সারাদেশ

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চায় ভারত

ডেস্ক রিপোর্ট: অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের দুই পাশেই বালুচরা বাজার। একদিকে ব্যস্ততম সড়ক, অন্যদিকে বাজারের কারণে জায়গাটি সবসময় জনাকীর্ণ থাকে। সেই বাজারের পূর্ব পাশের সড়ক ঘেঁষেই গড়ে তোলা হয়েছে চার তলার ‘লায়লা সুপার মার্কেট’ নামের ভবনটি। সেই ভবনের পাশ ঘেঁষেই এগিয়ে গেছে বিদ্যুতের ১১ হাজার ভোল্টেজের তার ও খুঁটি। ভবনটি নিচের দিকে কিছুটা সরু হলেও যতই উপরে উঠেছে ততই যেন প্রসারিত করা হয়েছে। ফলে চার তলার ছাদের রেলিং ছুঁয়ে গেছে বৈদ্যুতিক তারকে। ভবন মালিকের সেই লোভের বলি হতে হলো মা-বাবার একমাত্র ছেলে মো. রিফাত আহনাফ আবিরকে।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আবির গত ২০ নভেম্বর এই ভবনের একটি কোচিংয়ে পড়তে গিয়ে কৌতূহলবশত ছাদে উঠে। রেলিঙের পাশে যেতেই তাকে টান দেয় বৈদ্যুতিক তার। এতে শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যায় ১০ বছরের শিশুটির। চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় আবির।

ছোট্ট আবিরের এমন মৃত্যুর জন্য ভবন মালিকের অবহেলাকে দায়ী করছেন আবিরের স্বজনসহ সবাই।

শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে বালুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য ভবনগুলো সড়ক ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে অন্তত ১৫-২০ হাত দূরে স্থাপন করা হলেও লায়লা মার্কেট নামের ওই ভবনটিই শুধু সড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ভবনটির নিচের দিকে ছোট হলেও যতই উপরে উঠেছে কক্ষ বড় করতে প্রসারিত করা হয়েছে।

ছাদটিরে রেলিঙের পাশেই রয়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার। ভবনটির তিন তলা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকান, কোচিং সেন্টারসহ নানা প্রতিষ্ঠান। একেবারে উপরের তলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে থাকার জন্য। ভবনটির ছাদ লাগোয়া বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার থাকলেও নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেননি ভবন মালিক। প্রতিদিন এখানে কোচিং সেন্টারসহ নানা প্রতিষ্ঠান থাকায় অনেকেই আসেন। কিন্তু উপরের ছাদে উঠার গেটটিও তালা দেওয়া হয় না। ফলে পড়তে আশা শিশুরা প্রায় সময় ছাদে উঠে যেত। শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় পড়ে জীবনটাই হারাতে হলো আবিরকে।

সম্ভাবনাময় এক কিশোরের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না কেউ। আবিরের শোকাহত মা-বাবাকে সান্ত্বনা জানাতে অনেকেই তাই ছুটে আসেন বাড়িতে। শোকের সাগরে ডুবে আছেন আবিরের চাচা-জেঠা ও মামারাও।

ভাতিজার এমন মৃত্যুতে চোখের জল ফেলেই যাচ্ছিলেন জেঠা নিজাম উদ্দিন ও চাচা আখতারুজ্জামান নাহিদ। তারা বলেন, ‘ভবন মালিকের অবহেলার কারণেই আবিরকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। মালিক যদি সতর্ক হতেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতেন তাহলে আবিরকে আমরা হারাতাম না।’

তারা আরও বলেন, ‘ভবনটি শুরুতে ছিল দোতলা। কিন্তু পরবর্তীতে অপরিকল্পিতভাবে সেটি চারতলা করা হয়। ফলে বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে সেটি লেগে যায়। কিন্তু কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ছাদে উঠার দরজায় তালাও দেয়নি। ফলে ছোট বাচ্চারা অনেকেই উঠে যেত।’

বাবার মৃত্যুতেও সাবধান হননি ভবনমালিক:

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লায়লা মার্কেট নামের এই ভবনটির মালিকের নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম। কয়েক বছর আগে এই ভবনের ছাদে উঠে একইভাবে দুর্ঘটনায় পড়েন তার বাবাও। বেশকিছুদিন চিকিৎসার পর তিনি মারা যান। একইভাবে এক শ্রমিকও বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় পড়েন। কিন্তু এত কিছুর পরও বদলাননি ইব্রাহিম। নেননি কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেও নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

সেজন্য স্থানীয় বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি বার্তা২৪.কমকে বলেন, নিজের বাবা মারা গেছে, মারা গেছে শ্রমিকও। তবুও নিরাপত্তার কোনো উদ্যোগ নেননি ভবনমালিক। এই কারণে আবারও বড় দুর্ঘটনা ঘটল। আর বিদ্যুৎ বিভাগ বা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কোথায়, কীভাবে এভাবে সড়ক ও বৈদ্যুতিক খুঁটি লাগোয়া ভবন তুলতে দিল তারা। আমরা সুস্থ তদন্তের মাধ্যমে ভবন মালিকসহ জড়িতদের শাস্তি চাই।

নিজেদের অবহেলায় একটা শিশুর প্রাণহানি ঘটলেও ভবন মালিক ইব্রাহিম বা তার কোনো স্বজন আবিরকে দেখতে যাননি। এমনকিন আবিরের পরিবারকে জানায়নি কোনো সহমর্মিতাও। সেটাও বড় দুঃখ দিচ্ছে স্বজনদের।

সেজন্য আবিরের মামা মিজানুর রহমান একরাশ হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা সবার বিবেকের কাছেই আমার ভাগনে হারানোর বিচার দিলাম।’

ভবনে গিয়ে মালিক মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে বারবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে মার্কেটে আর আসছেন না ইব্রাহিম। পাশাপাশি অপরিচিত ফোন নম্বর ধরাও এড়িয়ে চলছেন।

আগুনে পুড়ে যাওয়ায় এমনিতেই আবিরের ছোট্ট শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। সেজন্য কোনো আইনগত পথে হাঁটেনি তার পরিবার। কেননা তখন ময়নাতদন্তের প্রয়োজন পড়ত। এমনিতে পুড়ে ধ্বস্ত শরীরের ওপর আরও কাটা-ছেঁড়া হোক সেটি কোনোভাবেই চাননি স্বজনেরা।

আবিরের বাবা মোহাম্মদ আবির বেলাল শুধু বললেন, ‘ভবন মালিকের গাফেলতির কারণেই তো একমাত্র ছেলেকে হারালাম। এখন আমার আর কিছুই বলার নেই। শুধু চাইব, আমার ছেলের মতো আর কারও বাবা-মা যেন বুকের ধনকে না হারায়। কেননা ওই ভবনে চারটি কোচিং সেন্টার আছে। আমার আবিরের মতো অনেক বাচ্চাই সেখানে পড়তে যায়। আবিরকে তো আর ফিরে পাব না। সেই বাচ্চাগুলো যেন নিরাপদে থাকে-এটাই আমার চাওয়া।’

সদ্য ছেলে হারানো বাবার এই চাওয়া কি পূরণ হবে? নাকি কদিন পরেই সব ভুলে যাবেন সবাই। যথারীতি কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবেন না ভবন মালিক। কোনো কর্তৃপক্ষও সোচ্চার হবে না এমন অপরিকল্পিত ভবনের বিষয়ে। সেটিই এখন প্রশ্ন সবার!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *