিক নয়। আমরা দেখতে পারছি, বাজারে সাপ্লাই আছে, তা সত্ত্বেও মূল্য কমানো যাচ্ছে না।তার মানে বাজার ব্যবস্হাপনায় ত্রুটি রয়েছে।’

বিকল্প প্রণোদনার তাগিদ দিয়ে আতিউর রহমান বলেন, ‘প্রণোদনা নিয়ে আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের যেসব চাপ আছে তা সত্ত্বেও আমরা কৃষিসহ অগ্রাধিকার কিছু খাতে ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছি এবং তা ২০২৬ পর্যন্ত দিয়ে যাব। কিন্তু আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে, যদি এই প্রণোদনার রাশ টানতেই হয়, তবে তার প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের বিকল্প প্রণোদনার একটা কৌশল নিয়ে রাখতে হবে কৃষিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য।’

‘সার্বিক বিবেচনায় রপ্তানি ও রেমিটেন্সে প্রণোদনা এখনই উঠিয়ে নেওয়া যাবে না। এসব খাতগুলোতে প্রণোদনা উঠানোর আগে ম্যাক্রো ইকনোমি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌছেছে কিনা তা দেখতে হবে। সেই সঙ্গে বিকাশমান আইসটি খাতে এখনি করারোপের পক্ষে নই আমি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আরও কর সুবিধা দিতে হবে।’

রেমিটেন্স খাত নিয়ে উদ্ভাবনী পদক্ষেপের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি যেটি তা হচ্ছে-বিরাট সম্ভাবনাময় রেমিটেন্স খাতের জন্য আমরা কতটুকু করছি? এই খাত থেকেই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো আসছে। অথচ আমরা আইএমএফ থেকে মাত্র ৪.৭ বিলিয়ন ডলার পেতে কত কসরৎই না করছি। কত শর্ত মানছি।অথচ যদি রেমিটারদের আমরা আরও সুবিধা দিতে পারতাম তবে এই খাত নির্ভরতার এক বিরাট জায়গা হয়ে উঠতে পারতো। ভারতে বৈধপথে অর্থ পাঠানো রেমিটারদের হাউজিং লোন দেওয়া হয়।’

ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে তাদের পেনশন স্কিমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্ভূক্ত করাসহ দেশে অবস্থানকালে হাসপাতালগুলোতে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেওয়ার দাবি করব আমরা। তাদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। এই খাতে আরও বহু উদ্ভাবনী কৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। তাহলে এই রেমিটাররাই আমাদের জন্য বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিবেন।আরও বেশি করে বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন।এটি জোর দিয়েই বলা যায়, আমাদের রেমিটেন্স ও রপ্তানিখাত শক্তিশালী হলে বিশ্বব্যাক-আইএমএফ এর এতোটা সহযোগিতা আর লাগবে না।’

সিগারেটে বাড়তি করারোপ ও মূল্য বাড়িয়ে সেই অর্থে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করে তিনি বলেন, ‘করারোপের ক্ষেত্রে সিগারেটের মতো স্বাস্থ্যহানিকর পণ্যের দাম ও কর বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। আমরা তুলনামূলক গবেষণার মাধ্যমে যেটি জানিয়েছি যে, সিগারেটে বেশি করে করারোপ ও মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে অন্ততঃ ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি পাওয়া সম্ভব। যা দিয়ে স্বাস্থ্যখাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো যাবে।’

আসন্ন বাজেটকে জলবায়ুবান্ধব করার জোর দাবি জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমাদের আগামী বাজেট হতে হবে জলবায়ুবান্ধব। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই যে ঘূর্ণিঝড় রিমাল বয়ে গেল; আমরা ভাবতে পারি যদি সুন্দরবন না থাকতো তবে আমাদের কি অবস্থা হতে পারতো। বুক পেতে দিয়ে আমাদের বাঁচানো এই প্রাকৃতিক অবকাঠামো তথা সুন্দরবনের জন্য আমরা কি করছি, কি বরাদ্দ রাখছি বাজেটে। প্রাকৃতিক এই অবকাঠামোকে সুরক্ষায় আমাদের অনেক কিছু করার আছে। এর জন্য অর্থের কোন অভাব হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ আসবে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই, তবে আমাদের সেই অর্থ প্রাপ্তির জন্য প্রাতিষঠানিক কাঠামোগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’

আইনপ্রণেতাদের এই বাজেট প্রণয়ণে আরও অংশগ্রহণমূলক ও প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথাও বলেন আতিউর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাতীয় বাজেটকে ঘিরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর অনেক ভূমিকা থাকতে পারে। এ নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপও করেছি। জনপ্রতিনিধিরা তাদের অঞ্চলের চাহিদা বিবেচনায় কি ধরণের বাজেট চান এবং জাতীয় বাজেট নিয়ে তাদের ধারণাগত সক্ষমতা বাড়াতেও আমরা কাজ করে আসছি, গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়ের পক্ষ থেকে। আমরা বলতে চাই বাজেট বক্তৃতা একটি পরিসংখ্যান বা প্রাক্ক্যলনভিত্তিক তথ্যের উপস্থাপন নয়।’

‘আমি মনে করি, এটি একটি দার্শনিক বক্তৃতা হওয়া উচিত। যেখানে জনগণের মাঝে স্বপ্ন জাগানোর ব্যাপার থাকবে। অবশ্যই বাজেটে জনচাহিদা লক্ষ্য রেখে করারোপ করতে হবে। সেই সঙ্গে কর প্রদান দেশপ্রেমের অংশ-এই ক্যাম্পেইনটাও দেশজুড়ে হওয়া উচিত।’

গণমানুষের জন্য সহজবোধ্য, সংক্ষিপ্ত ও স্মার্ট বাজেট পেশ করার দাবি জানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বাজেট পেশের দৃষ্টান্ত হাজির করেন আতিউর রহমান।

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বাজেট দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। তৎকালীন অর্থসচিব মতিউল ইসলামের সহযোগিতা নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ১৫-২০ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত স্মার্ট বাজেট উপহার দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, সাম্প্রতিককালে যেসব জাতীয় বাজেট দেওয়া হয় তা অনেক দীর্ঘ। অনেক অর্থমন্ত্রী তা উপস্থাপন করতে গিয়ে অসুস্থও হয়ে পড়েন। আমি মনে করি এই বাজেট সংক্ষিপ্ত ও স্মার্ট করার সুযোগ আছে।’

আসছে বাজেটটি সদ্য নির্বাচিত এই সরকারের প্রথম বাজেট। আগামি পাঁচ বছরের উন্নয়নের কৌশলের ভিত্তিভূমি হতে যাচ্ছে এই বাজেট।তাই কৌশলগত দৃষ্টিতে এই বাজেটটি হতে হবে খুবই কৌশলি ও সুদূর প্রসারি বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আতিউর রহমান।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *