এ আর রহমানের বিরুদ্ধে দেশিয় শিল্পীদের প্রতিবাদ
ডেস্ক রিপোর্ট: অস্কারজয়ী ভারতীয় সংগীতকার এ আর রহমানের ভক্ত এ দেশেও কম নয়। বাংলাদেশের শিল্পীরাও তার ভক্ত। কিন্তু এবার এমন কী করলেন যার জন্য শিল্পীরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন!
ঘটনার সূত্রপাতহ সদ্য প্রকাশিত বলিউডের সিনেমা ‘পিপ্পা’র একটি গান নিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ ব্যবহার করা হয়েছে ছবিটিতে। সেটি হতেই পারে, তা নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু বিপত্তিটা বেঁধেছে এই ছবিতে ব্যবহৃত এই গানটির সুর নিয়ে। কারণ, গানটির কথা ঠিক রেখে মূল গানের সুর পুরোটাই বদলে ফেলেছেন এ আর রহমান। ৭ নভেম্বর এই গানটি এ আর রাহমান নিজের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছেন। মূলত এর পর থেকেই দুই বাংলায় শুরু হয়েছে গানটি প্রত্যাহার করার প্রতিবাদ আর সুর বিকৃত করার অভিযোগ।
প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী তার ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, ‘‘দুই বাংলার প্রানের কবি, আমাদের দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর এবং অবিস্মরণীয় এক সৃস্টি এবং সেই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনসহ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলনে জাতিকে অসাধারণ অনুপ্রেরনা দেয়া কালজয়ী অমর সেই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিকে নুতন করে সুর দিয়ে বিকৃত করেছে সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান ‘পিপ্পা’ নামের ছবিটায়। অবাক এবং বিষ্মিত হয়েছি।’’
তিনি আরও লেখেন, ‘‘গানটি সরকারীভাবে বন্ধের জন্য অনুরোধ করছি। অবিলম্বে এ গানটি অপসারন এবং নিষিদ্ধ করা হোক। আমরা খুবই লজ্জিত বোধ করছি। এ আর রহমান নিজেই গুণী সুরকার। নিজের সুরে অন্য কথায় ছবির প্রয়োজনের গান করতেই পারতেন। সঠিক সুরে গানটি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাদের জাতীয় কবির প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আজকাল কোন কিছু লিখতে যদিও ভালো লাগেনা। তবু এ অসম্মান নেয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবাদ জানালাম। আশা করি সবাই প্রতিবাদ করবে।’’
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রকৌশলী ও শিল্পী মুস্তাফা খালিদ পলাশের দেওয়া একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘‘১৯৭০-এর উত্তাল সময়ে ‘‘জীবন থেকে নেয়া’’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত দুটি গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ আর কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ বাঙালী স্বত্বায় চিরন্তন সত্যের মতো দীপ্যমান।
ওটিটি মাধ্যমে প্রকাশিত চলচ্চিত্র ‘পিপ্পা’তে ব্যবহৃত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সেই ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি। ছবিটি দেখা হয়নি কিন্তু গানটি শুনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছি। সুরশ্রষ্ঠা এ আর রহমানের হাতে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি অপঘাতাক্রান্ত হয়েছে। তিনি নিশ্চিত একজন কিংবদন্তী কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি সেচ্ছাচার করতে পারেন। এমন একটি গানের বিকৃতি আমাদের বাঙ্গালী স্বত্বার প্রতি এক মারাত্মক আঘাত। এ আর রহমানের এমন ধৃষ্টতার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
আমি মনে করি জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির বিকৃত সংস্করণটি বর্জন ও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা অত্যন্ত জরুরী।
পুনশ্চ : মনে আছে আমাদের এখানে একটি টিভি বিজ্ঞাপনে কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটি কিছুটা বিকৃত করে গাওয়া হয়েছিলো যা পরে জনপ্রতিবাদে ও সরকারের হস্তক্ষেপে বাদ দেয় হয়।’’
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘‘আব্দুর রহমান মিয়া! কারার ঐ লৌহ কপাট গানটা কি তোর বাপের সম্পত্তি রে ? তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তোর বিচার এবং নূন্যতম ১০০ কোটি টাকা জরিমানা আশা করছি।’’
বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে গত শুক্রবার রাতে এক ভিডিও বিবৃতির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নজরুল সংগীত সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। শাকিল বলেন, ‘‘এটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত একটি গান। যে গানটি ব্রিটিশ স্বদেশী আন্দোলনের সময় রচিত হয়েছিল। সেই সময় এটি বিপুলভাবে জনমনে নাড়া দিয়েছিলো। তাই নয়, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময়ও এই উদ্দীপনামূলক গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস যুগিয়েছিলও ও উদ্বুদ্ধ করেছিল। এমন একটি গান নিয়ে সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করেছি ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত সুরকার খুবই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এই গানকে নতুনভাবে সুরারোপ করেছেন। এই কাজটি করে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে অসম্মান করেছেন। এবং তিনি প্রতিটি বাঙালির মনে আঘাত করেছেন। এই কাজটার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’’
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা ও দেবজ্যোতি মিশ্র শুধু বাংলাদেশের শিল্পী, সমালোচক কিংবা সচেতন দর্শক-শ্রোতাই নন, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরাও রাখঢাক না রেখেই এ আর রাহমানের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। ভারতের অন্যতম সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘আমার যেন মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি! মনে হলো স্বপ্ন ভেঙে উঠে দেখব আসলে এ রকম কিছু ঘটেনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই গানটি তো কবিতা আকারেও রয়েছে। তা হলে কি আমার বন্ধু রাহমানকে শুধু কবিতাটি দেওয়া হয়েছিল? তার পরেও কিন্তু এটা অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ। আদালতে কি রাহমান সেটা স্বীকার করবেন যে, এটা তার করা সংগীত? যদি তাকে গানটি নতুন ভাবে সুর করতে দেওয়া হয়, তা হলেও বলতে পারি আমার বন্ধুটি প্রকৃতিস্থ নন।’’
ভারতের জাতীয় পুরস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আজকে রহমানের ‘রোজা জানেমান’ গানটির আমি যদি বাউল আঙ্গিকে সংগীতায়োজন করি, সেটা নিশ্চয়ই শ্রোতাদের পছন্দ হবে না। তাই সবার আগে শিল্পীকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত।’’
অনেকটা একই প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়লেন ভারতের পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমার ভালো লাগেনি। ওর (এ আর রাহমান) মতো অত্যন্ত সুপরিচিত সুরকারের কাছে আমরা এটা আশা করি না। সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানো উচিত।’’ অজয় চক্রবর্তী এটাও মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনায় কাজী নজরুল ইসলামের পরিচিতি কম হয়ে থাকার নেপথ্যে দায় বাঙালি জাতির। তার কথায়, ‘আমরা ওর (কাজী নজরুল ইসলাম) সম্পর্কে ততটা জানি না। কিন্তু সংগীতের বহু ক্ষেত্রে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তুলনায় নজরুল ইসলামের অবদান বেশি।’’
এ আর রাহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর। তিনি বললেন, ‘‘ওর কাছে নিশ্চয়ই তথ্য ছিল বলেই ও সাহস পেয়েছে। আসলে আমাদেরও প্রচুর ত্রুটি রয়েছে। এই ধরনের গান বাঙালিদের মনে একটা অন্য অর্থ বহন করে। সেখানে নাড়া দিলে তো ভালো লাগবে না। ওর (রাহমান) আরও গবেষণা করে কাজটায় হাত দেওয়া উচিত ছিল।’’
ভারতের বর্ষীয়ান সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লাও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘‘বাংলার সংগীত নিয়ে যে ওর (রাহমান) কোনও ধারণা নেই, সেটাই বুঝতে পারলাম। বাঙালি সংস্কৃতিকে এরা ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’’
১০ নভেম্বর অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তি পেয়েছে ‘পিপ্পা’। রাজা মেনন নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ইশান খাট্টার, ম্রুণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলির মতো অভিনেতারা। সিনেমাটি ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার জীবনের ওপর তৈরি। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের জন্য তার বীরত্বটাই মূলত উঠে এসেছে এই ছবিটির মাধ্যমে।
সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।