সারাদেশ

সংকট নিরসনে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে সংলাপ চান ড. মাহবুব উল্লাহ

ডেস্ক রিপোর্ট: সংকট নিরসনে অর্থনীতিবিদদের নিয়ে সংলাপ চান ড. মাহবুব উল্লাহ

জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উত্থাপিত বাজেটে কর প্রস্তাব, কালো টাকা সাদা করার সুযোগসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনাকে ঘিরে জনগণের মাঝে সৃষ্ট বিতর্ক নিরসনে চূড়ান্তভাবে বাজেট পাশের পূর্বে সব মতাদর্শের অর্থনীতিবিদ ও চিন্তাশীল মানুষদের নিয়ে ‘খোলা মনে’ জাতীয় সংলাপ আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ। শনিবার জাতীয় বাজেট নিয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এই দাবি জানান তিনি।

সক্রিয় রাজনীতি থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণায় আসা জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক বাজেটের অন্যান্য দিকসমূহ নিয়েও তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব মতামত। ড. মাহবুব উল্লাহ’র সঙ্গে কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বার্তা২৪.কম: জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের পর গেল দু’দিন এ নিয়ে সাধারণের মাঝে আলোচনা-বিতর্ক সবই ছিল। এই বাজেটকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

ড. মাহবুব উল্লাহ: বাজেট দেখে যেটি মনে হচ্ছে, দেশের বিদ্যমান যে অর্থনৈতিক সমস্যা সেগুলোর কোনোটারই সমাধান আমরা এই বাজেট থেকে আশা করতে পারি না। এবং এটিই হচ্ছে হতাশার কারণ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ছয় মাসের মধ্যে বা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫-এ নেমে আসবে। কিন্তু কীভাবে নেমে আসবে সেই বার্তা তিনি দেননি। সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় সংকট যেটি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হচ্ছে- বছরের পর বছর বাংলাদেশের ঋণের বোঝা বেড়েই যাচ্ছে। এই বছর বাজেটে আমাদের স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ঋণের বোঝা, এই ঋণ পরিশোধে সুদের পরিমাণও অনেক বেশি। এটা একটা বিরাট অশনি সংকেত। এটি বর্তমানের জন্যই অশনি সংকেত নয়, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও বিরাট সমস্যা-বিপদের বার্তা। এই সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে সেটাও বোঝা দুষ্কর। যেভাবে ঋণ করা হয়েছে এবং চিন্তা ভাবনা না করে অনেকটা যুক্তিহীনভাবে- তার ফলে কিন্তু আজকে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

বার্তা২৪.কম: এক্ষেত্রে সরকারের প্রকৃতপক্ষে কি করার ছিল বলে মনে করেন?

ড. মাহবুব উল্লাহ: ঋণ করা যাবে না এমনটা নয়, যদি ঋণ করতেই হয় তাহলে চিন্তা করতে হবে যে সেটা সার্ভিসিং করার..সুদ এবং আসল পরিশোধের অর্থনীতি আছে কি নেই! সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করা হয়েছিল কীনা সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন ছিল। সরকার প্রচুর ঋণ করবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে, এমনিতেই ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট। এই অবস্থায় সরকার যদি ঋণ করে ব্যাপকভাবে তাতে গ্রাহকদের জন্য যে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করা তা খুবই কমে যাবে। এর ফলে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ সেটা নিরুৎসাহিত হবে। সরকার প্রজেক্ট করতে গেলে অনেক সময় লাগিয়ে দেন। নির্দিষ্ট সময়ে প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা যায় না। তারপরও বাস্তবায়িত হলে সেটাকে সুষ্ঠুভাবে চালনা, মেনটেইন করা এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। আমাদের সুশাসনের অভাবের ফলে এই অবস্থাটার সৃষ্টি হয়েছে। সেকারণে আমরা দেখেছি, রেলে বিনিয়োগ বাড়লেও কিন্তু আমরা সুফল পাচ্ছি না। রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে, সময়মতো ট্রেন যাচ্ছে না। নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। কক্সবাজারে যে লাইনটা তৈরি করা হলো সেটাও সুষ্ঠুভাবে চালানো যাচ্ছে না, বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। এইভাবে এমন কোন সেক্টর নাই যেখানে আমাদের ওপর বিশাল বোঝা চেপে নেই। এভাবে একটা দেশের অর্থনীতি চলতে পারে না।

বার্তা২৪.কম: বাজেটের আকার এবার সংকোচনশীল। আপনি কিভাবে দেখেন?

ড. মাহবুব উল্লাহ: এ বছরের বাজেটের সাইজ তুলনামূলকভাবে পূর্বের চেয়ে কম, তা সত্ত্বেও আট লক্ষ কোটি টাকা ছোট নয়। অর্থায়ন নিয়ে যেটি বলা হচ্ছে, বিদেশি ঋণ ও শুল্ক-রাজস্ব বৃদ্ধি করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। আমরা দেখেছি, কোনো বছরেই শুল্কের টার্গেটে পৌঁছানো যায় না। এবারও যে পৌঁছানো যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা আমি দেখি না। নতুন করে কর আরোপ করা হচ্ছে, এর ফলে জিনিসপত্রের দাম, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এর ফলে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত-গরিব মানুষদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠবে। এখন যেটি বিবেচনায় নেয়ার বিষয় সেটি হচ্ছে, ব্যাংকে সঞ্চয়কারীদের ওপর আবার নতুন করে কর বসানো হচ্ছে। এমনিতেই সঞ্চয়ে রেট অব ইন্টারেষ্ট খুব কম, যার তুলনায় রেট অব ইনফ্লেশন অনেক বেশি। যারা ব্যাংকে টাকা রাখেন, বছর শেষে তার টাকাটা বাড়ে না, হ্রাস পায়। এই অবস্থাতে যদি তার ওপরে আবার শুল্ক বসানো হয়, তাহলে সঞ্চয়কারীর আর কি ইনসেনটিভ থাকবে ব্যাংকে টাকা রাখার? এ রকম অনেক প্রশ্ন উঠছে।

বার্তা২৪.কম: এই বাজেটে দাতাগোষ্ঠীর প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন কিছু দেখা গেছে কী?

ড. মাহবুব উল্লাহ: সেরকম কিছু দেখিনি। তবে দাতাদের কথা শুনতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। আমার দেশের নীতি, আমার অর্থনীতি নিজেদের চয়েস দিয়ে চালাতে হবে। তবে আমাদের সবগুলো আয় ও খরচ করার ব্যাপারে সাবধানতা মেনে চলতে হবে। আমার মনে হয় এগুলোর দিকে কোন মনোযোগ নাই। মনোযোগটা হচ্ছে…এভাবেই তো চলেছে, সামনেও এভাবেই চলবে। মানুষের কি হলো, দেশের কি হলো-এটা বোধহয় যাঁরা দেশ চালান তাদের বিচার-বিবেচনায় খুব একটা থাকে না।

বার্তা২৪.কম: শিক্ষায় বাজেট বাড়ানোর যে শিক্ষাবিদরা যে তাগিদ দিয়ে আসছেন এই বাজেটে সে রকম কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বাজেট বাড়েনি সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও…

ড. মাহবুব উল্লাহ: দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তো রাজনীতিকরণ, দলীয়করণসহ নানাভাবে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সত্যিকারের ভালো লেখাপড়া কোথাও হচ্ছে না। তারপরেও আমরা মনেকরি, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ যেটা বাড়ানো উচিত; সেটার একটা হিসাবনিকাশও আছে যে জাতীয় আয়ের কত শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করতে হবে। এবারও আমরা শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেখলাম তা খুবই অকিঞ্চিতকর, খুবই সামান্য। একদিকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে অন্যদিকে বরাদ্দ ব্যয়ে যে দক্ষতা তাও বাড়াতে হবে। দেখা যায় যে স্কুলগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষক রিক্রুট করা হচ্ছে, তাদের দক্ষতার মান কিভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে তা জানি না। সবাই স্বীকার করবেন আমাদের লেখাপড়ার মান অবনতির দিকে যাচ্ছে। এইখানে শুধু ব্যয় বাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে না। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টাও করতে হবে। তা না হলে বাজেট বাড়ালে তা কিছু মানুষকে সুবিধা দেওয়া ও দলীয় লোকদের তুষ্ট করা হবে, এটা তো কাম্য নয়। কাম্য হচ্ছে, দক্ষ-নিরপেক্ষ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে একদিকে বরাদ্দ বাড়িয়ে অন্যদিকে দক্ষতার মান বাড়িয়ে উন্নত করা।

বার্তা২৪.কম: বাজেট চূড়ান্তকরণের পূর্বে সরকারের কাছে আপনার কী প্রত্যাশা থাকবে?

ড. মাহবুব উল্লাহ: আমি দেখতে চাই এমন একটা বাজেট, যেটাকে দুঃসহ অর্থনীতির অবস্থা থেকে মানুষকে একটু স্বস্তি দেবে। রাতারাতি কিছু হবে-আমি এটা আশাকরি না; সম্ভবও নয়। যেকোন অর্থনীতিবিদই বলবেন, এটি সম্ভব নয়। সরকারের উচিত, সব দলের সব মতের অর্থনীতিবিদ এবং আরও যাঁরা চিন্তাশীল মানুষ আছেন তাদের নিয়ে আলোচনা করে এই বাজেটকে কিভাবে জনস্বার্থের বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করে কাটছাট বা পরিবর্তন করে চূড়ান্তভাবে পাস করা। এখন যে অবস্থায় আছে, কর প্রস্তাব যে ভাবে আছে; কালো টাকা সাদার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে-সেগুলো নিয়ে কিন্তু প্রচুর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সংকট নিরসনে সুষ্ঠু সমাধানে আসার জন্য খোলা মন নিয়ে ন্যাশনওয়াইড একটা ডায়ালগের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। দেশের মানুষের যে নাভিশ্বাস অবস্থা, এ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কি করা যায় তা ভাবতে হবে। এছাড়া মানুষ খুব ভালোই জানে, কয়েক মাস পর পর বিদ্যুতের বিল বাড়ে; এগুলো তো আছেই-‘মরার ওপর খাড়ার গা’র মতো। অর্থনীতি প্রচণ্ডভাবে রুগ্ন হয়ে পড়েছে। সেখানে মানুষের ওপর জবরদস্তিমূলকভাবে কর আদায় করে অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর আমি দেখি না।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *