সারাদেশ

বাস মালিকদের সুবিধা দিতে রেলের কেউ বসে নেই: রেলমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবি খ্যাত গীতিকার ও কবি রজনীকান্ত সেনের রচিত স্বাধীনতার সুখ কবিতায় বাসস্থান নিয়ে বাবুই ও চড়ুই পাখির সংলাপ সবারই জানা। ‘আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে’। বাবুই পাখির উদ্দেশ্যে চড়ুই পাখির সংলাপটির বাস্তবতা বড়ই নির্মম। সমাজের খেটে খাওয়া দিনমজুরের জীবনের বিনিময়ে তৈরি হয় সেই ‘মহাসুখের অট্টালিকা’। সুউচ্চ এই সব দালানের প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে মিশে আছে শ্রমিকের ঘাম ও রক্তের ফোটা। জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নির্মম মৃত্যু হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার কিংবা সঠিক ক্ষতিপূরণ মেলে না। বরং রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিদের চাপে নামমাত্র ক্ষতিপূরণে আপস করতে বাধ্য হয় নিহতের স্বজনরা।

যেমনটা ঘটেছে রাজধানীর সবুজবাগের মায়াকাননে নির্মাণাধীন দশতলা ভবন থেকে বাঁশের মাচান ভেঙে নিচে পড়ে নিহত তিন শ্রমিকের বেলায়। চলতি বছরের ১৭ মে (শুক্রবার) সকালে ভবনের বাইরের অংশের দেওয়ালের প্লাস্টারের কাজ করতে গিয়ে তারা নিচে পড়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যায় আলতাবুর (৪০) ও অন্তর (২০) নামের দুই শ্রমিক। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায় মফিজুল (২০)। এই ঘটনায় সবুজবাগ থানায় ভবন মালিক আমিনুল হক ভূঁইয়া (৫১) ও ঠিকাদার ফারুক হোসেনকে (৪০) আসামি করে একটি অবহেলাজনিত হত্যা মামলা করেন নিহত শ্রমিক আলতাবুরের স্ত্রী আফরোজা বেগম। মামলা ১৩ দিনেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। বরং মাত্র তিন লাখ টাকায় মীমাংসা করা হয়ে গেছে।

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রলয় কুমার সাহা বার্তা২৪.কমকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তবে ঘটনার দুদিন পরেই আসামিরা নিম্ন আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তাই তাদের কাছে আমরা যেতে পারিনি।

মামলা হলেও আসামিরা মীমাংসা করার বিষয়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা নেই। আমার কাছে এই বিষয় নিয়ে কেউ আসেনিও। আর যেহেতু আসামিরা জামিনে আছে, তাই আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই।

মায়াকাননের সেই ভবনে কাজ করা একাধিক শ্রমিক ও মিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাসসহ স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি গত ২২ মে আপস করে দেন। ঠিকাদার ফারুকের বাসায় হওয়া সেই বৈঠকে বলা হয়, প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে। ঘটনার দিন হাসপাতালের খরচ ও মরদেহ বহনে গাড়ি ভাড়ার খরচ বাবদ ইতোমধ্যে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বাকি আড়াই লাখ টাকা গত ২৯ তারিখ পরিশোধ করার কথা থাকলেও কোনো টাকা শ্রমিকরা পাননি। মালিকপক্ষ আরও ৩ থেকে ৪ দিন সময় নিয়েছে। ঠিকাদার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের চাপ দিচ্ছে ১ লাখ টাকা নিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিতে। বাকি টাকা মামলা তুলে ফেলার পর দেওয়া হবে। তবে এতে স্বজনরা রাজি হননি।

তিন শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় মধ্যস্থতা করার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়টি আমি শুনেছি। আমার কাছে কেউ আসেনি। বাড়ির মালিক বা ঠিকাদারকেও আমি চিনি না। এমনকি নিহত শ্রমিকদের পরিবারের কেউই আমার কাছে আসেনি। তাই মীমাংসার মধ্যস্থতার প্রশ্নই ওঠে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৪ হাজার ৭৫৮ জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ২৪৮ জন শ্রমিক। ২০২৩ সালে বিভিন্ন পেশায় শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ৭৪২ জন। যার মধ্যে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা ১১৮ জন। আহত হয়েছেন ৬৫ জন। অর্থাৎ মোট শ্রমিকের মৃত্যুর ১৫ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিক। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত শ্রমিক নিহতের তথ্যানুসারে ২০২২ সালে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৩৪ জন। আহত হয়েছে এক হাজার ৩৭ জন। ২০২১ সালে নিহত হয়েছেন এক হাজার ৫৩ জন, আহত হয়েছেন ৫৯৪ জন। ২০২০ সালে নিহত হয়েছেন ৭২৯ জন ও আহত হয়েছেন ৪৩৩ জন। ২০১৯ সালে নিহত হয়েছেন ১২০০ জন, আহত হয়েছেন ৬৯৫ জন।

নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে ভবন থেকে পড়ে বা দুর্ঘটনায় নিহতের পাশাপাশি নির্মাণ শ্রমিকদের নির্যাতনে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। ২০২৩ সালে নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন নির্মাণ শ্রমিক।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বাইরেও বহু নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ঘটে। যা স্থানীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাবে এর সংবাদ কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। থেকে যায় আড়ালে। ফলে নাম মাত্র ক্ষতিপূরণ পেলেও পরিবারের প্রধান আয়ের মানুষটি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে অনেক পরিবার।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর বাড্ডার আফতাব নগরে একটি বহুতল ভবনের সাটারিংয়ের কাজ করতে গিয়ে মারা যান লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মমিনপুর জঙ্গরা গ্রামের আবু সাঈদের ছোট ছেলে মো. বায়েজিদ (২০)। নিজের আয় দিয়েই বয়স্ক বাবা মায়ের ভরণপোষণ করতেন বায়েজিদ। তার মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করেনি পরিবার। মাত্র ২ লাখ টাকার বিনিময়ে আপস করে নেন তারা।

বিষয়টি নিশ্চিত করে নিহতের বড় ভাই শাহিন বলেন, কাজ করতে গিয়ে ছোট ভাইটা মারা যায়। আমরা মামলা করিনি। মামলা করলেই কি হবে। বাড়ির মালিক আমাদের বাড়িতে এসেছিল। বাবাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে বলেছে এটা দিয়ে ব্যবসা করে খাইয়েন। তারা আর কোনো খোঁজ নেয়নি।

নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু ও পরবর্তীতে মীমাংসার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, শ্রমিক আইন দুর্বল হওয়ায় এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। বাংলাদেশের আইনে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ কম। ফলে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেন না। কোনো শ্রমিকের অবহেলায় মৃত্যু হলে নামমাত্র শাস্তি ও দুই লাখ টাকা জরিমানা। ফলে শ্রমিকদের স্বজনরা মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে নামমাত্র টাকার বিনিময়ে আপস করে।

শ্রমিকদের অধিকার আদায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিক গ্রামাঞ্চল থেকে আসা। ফলে তাদের হয়ে ইউনিয়নগুলো তেমন কাজ করে না। আর দু-একটি ঘটনায় কাজ করলেও সেটিও শহরকেন্দ্রিক। অধিকাংশ ঘটনায় পরিবার এগিয়ে আসে না। এর সুযোগ নিচ্ছেন ঠিকাদারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

তিনি আরও বলেন, কোনো দেশের কাজের ক্ষেত্র নিরাপদ করার দায়িত্ব সরকারের। তার জন্য শ্রম আইন রয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিককে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে তাকে জানানো। প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান করা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। মালিকপক্ষ দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটিও দেখার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো অধিকাংশ বড় বড় প্রতিষ্ঠান এটা গুরুত্ব দিয়ে দেখে না। আর সরকারের এই শ্রমিকদের কাজের বিষয়গুলো যাদের দেখার দায়িত্ব তারাও ঠিকমতো পরিদর্শন করে না। তারা কিছু বড় প্রজেক্টে গেলেও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে তারা যান না। অথচ এই সব ভবনেও বহু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *