সারাদেশ

১ দশক পর পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদ

ডেস্ক রিপোর্ট: ২৩ বছর আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মো. ওমর ফারুককে জন্ম দিয়েছিলেন রিনা আক্তার চন্দনা। ছেলেকে জন্মদানের আগে-পরে এই নারীকে সইতে হয়েছিল মৃত্যুযন্ত্রণা। অস্ত্রোপচারের সেলাইয়ে সংক্রমণ হওয়ায় দেড়মাস হাসপাতালের বিছানায় থাকতে হয়েছিল তাঁকে। সেই যাত্রায় বেঁচে ফিরলেও আর কোনোদিন মা হওয়া হয়নি তাঁর। কেননা ওই সময়ে নানা ওষুধ সেবনের কারণে সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন এই গৃহবধূ। যে সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে এত এত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছিলেন সেই ছেলেটাই কিনা মাকে খুন করলেন অজস্র ব্যথা-কষ্ট ‘উপহার’ দিয়ে।

একটা-দুটা নয়, মা রিনা আক্তারের যে শরীরে একদিন একটু একটু করে বেড়ে ওঠেছিলেন সেই শরীরে দায়ের ৪৫টি কোপ বসিয়েছেন ফারুক। ঘটনাটি রোববার (২ জুন) দিবাগত রাত ১০টার। ওইদিন ওমর মাদক কেনার জন্য মায়ের কাছে টাকা চান। মা টাকা না দেওয়ায় ঘরে থাকা দা দিয়ে মায়ের শরীরে উপর্যুপরি আঘাত করে ওমর। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ৪৭ বছরের ওই নারী। পরে স্থানীয়রা ধাওয়া দিয়ে ওমরকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

নিজের মাকে কেউ এমনভাবে হত্যা করতে পারেন-প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। তাঁরা বলছেন, এতটা নৃশংসও হতে পারে মানুষ? অবশ্য মাকে এভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেওয়ার পরও কোনো অনুশোচনাই ছিল না ওমরের। সোমবার (৩ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) মর্গে পড়ে রিনা আক্তার চন্দনার শরীরে কোপের এত এত দাগ দেখে ডোমও যেখানে যখন আৎকে উঠছেন বারবার, পুলিশ হেফাজতে থাকা ওমর তখন ফুরফুরে মেজাজে খাচ্ছিলেন দুপুরের খাবার।

ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রীকে কী যে যন্ত্রণা সইতে হয়েছিল সেটি তুলে ধরছিলেন আকতার হোসেন। সব হারিয়ে নিঃস্ব এই অটোরিকশা চালকের চোখের পর্দায় যেন বারবার ভেসে আসছিল সেই ভুলতে না পারা দৃশ্য, হাসপাতালকে বাড়ি বানিয়ে ফেলা, স্ত্রীর কত শত যন্ত্রণা-কষ্ট সব সব।

আকতার হোসেন বলেন, রিনা আক্তার আমার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। একমাত্র মেয়েকে রেখে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে বেশ চাপ দেন আবার বিয়ে করতে। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে সবার চাপে মেয়ে বড় হলেই বিয়ে করার ইচ্ছের কথা জানাই। প্রায় ২৫ বছর আগে রিনাকে বিয়ে করি। বিয়ের দুই বছরের মাথায় আমার মেয়েটি কুকুরের কামড়ে মারা যায়। কুকুর কামড়ালে আমরা না বুঝে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাই। টিকা না দেওয়ায় জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মেয়েটি মারা গিয়েছিল। এরপর রিনার গর্ভে আমার ছেলে ওমরের জন্ম হয়।’

ওমরকে জন্ম দিতে গিয়ে রিনাকে অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করার সেই মুহূর্তুগুলো তুলে ধরেন আকতার। বলেন, ‘সংক্রমণ আর নানা ওষুধ সেবনের কারণে রিনা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়েন। সেজন্য আমরা দুজন এই ছেলেকে নিয়েই জীবন পার করতে চেয়েছিলাম। তাঁকে ঘিরেই আমাদের সব স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন আমার সব শেষ। স্ত্রীকে হারালাম। এখন মাকে খুনের ঘটনায় ছেলে জেলে গেল। আমার আর কেউ রইল না।’

যদিওবা একমাত্র ছেলে ওমরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার কম চেষ্টা করেননি মা-বাবা। আকতার দিনভর গাড়ি চালালেও কখনো ছেলেকে কষ্ট করতে দেননি। করোনার আগে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ওমর। এরপর ভাটিয়ারীর একটি কলেজে ছেলেকে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু কলেজে যাওয়ার কথা বলে প্রতিদিন বাসা থেকে বের হলেও তিনি কলেজে যেতেন না। পড়ে যান ‘খারাপ’ বন্ধুদের চক্করে। ২০২১ সালের দিকে শুরু হলো নেশায় পড়া। টের পাওয়ার পর মা-বাবা বহু চেষ্টা করেছেন ফেরাতে। কিন্তু পারেননি। বাবা বাসায় না থাকলেই মাকে চাপ দিতেন মাদক কিনতে টাকা দিতে। টাকা না পেলেই মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করত ওমর। তবুও ছেলে একদিন ভালো হয়ে যাবে, নেশামুক্ত হবে-সেই আশায় সব সহ্য করে যাচ্ছিলেন মা-বাবা।

ঘটনার দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠলে মা-বাবা ওমর ফারুককে নানাভাবে বোঝান। বলেন, এভাবে জীবন চলে না বলেও সান্ত্বনা দেন। মা-বাবার সেই অনুরোধ কানেই নেননি ওমর। রাতে এসে পুনরায় মাকে টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। টাকা দেবেন না বলতেই বটি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মায়ের ওপর।

মাকে খুন করার পর পালিয়ে যাচ্ছিল ওমর। ঘটনাচক্রে তখন খুলশীর পাঞ্জাবি লেনের পুলিশ বিট মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন আকতার। তখন দেখতে পান বটি হাতে এক তরুণ দৌড়াচ্ছে আর পেছন থেকে তাঁকে ধাওয়া দিচ্ছেন মানুষজন। কৌতুহল হয়ে গাড়ি থেকে নামতেই যেন আকাশ থেকে পড়েন আকতার। দেখতে পান যে প্রাণপণ দৌড়ছে সে তারই ছেলে ওমর। কাছে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইতেই স্থানীয়রা বলেন মাকে খুন করে পালাচ্ছে ওমর। পরে আকতার দৌড়ে বাসায় গিয়ে দেখেন ঘরে পড়ে আছে স্ত্রীর ক্ষতবিক্ষত দেহ।

সেই দৃশ্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আকতার হোসেনকে। বললেন, ‘ছেলেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে কতই না চেষ্টা করলাম। পারলাম না। রিনা মা হিসেবে যেমন দুর্দান্ত ছিলেন, তেমনি স্ত্রী হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। এরকম মাকে কেউ খুনতে পারে?’

রিনার শরীরে ছেলের ৪৬ কোপ:

ছিন্নভিন্ন হওয়া মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় এত এত আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ সদস্যরাও হয়ে পড়েন বেদনাহত। রিনা আক্তারের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন করেন পাহাড়তলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘সুরতহাল প্রতিবেদন করতে গিয়ে গুণে দেখি এই মায়ের দেহে ৪৬টি কোপের চিহ্ন। এমন ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আমরাই কাতর হয়ে পড়েছি। নিজের গর্ভধারিণী মাকে কেউ এত নৃশংসভাবে খুন করতে পারেন ? কোনো শত্রুকেও তো মানুষ এত কষ্ট দিয়ে মারতে পারেন না।’

চমেক হাসপাতালের মর্গে রিনা আক্তারের ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কাটার দায়িত্ব সামলেছেন ডোম কদম আলী। এই কদম আলীর ঝুলিতে বহু লাশ কাটার অভিজ্ঞতা। কয়েকশ লাশ কাটা সেই ডোমও রিনার শরীরে এত এত কোপ দেখে কষ্ট পেয়েছেন। বলেন, ‘এই নারীর দেহ এতটাই ক্ষতবিক্ষত ছিল তাঁর শরীরের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না। শুনেছি ছেলেই তাঁকে কুপিয়ে খুন করেছে। মাকে কেউ এভাবে কোপাতে পারে ভাবতেই পারছি না। খুনের উদ্দেশে যে কোপানো হয়েছে তা বোঝা যায় মায়ের মাথার দিকে তাকালে। মাথাতেই সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয়েছে।’

মাকে খুনের ঘটনায় বাবার করা মামলায় ওমর ফারুক এখন জেলে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমাম হোসেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘কারও মনে এমন নৃশংসতা একদিনে তৈরি হয় না। এই ছেলে মাকে খুন করার পর্যায়ে চলে গেছে, তাহলে বুঝতে হবে সে নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এটাকে আমরা বলি- ‘হলিস্টিক এপ্রোচ’। এই সময়ে মানুষ যখন নেশার জন্য যখন উদগ্রীব হয়ে পড়ে তখন কে মা, কে বাবা সেটি বুঝবে না। যেই তাঁকে বাধা দেবে তাঁকে মনে হবে শত্রু। তাঁদের হয় কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিতে হবে, না হয় নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে সংশোধন করতে হবে।’

বাংলাদেশের প্রতিটি অলি-গলিতে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মাদক যতদিন বন্ধ হবে না, ততদিন এগুলোও চলতে থাকে। মাদক বন্ধ করা না গেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে চরম বিপর্যয়ে পড়তে হতে পারে।’

সন্তানের হাতে স্ত্রী খুন। সেই খুনের ঘটনায় জেলে যাওয়া ছেলে শাস্তির অপেক্ষায়। ফলে আপন বলতে আর কেউ রইল না আকতার হোসেনের। চোখে জল আর মনে একরাশ হতাশা নিয়ে তাই আকতার বললেন, ‘মাদকাসক্ত ছেলে নিজেকে ডোবাল, আমার সবও শেষ করল। ছেলের ফাঁসি হোক। তবে আরও বেশি খুশি হতাম যদি ক্রসফায়ার দিতো।’

আকতার হোসেনের কণ্ঠে যেন একদিকে প্রিয় স্ত্রীকে হারানোর অবর্ণনীয় বেদনা, অন্যদিকে তারও অধিক প্রিয় ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে না পারার দুঃখ-আফসোস!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *