সারাদেশ

জামালপুরে আওয়ামী লীগের ১০ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন দাখিল

ডেস্ক রিপোর্ট: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমাদানের সময় শেষ হয়েছে গতকাল ৩০ নভেম্বর। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আন্দোলনে থাকা বিএনপি অনেক আলোচনার এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নিচ্ছে অন্তত ৩০ রাজনৈতিক দল।

নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ সংসদীয় আসনে এবার মোট ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। যার মধ্যে ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ডামি/বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা রয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে ইসির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শরিফুল আলম গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও আসন্ন নির্বাচনে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ কয়েকজন অংশ নিচ্ছেন। তন্মধ্যে অন্যতম নাম ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আলোচিত এই বিএনপি নেতা ছাড়াও বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র ও বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। উল্লেখের তালিকায় আছেন বগুড়া-৪ আসনে চারবারের এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, ফরিদপুর-১ আসনে সাবেক এমপি ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, বগুড়া-৭ আসনে সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সরকার বাদল, বগুড়া-২ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক বিউটি বেগম, বগুড়া-১ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা, ময়মনসিংহ-৪ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একরামুজ্জামান, টাঙ্গাইল-৫ আসনে অ্যাডভোকেট খন্দকার আহসান হাবিব, জামালপুর-১ আসনে উপজেলা বিএনপির সদস্য মাহবুবুল হাসান, ঝালকাঠি-২ আসনে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার এ কে এম ফখরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম-১০ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা মনজুর আলম, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি দেওয়ান শামসুল আবেদীন। সমশের মবিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, শওকত মাহমুদরাও বিএনপির সাবেক নেতা ছিলেন, তারাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এরবাইরে আরও কিছু নাম আছে যারা বিএনপির সঙ্গে বিভিন্ন সময় কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন।

নির্বাচনে বিএনপির এই নেতারা উদ্বুদ্ধ/প্রভাবিত নাকি বাধ্য হয়ে অংশ নিচ্ছেন এটা অন্য আলোচনা। তবে সকল আলোচনা ছাপিয়ে একটা নাম ওপর চলে আসে; ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। বিএনপি সরকারের সাবেক এই আইন প্রতিমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কিত করার প্রক্রিয়ার অন্যতম কুশীলব ছিলেন। পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা বানাতে বিএনপি সরকার সংবিধানের যে সংশোধনী এনেছিল সেই সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন শাহজাহান ওমর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পুরোটাই ছিলেন তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে। একাধিকবার হয়েছেন এমপি। আজীবন আওয়ামী-বিরোধী রাজনীতি করে শেষজীবনে এসে তিনি ‘ডিগবাজি’ খেয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছায় নাকি বাধ্য হয়ে দল ছেড়ে নির্বাচনে এলেন এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারণ মনোনয়নপত্র জমাদানের ঠিক আগের দিন তিনি জামিন পেয়েছেন, এবং জামিন পেয়েই অংশ নিলেন নির্বাচনে।

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে আসি-আসি করছিলেন, এমন না। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। মনোনয়নপত্র জমাদানের পর তিনি বলেছেন, ‘জিয়ার রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি আরও উন্নত’। কী আশ্চর্য, এই বোধটুকু আসতে এক জীবন লাগল তার! তিনি আলোচনায় এসেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে ‘অবতার’ আখ্যা দিয়ে। গত ১৬ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির এক সেমিনারে রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। তার তো আমাদের আরও সাহস দেওয়া দরকার, বাবারে তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা কর। তার বলতে হবে—আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস-বাবা ভগবান আসসালামু আলাইকুম।‘ উল্লেখ্য, ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তন্মধ্যে তিনিই একমাত্র নেতা যিনি জামিন পেয়েছেন।

নির্বাচনে দলীয়ভাবে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের ইঙ্গিত অনুযায়ী পুনঃতফসিল হচ্ছে না। ফলে এখন থেকে নতুন কারো অংশগ্রহণের আর সুযোগ নাই। ৩০ রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী মিলিয়ে ভোটের লড়াইয়ে এখন ২ হাজার ৭৪১ জন। এই প্রার্থীদের মধ্যে কারো কারো মনোনয়নপত্র নানা কারণে বাতিল হতে পারে, কেউ কেউ মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারেন। তবে অংশগ্রহণকারীদের এই সংখ্যা দিয়ে কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জনপ্রত্যাশা পূরণ হলো?

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে ধারণা তার প্রাথমিক শর্ত যদি হয় বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর অংশ নেওয়া, তবে বলা যায় এখন পর্যন্ত এই প্রত্যাশার অনেকটা পূরণ হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দিয়ে যদি শর্ত পূরণের কথা ভাবা হয় তবে দুই-তৃতীয়াংশ দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। আবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে যদি কেবল দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশগ্রহণের কথা ভাবা হয়, তবে এই শর্ত পূরণ হয়নি। প্রচলিত জনধারণা অনুযায়ী ‘সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনই নিরপেক্ষ নির্বাচন’। আসছে নির্বাচন কিংবা এরপরের যেকোনো নির্বাচনে যদি কখনো সরকারের পরিবর্তন হয়, তবেই এটাকে মানুষ নিরপেক্ষ নির্বাচন ভাববে। সত্যি বলতে কী, এটাকে মানুষ কেবল নিজস্ব ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বিশ্বাসের অংশ হিসেবে ধরে রেখেছে। যদিও এর পেছনে যুক্তি নেই, তবু এটা মানুষের বিশ্বাসের অংশ হয়ে আছে।

এবারের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯ রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৮৪৮ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। বিএনপির বর্জনের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে ১২টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল ১ হাজার ১০৭টি। ওই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ২৮টি দল, এবং দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৫৬৭ জন।

এরআগে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি ছিল না। নিবন্ধন চালু হওয়ার আগে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৫টি দল অংশ নেয়, দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৩৯ জন; সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৮১টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ২ হাজার ৫৭২ জন প্রার্থী ছিলেন; ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ৪২টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে ১ হাজার ৪৫০ জন প্রার্থী ছিলেন; পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ ২ হাজার ৭৮৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর আগের চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন যথাক্রমে ৯৭৭, ১ হাজার ৫২৭, ২ হাজার ১২৫ এবং ১ হাজার ৯১ জন।

আগের নির্বাচনগুলোর, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে দেশের উত্তরণের পরের নির্বাচনগুলোর প্রার্থী সংখ্যা বিবেচনায় আসন্ন নির্বাচনও প্রার্থী সংখ্যার দিক থেকে অংশগ্রহণের। দলের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। প্রার্থী আর দলের সংখ্যা দিয়ে কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বিবেচনায় নেওয়া যায়? এটা যদিও বিতর্কসাপেক্ষ, তবে বলা নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী সংখ্যা দিয়ে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা গেলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলার সুযোগ কম। নির্বাচন যেখানে দুইটা পক্ষের জয়-পরাজয়ের কথা বলে সেখানে আসন্ন নির্বাচনে সে সুযোগ থাকছে না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে জিতবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এমনকি শতভাগ জিতে চাইলেও এটা খুব বেশি কঠিন কিছু নয় বলেও অনেকের ধারণা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে, তবে এটা নির্বাচনী মৌলিক ধারণার সঙ্গে যাচ্ছে না। বিপুল সংখ্যক প্রার্থী, তবে সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ ছাড়া সম্ভাবনায় নেই অন্য কেউ। আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে প্রমাণ করতে হবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে—এমনটা বলছি না; তারপরেও নির্বাচনের আগেই সরকার গঠনের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। এমন অবস্থায় দেশে নির্বাচনী আমেজ কি নিয়ে আসা সম্ভব? সম্ভব নয়। হয়েছেও তাই। এত এত প্রার্থী, তবু নেই নির্বাচনের আমেজ, উৎসব।

নির্বাচনে পৌনে তিন হাজার প্রার্থী, তবু যেন ‘অটো-পাস’ আমেজ! এটা জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে না, এটা জনগণের প্রতি জনপ্রতিনিধি ও সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের পথ দেখায় না। প্রার্থী ও দল সংখ্যায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটা শর্ত পূরণ হয় হয়তো, কিন্তু এর মাধ্যমে জনতার গুরুত্ব বাড়ছে না, বরং ক্রমে কমছে।

ইলেকশন ‘সিলেকশন’ হয়ে গেলে সমস্যা, বড় সমস্যা; আমরা সম্ভবত বড় সমস্যার দিকেই ধাবমান!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *