সারাদেশ

পিটার হাসের এত দৌঁড়াদৌঁড়ি ভালো না: কাদের সিদ্দিকী

ডেস্ক রিপোর্ট: গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। দিনক্ষণ গণনা যদিও শুরু হয়েছে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই, তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা মানে ক্ষমতার কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের চলে আসা। তফসিলের পর সরকার এখন নিয়মমাফিক সরকার। অর্থাৎ সরকার দায়িত্বে থাকবে, কিন্তু নীতিনির্ধারণী কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। নতুন কোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না। নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে, এমন কোন কাজ করতে পারবে না। সংসদ সক্রিয় নেই, তাই কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল কিছু নির্বাচন কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল আগেই বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার এই নির্বাচন, এবং যথাসময়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। তিনি তার দায়িত্বের প্রাথমিক অংশ পালন করেছেন। এখন পরের অংশে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ, এবং এই কাজের জন্যে তিনি এখন থেকে তার অধীনে থাকা এবং সরকারের প্রভাবে থাকা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ ভূমিকায় না থাকে, তবে এটা তার পক্ষে কঠিন। তবে তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে যে সচেতন সেটা এরইমধ্যে অনেকটাই প্রমাণিত। গাইবান্ধার একটি আসনের উপনির্বাচন বাতিল করে তিনি সাহস, সদিচ্ছা ও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুর উপনির্বাচনের ফলাফল শুরুতে আটকে দিয়ে যে বার্তা দিয়েছেন, সেটা সুষ্ঠু নির্বাচনে তার কমিশনের অঙ্গীকারকেই মনে করিয়ে দেয়।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী আগামী জানুয়ারির ৭ তারিখে নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি হবে ৬-১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ১৮ ডিসেম্বর। ওই দিন থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল আটটা পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার চালানো যাবে। এবারের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ব্যালট পেপারে। বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে যে দৌড়ঝাঁপ আর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কাজী হাবিবুল আউয়ালের অধীনের কমিশন শুরু থেকেই এই প্রচেষ্টায় যায়নি, এবং ব্যালট পেপারের ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্তে প্রায় সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছে।

নির্বাচনের তফসিল যে মুহূর্তে ঘোষিত হয়েছে তখন রাজনৈতিক অঙ্গন অনেকটাই উত্তুঙ্গু। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে অনাগ্রহী। বিএনপিসহ এর সমমনা দল ও জোটগুলো এ নিয়ে আন্দোলনেও রয়েছে। আন্দোলন যদিও মাঠের চাইতে কাগজেকলমে বেশি, তবু তাদের এই আন্দোলন ও দাবি দেশ-বিদেশে আলোচিত। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে বিএনপি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখান থেকে সরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে, সরকারও তাদের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে না। আবার সরকারকে বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যর্থতা রয়েছে বিএনপির। এমন অবস্থায় দেশ কি আরও একবার নির্বাচন বর্জন কিংবা প্রতিহতের দিকে এগুচ্ছে—এনিয়েও রয়েছে ব্যাপক আলোচনা।

ইত্যবসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন। তার এই চিঠির জবাব দিয়েছে কেবল বিএনপি। দলটি যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, শীর্ষ নেতাদের কারাগারে রেখে তারা সংলাপে কীভাবে যাবে? জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেয়নি, তবে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠির জবাব দেওয়ার কোন ইঙ্গিত মেলেনি। জাপা মহাসচিবের বক্তব্য, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও সংলাপের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। দলটির ভাষ্য, সংলাপের উদ্যোগ সরকার নিতে পারে, নির্বাচন কমিশনও নিতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, এ মাসের শুরুতে নির্বাচন কমিশন সংলাপের উদ্যোগ দিয়ে নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ দল তাতে সাড়া দিলেও বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো তাতে সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ চিঠি নিয়ে কিছু বলেনি। তবে সংলাপের বিষয়ে দলটি এখনো ইতিবাচক নয় বলেই মনে হচ্ছে। তবে বিবিধ কারণে যেকোনো মুহূর্তে এই অবস্থানের পরিবর্তন আসতেও পারে।

বিএনপি বলছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনেও আছে দলটি। এক দফা দাবি আদায়ে ঢাকায় বড় ধরনের জনসমাগম করেও মহাসমাবেশ সফল করতে পারেনি দলটি। তবে এরপর থেকে আছে টানা আন্দোলনে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ডাকছে দলটি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে দুইদিনের হরতাল ডেকেছে বিএনপি। আগামী ১৯-২০ নভেম্বর এই কর্মসূচির কথা রয়েছে। বিএনপির এই কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত কাগুজে কর্মসূচি হয়তো থেকে যাবে, কারণ গত কিছুদিনের কর্মসূচি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, স্রেফ ঘোষণা দিয়েই শেষ তাদের কার্যক্রম। আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর অবস্থান এক্ষেত্রে কাজ করছে। কর্মসূচির দিন মাঠে তৎপর যেমন প্রশাসন, তেমনি গ্রেপ্তার এড়াতে দলটির নেতা আত্মগোপনে। এমন অবস্থায় বিএনপি যতটা না মাঠের বিজয়ের দিকে যতটা না আগ্রহ তারচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বিদেশিদের দিকে। তবে এখন পর্যন্ত ওখান থেকে চেষ্টা আছে, কিন্তু সরকারকে প্রভাবিত করার মতো কিছু হয়নি।

আহলে কি ফের নির্বাচন বর্জনের দিকে এগুচ্ছে বিএনপি? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ পড়ার পর দলীয় সরকারের অধীনে ইতোমধ্যে দেশে দুটো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তন্মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। বিএনপির বর্জনের সেই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু সে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপি বলছে—‘দিনে নয়, রাতে ভোট হয়েছিল’। ওই নির্বাচনের তিক্ত ফল বিএনপিকে নির্বাচনের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।

এমন পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে কি বিএনপি? সম্ভাবনা যদিও কম, তবে শেষ হয়ে যায়নি। শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপি চাইছে কিছু আশ্বাস। মাঠের আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির সামনে পথও খোলা নেই খুব একটা। তারা এক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিদেশিরাও, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে খুব তৎপর। তাদের এই তৎপরতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ‘আশ্বাস’ বিএনপিকে নির্বাচনের পথে নিয়ে যেতে পারে।

সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারির ২৯ তারিখ। এই তারিখের মধ্যে অথবা শেষে নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে। নির্বাচন আয়োজনের যে বাধ্যবাধকতা কমিশনের সেটা এই তারিখের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে, সে লক্ষ্যেই নির্বাচন কমিশনের এই তফসিল। যদিও বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে দেশ, তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্যে রাজনৈতিক মতৈক্যের পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলে নির্বাচনের সূচি কিছুটা হলেও বদল হতেও পারে। এই সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে যে সংলাপ সেটার সুযোগ আছে এখনো। নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপ বর্জন করেছে বিএনপি, প্রধানমন্ত্রী যদি সংলাপে ডাকেন তবে সেখানে নাও যেতে পারে বিএনপি; এখানে তাই একটাই আশ্রয়—রাষ্ট্রপতির সংলাপ। আমাদের ধারণা তেমন কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে।

বিএনপি জানে আন্দোলন থেকে অর্জনের কিছু নেই তাদের। উপরন্তু এই আন্দোলন থেকেই এখন দলটির সকল পর্যায়ের নেতারা ঘরছাড়া। বিদেশিদের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়েও লাভ নাই, কারণ গত কয়েক মাসের প্রচেষ্টা এখানে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্দোলনের যে ‘সম্মানজনক এক্সিট রুট’ সেটাও খুঁজতে হবে তাদের। নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীকে তাদের বুঝাতে হবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, আর এটা প্রমাণ করতে আরও একবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে হবে তাদের। বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় তবে আগের মতো যে নির্বাচন হবে না, সেটা কিন্তু এখনই বলে দেওয়া যায়। সরকার জানে এই নির্বাচনের দিকে চোখ বিশ্ববাসীর। সুতরাং এমন কিছু হবে না যা আশঙ্কা বিরোধীদলগুলোর, এমন কিছু হবে না যতটা সহজ একপাক্ষিক নির্বাচনে।

যতই তর্জন-গর্জন আর হতাশার কথা শোনা যাক, শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে যাচ্ছে বলেই ধারণা। কী সে প্রক্রিয়া সেটা জানতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বৈকি!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *