সারাদেশ

২৪ ঘন্টায়ও খোঁজ মেলেনি গামবোট দুর্ঘটনায় নিখোঁজ মনিরের

ডেস্ক রিপোর্ট: একজন মানুষ কোনো দিন এত ভালোবেসেছে আর একজনকে? হয়তো বেসেছে, অথবা বাসেনি। উনুনে ফুটন্ত দুধ যেভাবে ঢাকনা সরিয়ে বেরোতে চায়, সেভাবে দিগ্বিদিক ঠেলে বেরিয়েছে ভালোবাসা। সবাই যেন বলছেন, ‘ভয় নেই, আমি তোমার কাছেই যাব। তোমাকে বন্যার পানি থেকে উদ্ধার করব। তারপর ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাত খেতে দেব। তুমি সাহস রেখো…।’

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বন্যার মতো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন মানুষকে ভালোবাসার পাঠ দিয়ে গেল। আর মানুষ মানুষকে আঁকড়ে ধরে পৃথিবীকে যেন আরও একবার জানিয়ে দিল, ‘মানুষের তরে মানুষ আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’

মিরসরাই থেকে ফেনী, হাটহাজারী থেকে ফটিকছড়ি-বন্যার পর পানিবন্দী মানুষদের বাঁচাতে চট্টগ্রামের একদল তরুণ-তরুণী দাঁড়িয়েছেন বুক পেতে। পানিতে হাবুডুবু খাওয়া মানুষদের উদ্ধারে শহর থেকে ট্রাকভরে বোট-স্পিডবোট নিয়ে ছুঁটে যাওয়া, স্রোত ঠেলে নিরাপদে মানুষকে ফেরানো, অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দেওয়া, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে—কী না করেছেন তাঁরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাই তো তাঁদের কাজ দেখে আনন্দে বুক ভাসাচ্ছে মানুষ।

এই তরুণদের অনেকে হয়তো কখনো বাসায় ভাত বেড়েও খাননি। কেউ বা কোনোদিন থাকেননি ঘরের বাইরেও। কিন্তু মানুষের টানে বন্যার খবর পেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সবাই। তারপর সব শক্তি একত্রিত করে নেমে পড়েছেন পথে। কেউ ছুঁটেছেন ফেনীর দিকে, কেউবা ফটিকছড়ির পথে। যে পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অদম্য সাহস আর মানুষকে বাঁচানোর বুকভরা বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা সেই গলা ছুঁইছুই পানি-বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছেন মানুষের কাছে। কেউ শহর থেকে এসেছেন, কেউ এসেছেন শহরতলি থেকে। দূরের গ্রাম থেকেও এসেছেন অনেকে। কেউ মাথায় ভরে এনেছেন ভাত, কেউবা গলা উঁচিয়ে বলছেন ‘নৌকা লাগলে বলবেন।’

এই তরুণদেরই একদল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানবিক সংগঠন উত্তরণ-এর সদস্য। এই সংগঠনের তিনটি দল বন্যা কবলিত এলাকায় আছে। তাঁদের মধ্যে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুটি দল নৌকা নিয়ে ফেনী ও ফটিকছড়ি গিয়েছে। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) আরেকটি দল কুমিল্লার বুড়িচংয়ে পৌঁছেছে। তিনটি দলের সঙ্গে সমন্বয় করছেন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী নুর নবী রবিন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলেন পানি কমলে ত্রাণ নিয়ে যেতে, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে নৌকা নিয়ে যাওয়ার আহ্বান শুনে আর বসে থাকতে পারিনি। মানুষের হাহাকার-আর্তনাদের কথা শুনে তাঁদের উদ্ধারে আমাদের সদস্যরা ছুঁটে গেছেন। আমাদের সবার আশা-একজন মানুষকেও যদি উদ্ধার করতে পারি, ঘরে বসে না থেকে সেই চেষ্টাটা অন্তত করি।’

শুক্রবার সকালে রোদের দেখা মিলতেই ত্রাণ আর উদ্ধারকারী নৌকাবাহী গাড়ির ঢল নেমেছে ফটিকছড়ি-মুখী সড়কে। ট্রাকে ভরে কেউ এনেছেন ছোট বোট-নৌকা, কেউবা শুকনো খাবার। আবার কেউ বড় পাতিলে ভরে রান্না করা খাবার নিয়ে ঢুকেছেন বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে। তারপর এক একটি দল বাড়িতে প্রবেশ করে বেরিয়ে আনছেন পানিবন্দী মানুষকে, আর মুখে তুলে দিচ্ছেন বহু আরাধ্যের গরম ভাত!

সেই স্বেচ্ছাসেবক দলে আছেন চট্টগ্রাম শহর থেকে যাওয়া মো. সাইদুল ইসলাম নামের এক তরুণও। বহুমূল্যের ব্যস্ততা থেকে এক টুকরো সময় দিয়ে সাইদুল বললেন, ‘এটিই তো সেরা সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। এখন না দাঁড়ালে কবে আর দাঁড়াব? আমাদের একটি দল বৃহস্পতিবার ফেনীতে খাবার ও নৌকা নিয়ে গিয়েছে। ফটিকছড়ির অবস্থা খারাপ শুনে আমরাও গত রাতে এখানে একটা দল এসেছি। আমাদের মতো শহর থেকে অনেকগুলো দল এসেছে। সবাই যে যার মতো মানবিক কাজ করে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে মানুষকে বাঁচাতে।’

ফেনীতে পানিবন্দী উদ্ধারের পাশাপাশি খাবার দরকার-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই আকুতি ছড়িয়ে পড়ার পর বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শয়ে শয়ে ট্রাক ছুঁটে গিয়েছে নৌকা-বোট আর খাবার নিয়ে। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্যার কারণে যানজটের নতুন দুর্যোগ তৈরি হওয়ায় অনেকে সেখানে পৌঁছাতে পেরেছেন, পারেননি মানুষের কাছাকাছি যেতে। কিন্তু যারা পারেননি তাঁরাও ফিরেননি, অভুক্ত পেটে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন মহাসড়কেই-যদি সামনে এগোনোর সুযোগ মেলে এই আশাতেই।

এই দলেরই একজন তরুণ সাজ্জাদ এইচ রাকিব। বন্যায় নিজের এলাকার অবস্থা খারাপ শুনেই ফেনীর এই তরুণ চট্টগ্রাম থেকে ছুঁটে গিয়েছেন। এরপর ‘ড্রিম টাচ বাংলাদেশ’-নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে অন্যদের নিয়ে নেমে পড়েন মানুষদের উদ্ধারে। সাজ্জাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সারা বছরই চেষ্টা করি মানুষের পাশে থাকার। এই দুর্যোগে তো আরও বেশি করে থাকতে হবে। তাই মানুষ যখন কষ্ট পাচ্ছে, আর বসে থাকতে পারিনি।’

মাঠ পর্যায়ে পেশাগত কাজে গিয়ে চট্টগ্রামের তরুণ সাংবাদিক আবু রায়হান তানিন, রবিউল রবি, শুভ্রজিৎ বড়ুয়া, শারমিন রিমা ও ইমরান চৌধুরী দেখেছেন মানুষের দুঃখ। সেই কষ্ট ছুঁয়ে গেছে তাঁদেরও। সেই দায়বদ্ধতা থেকে এই তরুণেরা তহবিল গঠনের মাধ্যমে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন। এরই মধ্যে তাঁরা প্রায় ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছেন। শনিবার (২৪ আগস্ট) তাঁরা নেমে পড়বেন মানুষের পাশে। ছুঁটবেন ফটিকছড়ি আর খাগড়াছড়ির অলি-গলিতে।

আর যারা মাঠপর্যায়ে নামতে পারেননি, তাঁরাও বসে নেই। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে একটা শিশু, বয়স কতই বা-বড়জোর ১০-১২। সেই শিশুটিই তাঁর উমরাহ করার জন্য জমানো ১৪ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন বন্যার্তদের তহবিলে। আবার এক ভিক্ষুক আরেকজনের কাছ থেকে পাওয়া ১০টাকা হাসিমুখে ভরে দিচ্ছেন তহবিলের বাক্সে। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এভাবে মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে সবাই বলছেন, ‘এরাই আগামীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ তাই পথ হারাবে না।’

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *