সারাদেশ

৪ বিভাগে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার ওই এলাকা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। যান চলাচল করতে দেখা গেছে। পাঁচ দিন পর ঢাকা- চট্টগ্রাম এই রুট দিয়ে রাজধানীতে ঢুকেছে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের ট্রাকও। গত রোববার থেকে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও সেনা বাহিনীর যৌথ অভিযানে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরানো হয়।

বুধবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, মোহাম্মদপুর, কাজলা, রামপুরা, বাড্ডা এবং নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনকারীদের দেখা যায়নি। 

সেনা বাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর টহল অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তারা। এসব এলাকার সর্বত্র এখন শুধুই ধ্বংসলীলা। আন্দোলনকারীরা যান চলাচল বন্ধ করতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার, গাছের গুঁড়ি ও রোদ ডিভাইডার তুলে রাস্তার ফেলে রাখে। সেগুলো সরানোর কাজ করছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। অটোরিকশা বেশি চলছে। গণপরিবহন তেমন একটা দেখা যায় নি। বলা যায়, যাত্রাবাড়ী এলাকায় অটোরিকশার আধিপত্য। মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও ভয় ও আতঙ্কে অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় ম্যানুয়ালি টোল নেওয়া হচ্ছে।

ধ্বংসচিত্র: (যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল,সাইনবোর্ড)

সাইনবোর্ড এলাকায় স্পিডবোট প্রস্তুতকারী সংস্থা গোল্ডেন ফাইভার গ্লাস কোম্পানী লিমিটেডের বিদেশ থেকে আমদানি করা ৩৫টি স্পিডবোট ছিল। গত রোববার সকাল ১০টার দিকে দুর্বৃত্তরা তাদের শোরুমে আগুন দেয়। এতে সব স্পিডবোট পুড়ে যায়। এ ছাড়া কোম্পানীটির অফিস ভাঙচুর করে তারা।

জানতে চাইলে কোম্পানীর অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজার হারুনুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, রোববার যখন সাইনবোর্ড এলাকায় রণক্ষেত্র পরিণত হয়, তখন আমাদের শোরুমে তালা দেওয়া ছিল। দুর্বৃত্তরা গ্লাস ভেঙে শোরুমে ঢুকে পড়ে। শোরুম থেকে তিনটি স্পিডবোট সড়কে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া শোরুমেও আগুন দেয় তারা। এতে আমাদের অন্তত ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশে ঢাকা-সিলেট রুটের টোল প্লাজা এবং কাজলা এলাকায় অবস্থিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের দুটি টোল প্লাজা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। 

মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো স্টেশনে আগুন।  জানতে চাইলে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের হেড অব অপারেশন এরফান বলেন, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলো ফ্রান্স থেকে আমদানি করতে হয়। তাই কবে নাগাদ স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রম শুরু করতে পারব, তা বলা যাচ্ছে না। এখন আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করছি।

ধ্বংসচিত্র: মোহাম্মদপুর

টানা তিন দিনের সংঘাতের পর দুদিন ধরে মোহাম্মদপুরে পরিবেশ শান্ত। মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে বসানো হয়েছে সেনা চেকপোষ্ট। কারফিউ জারি থাকলেও দিনভর স্বাভাবিক ছিল সাধারণ মানুষের চলাচল। কয়েকদিনের সংঘাতের পরে গতকাল মঙ্গলবার সড়কে জনসাধারণের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। দুর্বৃত্তরা মাঠ ছাড়লেও এলাকাজুড়ে রেখে গেছে ক্ষত।

তাদের লক্ষ্যবস্তু থেকে বাদ যায়নি পুলিশ বক্স, সিটি করপোরেশনের অফিস, বাসাবাড়ি, সরকারি বিভিন্ন অফিস, আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস এমনকি হাসপাতালও।

সরেজমিনে গতকাল মোহাম্মদপুর, বছিলা, শ্যামলী এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, ম্যাক্স এইড ডায়াগনস্টিক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালিয়ে সব লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুইটি ফ্লোর নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানের নিচতলা এবং তৃতীয় তলার ফ্লোরে চালানো হয়েছে নজিরবিহীন তাণ্ডব। ডক্টর চেম্বার, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কক্ষ, ফার্মেসি, তথ্যকেন্দ্র, ক্যাশ কাউন্টারসহ প্রতিটি কক্ষ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একই ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে হামলা চালানো হয়েছে। ব্যাংকের মেইনগেটের তালা ভাঙতে না পারায় বড় ক্ষতি হয়নি। সামনে থাকা একটি নেমপ্লেট ভাঙা হয়েছে।

ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নাশকতাকারীরা এক্সরে মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, সেল কাউন্টার, বায়ো কেমিষ্ট (ইন্ডিগো), ইসিজি মেশিন, মাইক্রোস্কোপ, সার্ভার মেশিন, ১৫টি কম্পিউটার, ১৭টি প্রিন্টার দুই টনের ১০টি এসি, ২০ লাখ টাকার এক্সরে ফিল্ম, ডেন্টাল মেশিন, ১০ লাখ টাকার ফার্মেসির ওষুধ লুট করে নিয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ ও গণমাধ্যম বিভাগের ইনচার্জ ফাইজুল হক বলেন, ছোট যন্ত্রপাতিগুলো তারা নিয়ে গেছে। আর বড় যন্ত্রগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের অন্তত ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মোহাম্মদপুর জোনের এসি ( ট্রাফিক) বায়েজদুর রহমান বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় আমাদের মোর ৫টি পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমরা শিগগিরই মামলা করব। 

তিন রাস্তা থেকে বছিলাগামী সড়কেও চালানো হয়েছে তাণ্ডব। এখানে এসপিবিএনের দুটি গ্যারেজে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভেতরে থেকে তিনটি গাড়ি ও ছয়টি মোটর সাইকেল পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার দায়িত্বরত এক এসপিবিএন কর্মকর্তা।

মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে একটি দ্বিতল বিআরটিসি বাস এবং ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে লিঙ্করোডের সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে। ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই কমিউনিটি সেন্টারের নিচে থাকা ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সলিম উল্লাহ সলুর কার্যালয়। শিয়া মসজিদ সিটি করপোরেশনের একটি আঞ্চলিক অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক ভুঁইয়া বলেন, নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে আটটি মামলা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এসে অভিযোগ জানালে আমরা মামলা নিচ্ছি।

ধ্বংসচিত্র: রামপুরা-বাড্ডা

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় নজিরবিহীন তাণ্ডব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে রামপুরা-বাড্ডা এলাকায় টানা কয়েকদিন চলেছে ভয়াবহতা। আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি কার্যালয়, পুলিশ বক্স, সরকারি-বেসরকারি যানবাহন।

একইভাবে মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কের দুপাশে রীতিমতো ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মহাখালীর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বনানীতে সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে আগুন।  টানা কয়েকদিনের সহিংসতার পর গতকাল মঙ্গলবার পুরোপুরি শান্ত ছিল এই দুটি এলাকা। সারাদিন কোথাও কাউকে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। তবে পুরো এলাকায় এখনো রয়ে গেছে ধ্বংসের নমুনা। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মূল গেত ভেঙে বিটিভি কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়েছিল দুর্বৃত্তরা। সন্ধ্যায় আগুন দেয়া হয় মূল ভবনে। ফায়ার সার্ভিস যেতে না পারায় দীর্ঘ সময় ধরে পুড়েছে রাষ্ট্রীয় এই স্থাপনা। ১৬টি গাড়িতে আগুন ও ৯টি গাড়িতে ভাঙচুর চালায় নাশকতাকারীরা। নৃশংস এই হামলার কারণে প্রায় ২৪ ঘণ্টা বন্ধ ছিল বিটিভির সম্প্রচার।

এদিকে আন্দোলনকারীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনও (বিআরটিসি)। প্রতিষ্ঠানটির দুটি ডাবল ডেকার ও একটি সিঙ্গেল বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভঙচুর করা হয়েছে ১০টি গাড়ি। এতে ২ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম। 

রাজধানীর বনানীতে সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৫৫টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলাকারীরা ভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে অফিসে আগুন দেয়। নাশকতাকারীরা শুধু অগ্নিসংযোগই করেনি করেছে লুটপাটও।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এই ভবনে আগুনের ঘটনায় পুড়ে যায় পাশেই থাকা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সঞ্চালন তার বা অপটিক্যাল ফাইবার। পাশের খাজা টাওয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত এই ফাইবার থেকেই দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুর্বৃত্তদের আক্রমণে সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযোগকারী কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকাগামী কেবল কয়েক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিটিভি ভবনে আগুন।  ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে ২৩টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে ২৮টি গাড়ি। রাজধানী জুড়ে এই তাণ্ডবের ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় অর্ধশত মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬০১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেছেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে, বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেব। যারা এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত, সেই নাশকতাকারীদের একজন একজন করে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার, পুলিশের পক্ষ থেকে সেটাই করা হবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *