সারাদেশ

চট্টগ্রামে ডাম্পার-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক-সহকারী নিহত

ডেস্ক রিপোর্ট: লালমাটিয়ার বাসিন্দা ডা. মনিরুল ইসলাম গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। মাসে ৫০০ টাকার গ্যাসেই শেষ করতে পারেন না। মিটার ভাড়াসহ কোন কোন মাসে ৪০০ টাকাতেই চলে যায়।

ডা.মনিরুল ইসলামের আরেকটি বাসা রয়েছে সাভারের অরুনা পল্লীতে। সেখানে কেউ না থাকলেও প্রতিমাসে ১০৮০ টাকা করে বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। অথচ তার দু’টি সংযোগেই একই বিতরণ প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধীনে। মাত্র কয়েক মাইলের ব্যবধানে তার এই দুই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বার্তা২৪.কমকে। আবার তার বাসার উল্টোদিকে ধানমন্ডিতেই মিটারবিহীন গ্রাহকদের বাড়তি বিল দিতে হচ্ছে গ্রাহককে।

তিনি বলেন, আমার লালমাটিয়ার বাসায় ৫ জনের রান্না হয়। কখনই ৫০০ টাকার বেশি রিচার্জ করতে হয়নি। আর যেখানে আমরা থাকি না তারজন্য টানা ৩ বছর ধরে বিল দিয়ে যাচ্ছি। তাও আবার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।

মনিরুল ইসলাম আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, পত্রিকায় নিউজ দেখি গ্রাহকের পকেট কেঁটে প্রফিট বোনাস নেওয়া হচ্ছে। পত্রিকায় দেখেছিলাম কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতবছর প্রত্যেকে ১৮ লাখ টাকা করে বোনাস পেয়েছে। আমরা বিল দিয়ে মরি আর তারা টাকার পাহাড় গড়ছে।

প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী রূপনগর আবাসিক এলাকার (রোড ১৯) বাসিন্দা আবেদ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। সাড়ে ৩’শ থেকে সাড়ে ৪’শ টাকার রিচার্জে মাস পার হয়ে যায়। গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা কমবেশি এমনই। যাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি তাদের সর্বোচ্চ ৬’শ টাকা খরচ হচ্ছে।

মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিল আদায় করা হয়। যা বর্তমানে দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার ও এক চুলা ৫৫ ঘনমিটারের সমান। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও । গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো দশকের পর দশক ধরে বলে আসছে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাস বেশি পুড়ছে। এ কথা বলে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে নেওয়া হয়। তাদের বক্তব্য ছিল মিটার স্থাপন করলে তাদের রাজস্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু লালমাটিয়া (২০১৬ সালে) এলাকায় প্রথম প্রিপেইড মিটার বসানো হলে রেজাল্ট এলো উল্টো। দেখা গেলো প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারিদের বিল আসছে দেড়’শ থেকে আড়াই’শ টাকা (তখন মিটারবিহীন গ্রাহকদের বিল ছিল দুই চুলা ৪৫০ টাকা )।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। তখন দুই চুলায় ৭৭.৪১ ঘনমিটারের বিল নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস পুড়ছে গ্রাহকরা।

পাইলট প্রকল্পের আগে গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের তৎপরতা ছিল লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এখন যতটা পারা যায় বিলম্বিত করার কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে ৮ বছরে মাত্র ৪ লাখের মতো মিটার স্থাপন হয়েছে। কোম্পানিগুলোর ধীরে চলো নীতির কারণে গ্রাহক যাতে নিজে কিনে বসাতে পারে সে জন্য চাপ দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

বিইআরসি-২০১৮ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের দ্রুত করার আদেশ দেন। গ্রাহক যাতে নিজেরা মার্কেট থেকে মিটার কিনে স্থাপন করতে পারে সেই সুবিধা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ২০২১ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেই নীতিমালায় বলা হয়েছে গ্রাহক নিজের পছন্দমতো দোকান থেকে মিটার ক্রয় করে বিতরণ কোম্পানিতে জমা দেবেন। বিতরণ কোম্পানিগুলো পরীক্ষা করে গ্রাহকের আঙ্গিনায় স্থাপন করবে। তবে নানা জটিলতা দেখিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বাজারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে মিটার স্থাপন করছে কোম্পানিগুলো। তাও আবার ঢিমেতালে। কোম্পানিগুলো একে লুটপাটের নতুন খাত হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।

বিইআরসি গত বছরের মার্চে সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উপর গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।

তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার (১৩৭৯.৭০ টাকা), দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার (১৫৯১.৯২) করার আবেদন করেছে বিইআরসির কাছে। আবেদনটি চলতি বছরে মে মাসে জমা দিলেও ব্যাপক বিতর্কের পর বিষয়টি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে সম্প্রতি বেশ গোপনে এ বিষয়ে আবার তৎপরতার শুরুর কথা জানা গেছে।

তিতাসের গ্যাস বিল বাড়ানোর প্রস্তাব শিগগিরিই কমিশনের সভায় তোলা হবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন।

তিতাস দাবি করেছেন, নির্ধারিত পরিমাণের (৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার) চেয়ে মিটারবিহীন গ্রাহকগন বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। ফলে সিস্টেম লস বৃদ্ধি পেয়েছে। এক চুলা ৭৬.৬৫ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন করা হয়েছে। বিইআরসি আগে যে আদেশ দিয়েছে তা বাস্তব সম্মত ছিল না।

বিইআরসির সাবেক সদস্য (তৎকালীন সদস্য- গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমারতো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। প্রথমবার জন্য যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছিল। তখন শর্ত দেওয়া হয়, প্রিপেইড মিটার বসানো এবং পরবর্তীতে কমিয়ে আনার।

কিসের ভিত্তিতে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ এর নিচে ব্যবহৃত হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাড়ে ৩ লাখ মিটারকে বিবেচনা করবেন, নাকি তাদের (তিতাস গ্যাস) ১০০ মিটারকে। কোন বিশেষ এলাকায় যদি বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়, তাহলে সেখানে দ্রুত মিটার বসিয়ে দিলেই হয়, তার জন্য ৩৪ লাখ গ্রাহকের বিল বাড়ানো যৌক্তিক হবে না।

মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের গ্যাস বিল বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে বিইআরসি। দু’একজন কর্মকর্তা তিতাস ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগসাজসে মাঠে নেমেছেন বলে জানা গেছে। তারা চান দ্রুততার সঙ্গেই তিতাসের আবেদন বাস্তবায়ন করতে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তিতাসের ওই আবেদনে সাড়া দিতে গেলে বিইআরসিকে অবশ্যই গণশুনানি করতে হবে। গণশুনানি ছাড়া বিল বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। গণশুনানি শুরু হলে সেখানে এ বিষয়ে তথ্য উপাত্ত দিয়ে কথা বলা হবে। বিল বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা দেখি না।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *