আন্তর্জাতিক

আজ শুরু হচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কর্মযজ্ঞ

ডেস্ক রিপোর্ট: ছিল লবণমাঠ। তাই বছরের বেশিরভাগ জুড়ে চলত লবণ উৎপাদনের তোড়জোড়। বঙ্গোপসাগর উপকূলের সেই লবণমাঠেই বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খননযন্ত্র ‘ক্যাসিওপিয়া–ফাইভ’ দিয়ে বালু–মাটি খনন করে বানানো হয়েছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল। শুধু কি তাই-ঢেউ আর পলি জমা ঠেকাতে সাগরের দিকে নৌপথের দুই পাশে পাথর ফেলে তৈরি করা হয়েছে স্রোত প্রতিরোধক পাথরের বাঁধও। যাতে জাহাজ জেটিতে থাকলে দুলবে না। ফলে পণ্য খালাস করা যাবে সহজেই।

শনিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে বঙ্গোপসাগরের তীরে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ‘অসম্ভবকে সম্ভব করে’ নির্মাণ করা এই চ্যানেলের দ্বার খুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। চ্যানেল তো চালু হচ্ছে, এবার বহুল প্রত্যাশিত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ শুরুর ভিত্তিপ্রস্থরও স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে সূচনা হবে নতুন দিগন্তের।

সাগর থেকে নৌপথে ঢোকার মুখে হাতের ডানে নির্মিত হবে টার্মিনাল। কদিন আগে সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এই গভীর সমুদ্রবন্দরকে সিঙ্গাপুরে পরিণত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সবকিছু করা হবে। আর এই বন্দের নির্মাণের যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও গভীর সমুদ্রবন্দর। এই বন্দরে আট থেকে ১০ হাজার কনটেইনার ও কমপক্ষে এক লাখ মেট্রিক টন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে।

এই গভীর সমুন্দ্রবন্দরকে ঘিরে সিঙ্গাপুরে পরিণত করার স্বপ্ন দেখার কারণও আছে। কেননা সমুদ্রের একই তীরে যে আছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে হাতছানি দিচ্ছে বিপুল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন বছরের মধ্যেই গভীর সমুদ্রবন্দর তার অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এর মধ্যেই প্রথম টার্মিনালে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে ৭০ কিলোমিটার দূরে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। সেপ্টেম্বরে জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে টার্মিনালের নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহ্বানের পর কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল জানিয়েছেন, জাপান সরকারের সহায়তায় জাইকার অর্থায়নে এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রধান বিষয় হলো, সাগরের চ্যানেল। এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাতারবাড়ি সফরে সেই চ্যানেলটি উদ্বোধন করবেন। আর গভীর সমুদবন্দরের টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তরও হবে একইদিন। তিনি আশা করছেন, তিন বছরের মধ্যে প্রথম টার্মিনালের কাজ শেষ করে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন তারা।

বন্দরের চ্যানেল নির্মাণের কাজ এগিয়ে গিয়েছে মূলত মাতারবাড়িতে এরই মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য। কেননা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণের জন্য সামগ্রী বহনকারী জাহাজ ভেড়াতে চ্যানেল খননের প্রয়োজন পড়ে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) সেই চ্যানেলটি খনন করে। ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৩৫০ মিটার প্রশস্ত ও ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর এই চ্য্যানেলটিই এখন দেশের সবচেয়ে গভীর চ্যানেল। এ ছাড়া সিপিজিসিবিএল সেখানে একটি জেটিও নির্মাণ করেছে।

চ্যানেলটি শনিবার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলেও এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে আরও তিন বছর আগে। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার একটি জাহাজ ভেড়ার মধ্য দিয়ে চ্যানেলটি চালু হয়। এরপর গত তিন বছরে ১২৩টি জাহাজ প্রকল্পের সরঞ্জাম ও কয়লা নিয়ে এ চ্যানেল অতিক্রম করেছে। গত সাত মাসে প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভিড়েছে বিশালাকৃতির ১০টি জাহাজ। ট্রায়াল বেসিসে সেই চ্যানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টন পণ্য নিয়েও জেটিতে জাহাজ এসেছে। এটি চট্টগ্রাম বন্দরে যে জাহাজ আসে, তার দ্বিগুণ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। চ্যানেল দিয়ে জাহাজ হ্যান্ডলিং শুরু হবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে চ্যানেলটির নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর।

বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জেটি ও ১৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটসহ (জাহাজের নিচের অংশ) ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি বহুমুখী জেটি নির্মাণের কাজ শুরু হবে। একইসঙ্গে একটি কনটেইনার ইয়ার্ডসহ আনুষাঙ্গিক স্থাপনাও নির্মাণ হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটির অদূরে ও সাগর উপকূল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে নির্মাণ হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল।

গভীরতা কম হওয়ায় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ৯ মিটার ড্রাফট হলেই জাহাজ ভিড়তে পারে না। ৯ মিটারের কম ড্রাফটের জাহাজে দুই হাজারের বেশি কনটেইনার পরিবহনও সম্ভব নয়। মাতারবাড়ি গভীর সমুন্দ্রবন্দর নির্মাণ হলে দূর হবে সেই সংকট। তখন বাংলাদেশ থেকে রফতানি পণ্য নিয়ে কোনো জাহাজকে আর ট্রানজিট বন্দরে যেতে হবে না। আমদানি পণ্য নিয়েও ট্রানজিট বন্দর হয়ে আসতে হবে না। এতে সময় ও খরচ বেঁচে যাবে। এখন বাংলাদেশ থেকে পোশাক সংশ্লিষ্ট যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয়, সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে প্রথমে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো নিতে হয়। সেখান থেকে বড় বড় মাদার ভ্যাসেলে করে পাঠাতে হয় ইউরোপ-আমেরিকায়। এখানে লোডিং-আনলোডিংয়ের খরচ এবং সময়ের একটা বিষয় থাকে। জাহাজের ভাড়াও বেশি লাগে। বিশ্বের যেকোনো দেশে পণ্য পাঠানো কিংবা সে দেশ থেকে পণ্য আনার খরচ বেড়ে যায়। এতে পণ্যের দর বাড়ে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে অনায়সেই, ফলে আর ট্রানজিট বন্দর হয়ে ঘুরে যেতে হবে না।

এ ছাড়া ভারতের ‘ল্যান্ডলকড’ সাতটি অঙ্গরাজ্য পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এ বন্দর ব্যবহার করতে হবে। ভারত, নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও চীন সরাসরি এ বন্দর ব্যবহার করে সুফল পাবে।

সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলে, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর দেশের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ হবে বলে মনে করছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলে, ‘ভারতের সেভেন সিস্টার্স, মানে ল্যান্ডলকড রাজ্যগুলোর পণ্য গভীর সমুদ্রবন্দরে খালাস হয়ে আমাদের সড়কপথ ব্যবহার করে সেখানে যেতে পারবে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ গভীর সমুদ্রবন্দর হবে।’

এই গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে এশিয়ার অন্তত ৩০০ কোটি মানুষ সুফল পাবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল। তিনি বলেন, এই গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং চীনসহ আরও কয়েক দেশের অন্তত তিন শ কোটি মানুষ সুফল পাবেন। আর আমাদের অর্থনীতিতে অন্তত ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও আসবে।’

বাংলাদেশের সক্ষমতার পালকে নতুন করে যুক্ত হওয়া অসাধারণ এই উদ্যোগের পেছনে আছে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কদিন আগে মাতারবাড়ি সফরে গিয়ে সেটিই যেন বলছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ি বন্দরের আবিষ্কারক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা কেউ চিনতাম না মাতারবাড়ি। প্রধানমন্ত্রীই কিন্তু এ মাতারবড়িকে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, তাবৎ দুনিয়ার সবাই জানছে যে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে মাতারবাড়ি।’

আজ সেটি নির্মাণের সূচনা হবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *