সারাদেশ

‘একতা ও বৈচিত্র্যই ভারতের প্রধান শক্তি’

ডেস্ক রিপোর্ট: ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে মূল্যায়ন তুলে ধরে দিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং ও. পি. জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, ইউনিটি অ্যান্ড ডাইভারসিটিই ভারতের মেইন স্ট্রেন্থ। এই নির্বাচনেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।

ভারতের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে মূল্যায়ন জানাতে মঙ্গলবার (৪ জুন) বিকেলে মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বার্তা২৪.কম: ভারতের এবারের নির্বাচন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: এখন অবধি যেটি বুঝতে পারছি, এনডিএ মেজরিটি পাচ্ছে নিশ্চয়ই কিন্তু চারশ’ পাবে বলে যে প্রচার করেছিল তা পাচ্ছে না। যেটা বোঝা যাচ্ছে, তিনটি প্রদেশে একটু অন্যরকম ফল এসেছে-বাংলা, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশ। যেটা বলা হচ্ছে যে, ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের ভোট ইন্ডিয়া জোট বা কংগ্রেসের কাছে যাচ্ছে, নারীদের ভোটও বিজেপি বিরোধীদের কাছে যাচ্ছে। আর…আমার যেটি নিজস্ব ধারণা, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, কিন্তু বেকারত্বের হার এখনো অনেক বেশি। সেখানে তারুণ্য ফ্যাক্টর হিসেবে খুব কাজ করেছে। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে একটা অংশে মুসলিম ফ্যাক্টর কাজ করে, আরেকটা ব্যাকওয়ার্ড ফ্যাক্টর কাজ করে…আর ইয়ুথ ফ্যাক্টর কাজ করেছে। একেবারে সঠিক করে বলা যাবে না যে কোন কোন ফ্যাক্টর কাজ করেছে। কিন্তু আমার ধারণা হচ্ছে…আমরা যেটা দেখছিলাম, বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলছিলাম; আপনাদের ওখানে (বাংলাদেশে) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেক বেশি, এখানেও এই ফ্যাক্টরগুলো বিজেপির বিরুদ্ধে কাজ করেছে। যে কারণে এনডিএ ভালো করেছে। তিনটি টাইমে এন্টি-ইন্টেম্পেন্সি কাজ করেছে, সেজন্য ৩০০ তারা করে নিয়েছে। সেটা তো নিশ্চয়ই ভালো বলব। কিন্তু ওরা যে (বিজেপি) হাইপটা রেখেছিল ৪০০, সেটা হবে না।

বার্তা২৪.কম: আরেকটি বড় বিষয় আলোচনায় এসেছে, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, ভারতে ঐতিহাসিকভাবে পরম্পরা আছে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু এবারে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় অনুষঙ্গকে ব্যবহার করেছে ভোটের প্রচারে। এটা কি ভারতের রাজনৈতিক ক্রমবিবর্তনের একটি বাস্তবতা কিনা?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: অনেক সময় আমাদের একাডেমিয়াতেও আলোচনা হয়, গেল ১৫ বছর ধরে যে একটা পার্টিকুলার একটি ধর্মকে বেশি ফোকাস দেওয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু ভারত নয়। আমি সেই ভারতে বড় হয়নি, সেই ভারতে আমি থাকি না। আমি এখনো বিশ্বাস করি, সেক্যুলার ফেব্রিকটা আমাদের সবার কাছে অনেক বড়। যে হিন্দু তার কাছেও বড়, যে মুসলিম বা অন্য ধর্মের, তার কাছেও বড়। এই সরকার কাজ করেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই; আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার বেড়েছে, আমাদের ইকনোমিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছে, নিশ্চয়ই সেগুলো তো হয়েছে। তারা ৪০০ আসন পাবে না, ৩০০ হবে কোন রকমে, এতে স্পষ্ট যে ধর্মীয় ফ্যাক্টরটা আমাদের এখানে এতটা কাজ করে না। কিছুটা একটা কাজ করে, সেটা অস্বীকার করলে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু সেই শতাংশটা কম। আমাদের তো হিন্দু মেজরিটি দেশ। তার মধ্যেই আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে থাকতে চাই। এখানে কাউকে বেশি জোর দেওয়ার বা কাউকে অন্যদৃষ্টিতে দেখা সেটা আমরা কেউ পছন্দ করি না। সেটা বোধহয় আরও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

বার্তা২৪.কম: এ ভারতবর্ষ তো বিবেকানন্দের ভারতবর্ষ, নেতাজীর ভারতবর্ষ…

ড. শ্রীরাধা দত্ত: অবশ্যই। বিজেপি অনেক কাজ করেছে, অনেক গুণ আছে, সেটা আলদা। কিন্তু ‘হিন্দুত্ব’ আসপেক্টটা বোধহয় সবাই বিশ্বাস করে না। সেই হিসেবে দেখতে গেলে, বাইরের দেশের যে আশঙ্কা ছিল-ভারতবর্ষ কি পাল্টে যাচ্ছে কিনা! আপনি নিজেও যেটি বললেন, স্বামী বিবেকানন্দের ভারতবর্ষ, নেতাজীর ভারতবর্ষ কি এখনকার ভারতবর্ষ নয়? আমার নিজস্ব মত হচ্ছে, চিরকাল যে ভারতবর্ষ ছিল, সেটা থাকবে। ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স-ডমেস্টিক পলিটিক্স-এ ওপর নিচ হতেই থাকবে। কিন্তু আমার যেটা মেইন স্ট্রেন্থ ‘ইউনিটি অ্যান্ড ডাইভারসিটি’ সবখানেই আমরা এটা বলি..আমাদের তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রে যতটা তফাৎ আবারও কোথাও গিয়ে আমরা ঠিকই মিলে যাই এক জায়গায়। ভারতে দেখুন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে বিভেদ কাজ করে না। এত বড় দেশে তো সব নিরঙ্কুশ হবে না। সবখানেই কিছু মানুষ ধর্মটাকে বিভেদের হাতিয়ার করতে টেনে আনে। আমেরিকাতে কি নেই? আমরা দেখেছি ট্রাম্প কি করে গেছেন। আমরা সেক্যুলারিজমের ফেব্রিকটাকে তুলে রাখতে সব সময় চেষ্টা করি।

বার্তা২৪.কম: নতুন যে সরকার আসছে তাদের বড় চ্যালেঞ্জ কি হবে বলে আপনি মনে করেন?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: আমরা ইতোপূর্বে সংসদে বিরোধীদের অনেক দাবি সেভাবে মানেনি তা দেখেছি কিন্তু এবার তা হবে না। এখন বিরোধীদের জোর থাকবে সংসদে। সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। আপাতত একটি বিষয় যা আমি বললাম, বেকারত্বের বিষয়টি দেখতে হবে। আমরা এখন ৩ ট্রিলিয়নের ইকোনমি, কিছুদিন পর ৫ ট্রিলিয়নের ইকোনমি হবে-আপনাদের দেশেও দেখবেন, বড়লোকরা বড়লোক হয়েছে, গরিবেরা আরও গরিব হচ্ছে। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে। দেখতে হবে মাঝখানে যারা মিড্ল ক্লাস আছেন তাদেরকেও। ইউক্রেন-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ বলুন কিংবা সমুদ্রপথগুলো অনিরাপদ হয়ে গেছে, অর্থনীতি তো এসব কারণে খারাপ হয়েই আছে। তারপরেও অর্থনীতি কিভাবে সবার কাছে পৌঁছে যায়-সেটা নতুন সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের কথা তো ভাবতেই হবে।

বার্তা২৪.কম: এই নির্বাচনে অন্যান্য দলগুলোর যে অঙ্গীকার ছিল সেই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: এখন যা দেখছি তাতে রিজিওনাল পার্টিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। কিন্তু উড়িষ্যাতে সেটা সেটব্যাক হয়েছে। রিজিওনাল পার্টি যে এতবছর ধরে ছিল, আমাদের জ্যোতিবসু দীর্ঘদিনের চিফ মিনিস্টার ছিলেন, সেখানেও সেটব্যাক হয়েছে। রিজিওনাল পার্টিগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। অনেক স্থানে হেভিওয়েটরা পরাজিত হয়েছেন। কিছু জায়গাতে মানুষ পরিবর্তন চাইছে। মহারাষ্ট্রে রিজিওনাল পার্টি খুব চমৎকার করেছে, কেউ ভাবেনি। রিজিওনাল পার্টির ভূমিকা বেড়েই চলেছে। আগে আমরা দেখতাম ন্যাশনাল পার্টিগুলোর খুব ইনফ্লুয়েন্স থাকে, কিন্তু এই নির্বাচনে রিজিওনাল পার্টিগুলোর জায়গাটা ভালো দেখছি।

বার্তা২৪.কম: রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটি ভারতের রাজনীতিতে পূর্বের সঙ্গে বর্তমানের কতখানি বৈপ্যরীত্য হাজির করছে?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: এই সমস্যাটা তো আছেই। এর আবার উল্টো উদাহরণ হচ্ছে, উড়িষ্যাতে যিনি হারলেন তিনি তো দুর্নীতির জন্য হারেননি। আবার অনেক স্থানে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তারা নির্বাচনে বেরিয়ে এসেছেন। এই দুই ধরণের দৃষ্টান্তই আছে। সব সময় যে এক জিনিসই কাজ করছে তা নয়। উড়িষ্যাতে পরিষ্কার ইমেজ, স্বচ্ছ সরকার-সেখানে অনেকে বলছেন-উন্নয়ন হয়নি বলে তাদের সরে যেতে হয়েছে। আবার দেখুন গুজরাটে বড় প্রকল্প হচ্ছে, দুর্নীতি তো আছে, ফুটে উঠেছে। কিছু জায়গায় পিছিয়ে যেতে হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় এগিয়েও গেছে।

বার্তা২৪.কম: জনগণের মধ্যেও এই প্রবণতা ছায়া ফেলছে তাহলে…

ড. শ্রীরাধা দত্ত: জনগণ সব নজরে রাখছে। দুর্নীতি নিয়ে কথা-বিতর্ক সবই চলছে। সবাই বিরক্ত, এই জিনিসটা কেউই চায় না। ইনডিভিজ্যুয়াল লেবেলে কিছু করাও সম্ভব না।

বার্তা২৪.কম: কেজরিওয়াল বা অন্য অনেক রাজনীতিকদের অবদমিত রাখার চেষ্টা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপ কতখানি সেখানে কাজ করছে?

ড. শ্রীরাধা দত্ত: কিছু উদাহরণ তো আপনারা দেখছেনই, দিল্লির চিফ মিনিস্টারকে যা করা হল..। সব দলই যখন সেন্ট্রালে হেভি থাকে তারা চেষ্টা করেছে। ইডি দিয়ে বা এজেন্সি দিয়ে চেষ্টা করে। আবার মানুষ যখন ভোটে তাদের বিদায় করে দেয়..জম্মু-কাশ্মীরে দেখুন। কাশ্মীরে যিনি জেলে বন্দি, তার ছেলে ক্যাম্পেইন করে জিতে গেল। তার মানে মানুষ তো বুঝতে পারে, তাকে অকারণে ভেতরে রাখা হয়েছে, যার কোন যুক্তি নেই। মানুষের চিন্তা-ধারা বা বোঝার ক্ষমতাকে যদি আমরা ঠিক করে না বুঝি তাহলে সমস্যা। অনেকেই আছেন যারা দুর্নীতির জন্য টিকেট পায়নি, মানুষ সাপোর্ট দেয়নি-এমনও আছে। ভোটারদের একটা নিজস্ব চিন্তাধারা আছে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *