সারাদেশ

‘যাত্রী লই এহন এক্কোটানে এয়ারপোর্ট যাইয়্যুমগই’

ডেস্ক রিপোর্ট: শুরুতেই ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিন সময়টা। এরপর চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে গাড়ি চালু করুন। অদূরের পাহাড় আর সমুদ্র থেকে গা ঘেঁষে ঘেঁষে শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো সুউচ্চ ভবন দেখা শেষ না হতেই দেখবেন সামনে এসে হাজির শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল ফটক। এবার ঘড়িতে আরেকবার চোখ বোলান। দেখবেন, প্রায় ১৬ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথটা পেরোতে সময় লাগল মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট।

এতবছর ধরে মূল শহর থেকে দ্রুত সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছানো ছিল চট্টগ্রামবাসীর জন্য স্বপ্ন। লেগে থাকা যানজট, ভাঙা সড়কের ধকল সয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছতে পৌঁছতেই দেখা যেত উড়োজাহাজ আগেই উড়ে গেছে। এখন থেকে ফ্লাইট মিসের সেই কষ্টে আর পড়তে হবে না কাউকে। আর এই সুযোগ করে দিচ্ছে বন্দরনগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়ালসড়ক) ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’।

মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত নির্মাণাধীন ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটারের এই উড়ালসড়কের দুই পাশের দ্বার খুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে নদীর তলদেশ ও রেলপথের পর এবার উড়ালপথ জয়ের স্বপ্নও পূরণ হবে চট্টগ্রামবাসীর!

সোমবার (১৩ নভেম্বর) বিকেলে অদূরে গাড়ি রেখে উড়ালসড়কের লালখানবাজার প্রান্ত দেখছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ওমর ফারুক। কি দেখেন এমন প্রশ্নে ফারুকের মুখে উপচে পড়ল হাসির ঢেউ। সেই হাসি সংবরণ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘যাত্রী লই এহন এক্কোটানে এয়ারপোর্ট যাইয়্যুমগই। কি সুখ লাগের, বুঝাই হইত ন পাইয্যুম। (যাত্রী নিয়ে এখন এক টানে এয়ারপোর্ট চলে যাব। কি সুখ লাগছে, বুঝিয়ে বলতে পারব না।’

ওমর ফারুকের এমন খুশির কারণ তো আছেই। কেননা এখন লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট যেতে লাগে এক থেকে দেড়ঘণ্টা, কখনো আবার দুই থেকে তিন ঘণ্টা। মোড়ে মোড়ে যানজটের ভোগান্তি তো আছেই, আছে ভাঙা সড়কের যন্ত্রণাও। এখন সেই জায়গায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটে পৌঁছা যাবে বিমানবন্দরে। তাও পুরো পথটাই নির্বিঘ্নে। একদিকে দ্রুত সময়ে পৌঁছা যাবে, অন্যদিকে সাশ্রয় হবে জ্বালানি-ওমর ফারুক তো খুশি হবেনই।

শুধু কি ওমর ফারুক! তার মতো খুশি প্রবাসী আর বিমানবন্দর ব্যবহারকারীরাও। কেননা অতীতে যানজটের জন্য বহুজনের ফ্লাইট মিস হয়েছে। এখন আর সেটি হবে না।

মঙ্গলবার সকালে ভার্চুয়ালি এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এখনই যান চলাচলের জন্য এই এক্সপ্রেসওয়ে উন্মুক্ত করা হবে না। কেননা এখনো এক্সপ্রেসওয়ের নিরাপত্তাসহ বেশকিছু নির্মাণকাজ বাকি আছে। আগামী বছরের জানুয়ারির শেষেরদিকে এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচলের জন্য পুরোপুরিভাবে খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতায়াতের জন্য এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। চট্টগ্রাম নগরীতে তিনটি উড়ালসড়ক থাকলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছিল না। ফলে এটিই প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২০১৯ সালে এই এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়।

শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে গত বছর প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এই এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা রাখা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারে টোল দিতে হবে। তবে এখনো টোল নির্ধারণ করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতি দিন গড়ে সাড়ে ৬৩ হাজার গাড়ি চলাচল করবে।

যানজটে ভয় নেই আর:

নগরীর যানজট প্রবণ সড়কগুলোর মধ্যে অন্যতম সিডিএ অ্যাভিনিউ, শেখ মুজিব সড়ক ও বিমানবন্দর সড়ক। এসব সড়ক মাড়িয়েই মূল শহর থেকে বিমানবন্দরে যেতে হয় বেশিরভাগ যাত্রীকে। দীর্ঘপথ যাত্রা তো আছেইই, চট্টগ্রাম বন্দরের ভারী পণ্যবাহী গাড়ি এবং দুটি ইপিজেডের গাড়ির কারণে বিমানবন্দর সড়কটিতে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি লালখান বাজার থেকে শুরু হয়ে আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা, কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা, চট্টগ্রাম ইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, কাঠগড় হয়ে পতেঙ্গা গিয়ে শেষ হয়েছে। পুরো পথটাই উড়ালপথে হওয়ায় যানজটে পড়তে হবে না আর।

পুরোদমে চালু হবে আগামী বছর:

মঙ্গলবার উদ্বোধন হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোদমে চালু হবে জানুয়ারির পর। এই উড়ালসড়কে ওঠা-নামার ১৫টি পথ ( র‍্যাম্প) থাকবে। এর মধ্যে টাইগারপাসে দুটি, জিইসি মোড়ে একটি (ওঠার), আগ্রাবাদে ৪টি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলায় দুটি, কেইপিজেডে দুটি, সিইপিজেডে দুটি এবং সিমেন্ট ক্রসিংয়ে একটি। তবে এগুলোর নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি। এছাড়া টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার অংশে পিলার ও মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। বাকি রয়েছে ১২টি টোল প্লাজার নির্মাণকাজও। সিসি ক্যামেরা, সড়ক বাতি ও এর খুঁটির কাজও শেষ হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে সিডিএ।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে নগরীর যানজট অনেকাংশ দূর হবে বলে জানান সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে শুধু চট্টগ্রাম নগরীর মানুষ নন, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার মানুষেরাও উপকৃত হবেন। আগামী বছরের জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।’

প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের কিছুদিন পর বিমানবন্দর থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, ‘বাকি কাজ চলমান আছে। সেগুলো শেষ হলে পুরোপুরিভাবে এক্সপ্রেসওয়ে চালু হবে।’

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *