সারাদেশ

নৌপথে লাশের মিছিল, অধরা অপরাধী

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকার সাদেকখান রোডের বাসিন্দা ছিলেন ভোলার দুলারহাট উপজেলার কামালের ছেলে মো. শাকিব। রাজধানীতে পিকআপ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০২২ সালের জুন মাসে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন একই এলাকার মো. স্বপনের মেয়ে স্বপ্নীল আক্তারকে। শাকিবকে পিকআপ কিনে দিয়েছিলেন শ্বশুর। উদ্দেশ্য ভালো আয় রোজগারে সংসারে সচ্ছলতা। কিন্তু সেই পিকআপই কাল হলো শাকিবের।

পিকআপটি ছিনিয়ে নিতে শাকিবকে হত্যার পরিকল্পনা করে ঘাতকরা। বাসার মালামাল পরিবহনের নাম করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জের আরসী নগর এলাকায়। এরপর হাত-পা ও মুখে স্কচটেপ বেঁধে জীবিত অবস্থায় শাকিবকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। পানিতে ডুবেই নির্মম মৃত্যু হয় শাকিবের। হত্যার দুদিন পর হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ পেঁচানো অবস্থায় আটিবাজার এলাকা থেকে অজ্ঞাত মরদেহ হিসেবে উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। পরবর্তীতে নিহতের স্বজনরা শাকিবের লাশ শনাক্ত করেন। এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত মূল পরিকল্পনাকারী নাইমুল হোসেন সিয়াম, মিজানুর রহমান ও মো. সিয়ামকে গ্রেফতার করে।

তবে শাকিবের মতো সবার ভাগ্যে নির্মম মৃত্যুর পরেও পরিচয়টাও পাওয়া হয় না। তারা পুলিশ আর হাসপাতালের খাতায় অজ্ঞাত লাশ হিসেবে রয়ে যায়। একটি মানুষের পরিচয় হয়ে যায় কেবল মাত্র সংখ্যা।

যার প্রমাণ পাওয়া যায় জনকল্যাণ সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের খতিয়ান দেখলেই। মানবতার সেবায় কাজ করা সংগঠনটি গত পাঁচ বছরে প্রায় তিন হাজার বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অজ্ঞাত লাশ দাফন হয়েছে ২০১৯ সালে ৭৯৫টি, ২০২০ সালে করোনার বছর দাফন হয়েছে ৬৩৩টি, ২০২১ সালে ৪৬৫টি, ২০২২ সালে ৪৪৩টি ও ২০২৩ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৯০টি।

হত্যার দেড় বছর পর কথা হয় নিহত শাকিবের শ্বশুর মো. স্বপনের সঙ্গে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, মেয়ের সুখের জন্য জামাইকে গাড়ি কিনে দিয়েছিলাম। সেই গাড়ির কারণেই তার জীবনটা শেষ করে দিলো। এখন বিচারের অপেক্ষায় আছি।

তিনি আরও বলেন, শাকিবকে মেরে গাড়িটি ছিনতাই করতে চেয়েছিল ছিনতাইকারীরা। কিন্তু সেটি তারা পারেনি। যার জন্য গাড়ি কিনেছিলাম সে-ই তো চলে গেছে। এখন গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। মামলার চার্জশিট এখনো হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে দেশের বর্তমান নৌপথের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে এর পরিমাণ আরও কমে যায়। রাজধানীর ঢাকার চারদিকেই রয়েছে নদী। ফলে দেশের বাণিজ্যখাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথও লাশ ফেলার সহজ ঠিকানা। অপরাধীরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার পরে কখনো কখনো হাত পা বেঁধে আবার কখনো বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়ায় হত্যার আলামত নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি কখনো কখনো মরদেহ উদ্ধার হলেও পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বেওয়ারিশ বা অজ্ঞাত হিসেবে দাফন হয়ে যায়। ফলে অধরা থেকে যায় হত্যাকারীরা।

নৌ পুলিশের হিসেবে দেখা গেছে, রাজধানীর চারপাশের নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মরদেহ উদ্ধার হয় বুড়িগঙ্গা থেকে। এছাড়া তুরাগ, বালু নদী ও শীতলক্ষ্যা থেকেও নিয়মিত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে।

নৌ পুলিশের হিসাব বলছে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে চার হাজার ৭৪৪ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে উদ্ধার হয়েছে ১১৯টি। যার মধ্যে ২৭ মরদেহ অজ্ঞাত। ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদীগুলো ছাড়াও পদ্মা, মেঘনা, গোমতী, সুরমা ও কুশিয়ারা নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এই সকল নদী থেকে অন্তত মাসে ৩৫ থেকে ৪০টি বেওয়ারিশ মরদেহ উদ্ধার করে নদী পথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এই বাহিনীটি।

নৌ পুলিশের সদর দফতর থেকে পাওয়া হিসেব বলছে, ২০২২ সালে সারাদেশের নৌপথ থেকে ৩৬০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে। যার মধ্যে ২৪০টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি ১২০টি মরদেহের। ২০৩৩ সালে ৪০৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ২৬৮টি মরদেহের পরিচয় পাওয়া গেলেও বেওয়ারিশ থেকে গেছে ১৩৭ মরদেহ।

নৌপথে মরদেহ ফেলার বিষয়ে নৌ পুলিশের প্রধান মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ বলেন, নদীতে কোনো মরদেহ ফেলার পরেই কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে পচন শুরু হয়। এই তাড়াতাড়ি পচনের শুরু হওয়ায় মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। তবে অধিকাংশ মরদেহের পরিচয় ও হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীতে লাশ ফেলার পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে মরদেহ ফুলে যায়। মরদেহের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। পানির কারণে দ্রুত পচতে থাকায় মরদেহ থেকে হত্যার আলামত নষ্ট হতে শুরু করে।

নৌপথে লাশ ফেলা বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত খন্দকার ফারজানা রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, কোনো অপরাধ ঘটলে সারাবিশ্বেই প্রধান টার্গেট থাকে প্রমাণ নষ্ট করা। আর এটি করতেই বিভিন্ন সময়ে অপরাধীরা আমাদের দেশের অরক্ষিত নদীতে ফেলে দেয়। ফলে পানি ও রোদে মরদেহটি থাকার কারণে মৃতদেহে বিভিন্ন ধরনের বিক্রিয়া শুরু হয়। এতে হত্যাকারীর ডিএনএ নষ্ট হয় এবং হত্যার সময় ও ধরন নষ্ট হয়ে যায়।

নদীপথে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানের এই শিক্ষিকা আরও বলেন, আমাদের দেশে নিখোঁজের ঘটনায় হওয়া সাধারণ ডায়েরি বা মামলাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা উচিত। একটি সফটওয়্যার বা অ্যাপস তৈরি করা যার মাধ্যমে তথ্যগুলো সহজে জানা যাবে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো একটি থানায় অজ্ঞাত হিসেবে একটি লাশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু ওই ব্যক্তির নামে আগেই অন্য কোনো স্থানে নিখোঁজের ডায়েরি হয়েছে। কিন্তু সঠিক তথ্য না পাওয়ার কারণে একজন ব্যক্তি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি ঢাকার নদী ও জলাশয়গুলোর আশেপাশে লাইটিং এবং ওয়াকওয়ে করে দিলে মানুষ হাঁটাচলা করার পাশাপাশি অপরাধীরা সহজে অপরাধ করতে পারবে না।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *