আন্তর্জাতিক

সেন্ট মার্টিনের কান্না থামবে কী এবার!

ডেস্ক রিপোর্ট: সেন্ট মার্টিন বললেই মনে পড়ে সাগর আর আকাশের নীল-মিলেমিশে একাকার, খোলা বালুকাময় সৈকত, সমুদ্রের বিরামহীন গর্জন। চোখের পর্দায় ছায়াছবির মতো আরও ভেসে ভেসে আসে সারি সারি নারিকেল গাছ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা গাঙচিলের দল।

সেন্ট মার্টিন বললেই আবার মনের ভেতর ইতিউতি করে আফসোস আর আর একরাশ হতাশও। ছোট্ট দ্বীপকে কাটাকুটি করে একের পর এক দালান-কোঠা গড়ে ওঠা, চারপাশের ভাঙন, প্রবালের কমে যাওয়া কিংবা জীববৈচিত্র্যের অতীতের পাতায় ঠাঁই নেওয়া-সাম্প্রতিককালে সেন্টমার্টিন লিখে গুগলে সার্চ করলে এগুলোই আসে সামনে। সেই সব মন খারাপের খবরের হাত ধরে প্রশ্ন তাই উঠছে চারপাশে, প্রকৃতির নানা ঝড় ঝঞ্ঝা বইয়েও শত বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট মার্টিন কি ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষসৃষ্ট দূর্যোগে?

বাংলাদেশকে দেওয়া সৃষ্টিকর্তার সেরা উপহারগুলোর একটি-সেন্ট মার্টিনকে রক্ষায় তাই কয়েকবছর ধরে চলছে বেশ আলোচনা-উদ্যোগ-গবেষণা। যার শুরুটা হয়েছিল ২৫ বছর আগে, ১৯৯৯ সালে। পরিবেশ অধিদপ্তর সেই বছর সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। যার অর্থ হলো, এ দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ সেখানে করা যাবে না।

উদ্যোগ আছে, বাস্তবায়ন নেই

সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় সাম্প্রতিকবছরগুলোতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাঁর মধ্যে অন্যতম ভাবনা হলো-‘পর্যটক সীমিত রাখার পরিকল্পনা’। ২০১৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন দ্বীপসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সেই ঘোষণার পর জনপ্রিয় হলিউড তারকা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এই সিদ্ধান্তের জন্য তখনকার জন্য বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও বেসরকারি সংস্থাকে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন। তবে এসব উদ্যোগ যেন ছিল শুধুই ফাইলবন্দী। কেননা একদিকে যেমন আইনি উদ্যোগ আছে, তেমনি অন্যদিকে সমান্তরালে চলছে সেন্টমার্টিনকে ‘মেরে ফেলার’ আয়োজনও!

সমুদ্রকন্যা সেন্টমার্টিন ভ্রমণে স্বপ্নভঙ্গের অ্যাখ্যান!

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে কনসালটেশন’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ সেন্ট মার্টিনকে সুরক্ষায় অনেকগুলো উদ্যোগের কথা বলেছেন। সেখানে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন সিস্টেম চালুর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও আলোচিত হয়, যদিও এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর এখনি সিদ্ধান্ত নেয়নি। এই সেমিনারের আলোচনার পর সেন্ট মার্টিনকে ঘিরে নতুন করে আশার আলো দেখছেন পরিবেশ নিয়ে সোচ্ছার মানুষেরা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বলা নিবন্ধন সিস্টেম চালুর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে মনে করেন সেন্ট মার্টিনকে রক্ষায় বহু বছর ধরে নানা সভা-সেমিনারে কথা বলে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক ও খ্যাতিমান গবেষক সাইদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে পর্যটক সীমিত করার বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। তবে আমরা ১৫ বছর আগ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে আসছি। বারবার বলছি, সেন্ট মার্টিনের ওপর চাপটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই দূরাবস্থার কারণে দ্বীপের প্রাকৃতিক আর জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। আর প্রতিটি জিনিসেরই তো একটা ধারণক্ষমতা আছে, সেখাটে ছোট্ট একটা দ্বীপে যদি প্রতিদিন ৫ হাজার মানুষ ঢুকে সেটি কীভাবে ভালো থাকবে।’

প্রতিদিন সেন্ট মার্টিনে কত মানুষ যেতে পারবেন, সেটির একটা সংখ্যা নির্ধারণ জরুরি বলে মনে করেন অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন তিন-চারটা বড় বড় শিপ বোঝাই করে হাজারো মানুষ সেন্ট মার্টিনে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু তাঁরা সবাই তো আর পরিবেশ বিষয়ে সচেতন নন, তাই দ্বীপের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য যেকোনোভাবেই এই দ্বীপকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। সেটি করতে গেলে অবশ্যই একট কোটা সিস্টেম চালু করতেই হবে। সেই সংখ্যা নির্ধারণের জন্য আগে একটা বৈজ্ঞানিকভাবে সক্ষমতা যাচাই করা যেতে পারে। সেই যাচাইয়ের ওপর ভিত্তি করেই যতজন মানুষের চাপ সেন্ট মার্টিন নিতে পারবে, সেই সংখ্যার মধ্যে পর্যটক সীমাবদ্ধ করতে হবে।’

পাশাপাশি পর্যটক আর সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দাদের আচরণগত পরিবর্তনে নানা সচেতনতা অভিযান, পর্যটকদের যাওয়ার আগে ব্রিফিং করে কোনটা করা যাবে, কোনটা যাবে না সেটি বলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী।

কেন সেন্ট মার্টিনকে বাঁচাতে হবে

সেন্ট মার্টিন দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ, কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশের সাগরবক্ষে তার অবস্থান। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন।

বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গবেষণায় সেন্ট মার্টিনে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, শামুক, ঝিনুক ও কড়ি, সামুদ্রিক মাছ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কাঁকড়াসহ ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য থাকার কথা ওঠে আসে। বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানও এই দ্বীপের বালিয়াড়ি। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুলসংখ্যক পর্যটকের গমন ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে ১১টি জাহাজে দিনে প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে যান। তাঁর সঙ্গে ছোট্ট দ্বীপটিতে স্থায়ীভাবে বাস করা প্রায় ১০ হাজার মানুষ তো আছেই। পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য ফেলা হয়। এর মধ্যেই গত কিছু বছর ধরে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বীপের কেয়াবন উজাড় করে হোটেল-রিসোর্ট নির্মাণের বিষয়টি। যদিও দ্বীপটিতে স্থাপনা নির্মাণ অবৈধ। সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্রও দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এরপরও সেন্ট মার্টিনে হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ হয়েছে ২৩০টির বেশি। যার অর্ধেকের বেশিই আবার নির্মাণ হয়েছে গত কয়েকবছরে।

২০২০ সালে সেন্ট মার্টিন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থী গবেষণা করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নাল-এ ওই বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সেই গবেষণায় উঠে এসেছিল সেন্ট মার্টিনের দুর্দশার চিত্র। গবেষণায় বলা হয়, চার দশক আগে দ্বীপটির যতটুকু ভূমি প্রবালে আচ্ছাদিত ছিল, তার তিন ভাগের এক ভাগও এখন অবশিষ্ট নেই। কোরাল বা প্রবাল—এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণী। বহিরাবরণ শক্ত হওয়ার কারণে অনেক সময় একে ভুল করে পাথর ভাবেন।

গবেষণা নিবন্ধটির অন্যতম লেখক মো. ইউসুফ গাজী তখন বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হয়ে যাবে। আমরা তখন হয়তো দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন কথাটিও বলতে পারব না। প্রবাল শুধু জাদুঘরেই পাওয়া যাবে।’

সেন্ট মার্টিনের মতো প্রকৃতির এই অত্যাশ্চর্য অসামান্য আর অকৃপণ দান ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তাই-দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, খুব জরুরি।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *