সারাদেশ

নিচে ট্রেন, ওপর দিয়ে হেঁটে গেল হাতির পাল

ডেস্ক রিপোর্ট: আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ঘড়ির কাটা ও ক্যালেন্ডারের পাতা হাঁটবে নতুন দিনে। সেই তারিখটি ১১ নভেম্বর। এটি অন্য সবার জন্য স্বাভাবিক একটি দিন হলেও সমুদ্রনগরী কক্সবাজারের মানুষের জন্য এদিন ‌স্বপ্নের দুয়ার খোলার দিন। আর সেই স্বপ্নের দুয়ার নিজ হাতে খুলতে কক্সবাজার আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে অবসান ঘটবে এই অঞ্চলে মানুষের দীর্ঘ ৯২ বছরের অপেক্ষার। বাজবে ট্রেনের হুইসেল, রচিত হবে নতুন ইতিহাস। রেলপথে যুক্ত হবে আরও একটি জেলা। বলছিলাম দোহাজারী-কক্সবাজার ১০২ কিমি রেললাইন প্রকল্প উদ্বোধনের কথা। শুধু কি রেললাইন! সঙ্গে দ্বার উন্মোচন হবে দেশের প্রথম আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের।

এদিন প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের রেললাইনসহ ৮৮ হাজার কোটি টাকার ১৯ প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এবং মহেশখালীর মাতার বাড়িতে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। সে লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

শুক্রবার (১০ নভেম্বর) জেলা শহর ঘুরে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নিতে সাজ সাজ রব গোটা কক্সবাজারে। সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়া এলাকায় আইকনিক রেলস্টেশনের পাশের সড়কে নির্মাণ করা হয়েছে বিরাট তোরণ। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের চিত্র তুলে ধরে সাঁটানো হয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি ছেয়ে গেছে ব্যানারে পোস্টারে।

নবনির্মিত কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশর জুড়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ), পুলিশ, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সূধীমঞ্চ ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা ঘিরে রেখেছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান সার্বিক আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন।

এদিকে প্রধানন্ত্রীর আগমকে ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে উৎসবে আমেজ দেখা গেছে। আশেপাশে এলাকা থেকে শুরু করে হোটেল ও দোকানগুলোতে চলছে নানা আলোচনা। কবে প্রধানমন্ত্রী আসবেন, কোন দিকে ঢুকবেন, কি বলবেন।

ঝিলংজার জাফর মাহমুদ নামে এক দোকানি বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে দোকানে প্রধানমন্ত্রীর আগম নিয়ে আলোচনা চলছেই। কেমনে আসবেন, কী করবেন এসব। পুরো শহর সাজিয়ে ফেলছে। এই রেললাইন উদ্বোধন হয়ে আমাদের অনেক লাভ হবে। ব্যবসা হবে।’

নিঝুম দাশ নামে ঢাকা থেকে আসা এক পর্যটক বলেন, ‘রেল চালু হলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে। এখন ধরেন ঢাকা থেকে আসছি অনেক জ্যাম, জার্নি হয়েছে। ট্রেনে হলে এসবের প্যারা থাকবে না। যথাসময়ে নিরাপদে এখানে চলে আসা যাবে। সময় বাঁচবে। এটি অবশ্যই পর্যটন প্রেমীদের জন্য সুখবর।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১১ নভেম্বর সকালে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন চত্বরে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের রেল চলাচলের উদ্বোধন, সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকেট কাটবেন এবং পতাকা উড়াবেন ও হুইসেল বাজাবেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী রেল চড়ে রামু পর্যন্ত রেল ভ্রমণ করবেন।

এরপর রামু থেকে হেলিকপ্টারযোগে মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চ্যানেলের উদ্বোধন এবং প্রথম টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ি টাউনশিপ মাঠে মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন। এছাড়াও মাতারবাড়ি ১২শ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন বলে জানা গেছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘শনিবার প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকার ১৯ টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন । যার মধ্যে রেলসহ ১৫ টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৪ টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। সে লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।’

এদিকে জনসভাস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে ৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের নৌকার আদলে মঞ্চ, যেখানে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনসভা পরিণত হবে জনসমুদ্রে, এমনটাই বলছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।

তিনি বলেন, ‘মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক কয়েক লাখ মানুষের সমাবেশ হবে। সমাবেশস্থলে সামিয়ানার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মানুষের কষ্ট না হয়। এছাড়াও পানির ব্যবস্থা এবং ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে সেখানে।’

মহেশখালী-কুতুবদিয়া (কক্সবাজার-২) আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ বার্তা৪.কম-কে বলেন, ‘মহেশখালীতে ৪ লক্ষাধিক লোক আছে, কুতুবদিয়াতে ২ লক্ষাধিক, এছাড়াও আমাদের আশপাশের উপজেলা সমস্ত কক্সবাজার থেকে মানুষ আসতে চাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে আসার সময়ের, আর গাড়ির একটা বিষয় আছে। আমরা আশা করছি ৫ লাখ মানুষকে সমাবেশে উপস্থিত করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘এটি আসলে সংখ্যা গগনা নায়, একটা জনসমুদ্রে পরিণত হবে। কত লোক জনসভায় আসবে, সেটি মুখ্য বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে শেখ হাসিনা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসছেন। তিনি একটি দ্বীপ উন্নয়নের মহাযজ্ঞ তৈরি করেছেন সেই ম্যাসেজটি গণমাধ্যম দিয়ে লক্ষ কোটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে যাবে। তিনি শুধু এখানে প্রকল্প উদ্বোধন নয়, আগামী দিনের বাংলাদেশে মহেশখালী নিয়ে তার যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটিও হয় তো শুনতে পারবো।’

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সুবক্তগীন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসবেন, যিনি খুবই রেলবান্ধব এবং রেলে জন্য অনেকে কিছু করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে আমরা এই প্রকল্পটা করতে পেরেছি। আমরা আশা করছি শনিবার সকাল ১১ টার মধ্যে তিনি আমাদের এই ভেন্যুতে অসবেন। এখানে সুধী সমাবেশে প্রকল্প সম্পর্কিত এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত বক্তব্য রাখবেন।’

তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে রেলে করে আমরা রামু পর্যন্ত নতুন রেল লাইনে নিয়ে যাব। আমরা রেল লাইনটা ৮০ কিলোমিটার গতিতে যাবে এভাবে তৈরি করেছি। কিন্তু শনিবার আমরা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটু কম গতিতে যাব। রামু থেকে উনি পরবর্তী প্রোগ্রামটা করবেন।’

এদিকে এবারসহ গেলো ১৫ বছরের ১৩বার কক্সবাজার সফরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবশেষ ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজার প্রধানমন্ত্রী।আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রয়াসে সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকার ৯৮ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কক্সবাজার বদলে গেছে। জনসভা শেষে বিকেলে ঢাকায় ফিরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জানা গেছে, রেলপথ নির্মাণের আগে কক্সবাজারের সঙ্গে কোনো রেল যোগাযোগ ছিল না। শুরুতে এটি ছিল দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণের কথা ছিল। পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার।

রেল নেটওয়ার্কের বাইরে থাকা পর্যটন নগরীতে ট্রেন নিতে প্রকল্পটি ২০১০ সালে অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প সংশোধনে ব্যয় বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *