সারাদেশ

‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সম্প্রীতির বাংলাদেশ বজায় থাকবে’

ডেস্ক রিপোর্ট: গতকাল অধিকাংশ গণমাধ্যমের একটা খবর ছিল ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার’। শিরোনামটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় যদিও, তবু সার্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচনার বৈকি। কারণ ‘নাজুক পরিস্থিতিতে’ ঋণ নিয়ে চলছে সরকার—এমন একটা ধারণা প্রচলিত। এই প্রচারণায় যতটা আছে অর্থনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা, তারচেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক রঙ।

পেনশন তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারে সরকার। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলে এটা বিনিয়োগ, কারণ বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদ দিয়ে এই খাত চালিয়ে নেওয়া হবে। মেয়াদপূর্তিতে পেনশনগ্রহীতাদের লাভ দিতে হবে, আর লাভ আসতে হবে বিনিয়োগ থেকেই। সরকার যদি পেনশন তহবিলকে অব্যবহৃত অর্থ হিসেবে রাখে, তবে যে লাভের অঙ্গীকার তাদের সেটা আসবে কোথা থেকে? এখানে নিশ্চয়ই ভর্তুকি দেবে না সরকার। ভর্তুকির বিষয় চিন্তাও করা ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে একটাই উপায় বিনিয়োগ, এবং সেটাই শুরু হয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক খাতে কোন তহবিলকে ফেলে রাখা হয় না। বিনিয়োগ হয়, আর বিনিয়োগের একটা অংশ ঋণ।

গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের নাগরিকদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধন করেছেন। মূলত ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়েসিদের জন্যে এই ব্যবস্থা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ৫০ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকেরাও এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন, তবে শর্ত থাকে যে তাদেরকে কমপক্ষে ১০ বছর ওই স্কিমে চাঁদা দিয়ে যেতে হবে। সরকারের উদ্দেশ্য ৬০ বছর বয়সের নাগরিকদের আজীবন মাসভিত্তিক পেনশন দেওয়া। এই ব্যবস্থা উন্নত বেশ কিছু দেশে বিদ্যমান। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর আদলে তার বয়স্ক নাগরিকদের আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তার এই ব্যবস্থা চালু করেছে।

চাঁদা দেওয়া মানুষদের কেউ তার জমাকৃত টাকা পাওয়ার আগেই মারা গেলে সেই টাকা কি মার যাবে—এমন একটা প্রশ্নও ছিল। সরকার এই প্রশ্নের সুন্দর সমাধানও রেখেছে। পেনশন সম্পর্কিত নির্দেশনা বলছে, পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনারের নমিনি পেনশন স্কিম গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার বাকি সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। এছাড়া চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বৎসর চাঁদা দেওয়ার আগেই মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তা নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। কেবল তাই নয়, চাঁদাদাতার আবেদনের প্রেক্ষিতে তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে।

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যে যুগান্তকারী এই উদ্যোগ, কিন্তু এই পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে নেই জোর প্রচারণা। না প্রচারণা আছে পেনশন কর্তৃপক্ষের, না আছে সরকার দল আওয়ামী লীগের। অথচ এই উদ্যোগের কথা নাগরিককে ব্যাপকভাবে জানানো গেলে এক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ যেমন বাড়ত, তেমনি বাড়ত সরকারের সমর্থনও।

সর্বজনীন পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলন করেছিল জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘এ পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৪ হাজার ৯২৮ জন চাঁদা দিয়েছেন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা।’ যে চারটি স্কিম রয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা জমা পড়েছে প্রগতি স্কিমে, সেখানে জমা পড়া টাকার পরিমাণ ৬ কোটি ৬৬ লাখ ৯ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া সুরক্ষা স্কিমে ৪ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, প্রবাস স্কিমে ১ কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার টাকা সমতা স্কিমে ৩৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন।’ সমতা নামের যে স্কিম সেখানে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সঙ্গে সরকারও সমপরিমাণ টাকা দিচ্ছে, অথচ এখানে অংশগ্রহণকারী মাত্র ১ হাজার ৬৮৩ জন। প্রবাস স্কিম দিয়ে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অন্তর্ভুক্ত করা যেত, অথচ এখানে অংশগ্রহণকারী মাত্র ৪৪৮ জন। এরবাইরে সুরক্ষা স্কিমে অংশ নেওয়া নাগরিকের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৮ জন এবং প্রগতি স্কিমে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৭১৯ জন।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর তিন মাস হয়ে গেছে, অথচ এখানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার ৯২৮ জন। টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন, অংশগ্রহণকারীই মুখ্য। এই অল্প সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর তথ্য বলছে, কতটা নাজুক অবস্থায় এর প্রচারণা। কতটা অবহেলায় রয়েছে এই উদ্যোগ। চারটি স্কিমের যে অংশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ ও অংশগ্রহণকারী পাওয়া কথা সেই প্রবাসী স্কিমে মাত্র ৪৪৮ জন। বিপুল সংখ্যক প্রবাসীকে এই স্কিমের মধ্যে নিয়ে আসা যেত, কিন্তু সেটা করা যায়নি মূলত প্রচারের অভাবে।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ উন্নত অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের পেনশন দিচ্ছে, বাংলাদেশও এই তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তবে দুঃখের কথা এটা দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেই না। সরকার-প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রচারণামূলক কোন কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। সরকার দল আওয়ামী লীগের নেতাদের কাউকে এনিয়ে ধারাবাহিকভাবে কথা বলতেও দেখা যায়নি।

দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রচলনের পর স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এ নিয়ে আমি কথা বলে দেখেছি, তাদের অনেকেই এটা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রস্তাব দিয়েছিলাম কয়েকজনকে স্থানীয়ভাবে প্রচারণামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের। কেউ কেউ এ ব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, কেউ বা আবার এই প্রচারণায় নিজের লাভ খুঁজে না পেয়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার, তাদের সকলেই সরকার দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সরকারের যুগান্তকারী এই উদ্যোগ, অথচ খোদ সরকার দলের মধ্যে নেই আগ্রহ, তাহলে কীভাবে আকৃষ্ট হবে জনগণ?

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম দেশের ইতিহাসে উজ্জলভাবে লিখা থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এই পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নদ্রষ্টা কিন্তু প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ইতিবাচক অর্থে পালটে দেওয়া বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ জীবদ্দশায় অনেকবার সবার জন্যে পেনশনের কথা বলেছিলেন। এমনকি জাতীয় সংসদের বাজেট বক্তৃতায়ও এনেছিলেন এই পেনশনের কথা। ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

লেখার শিরোনামে বলেছি ‘সর্বজনীন পেনশন কেন জনপ্রিয় হয়নি’; উত্তর—প্রচারণার অভাব ও রাজনৈতিক রঙের আলোচনা, বা সরকারের সকল কিছুই বিরোধিতার বিরোধিদের মনোভাব। পেনশনের টাকা সরকারের লোকজন খেয়ে ফেলবে—এমন প্রচার আমরা দেখেছি, এখনো দেখি। এগুলো বিরোধিতার কারণে বিরোধিতা, এবং অযৌক্তিক বিরোধিতা আর বাগাড়ম্বর। এই ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ তিন মাস দেখেই দেখা ফেলাও উচিত নয়। এখন মাত্র শুরু। একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। তার প্রমাণ আমরা দেখলাম ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে। আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে খবরাখবর যারা রাখেন, তাদের জানা থাকার কথা যে, এই উৎস নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। এখানে তাই গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট আলোচকদের খেয়াল রাখা উচিত ‘ঋণ’ শব্দটি যদিও নেতিবাচক নয়, তবুও প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে এর বহুল ব্যবহার যদি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয় তবে এটা পরিহার করে প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ শব্দ ব্যবহার করাই যায়!

জনস্বার্থে নেওয়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা দেশে যত জনপ্রিয় হবে, সকল শ্রেণির মানুষেরা তত বেশি স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করবে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *