সারাদেশ

তিন বছর পর মালিকের কাছে ফিরে এলো একটি কচ্ছপ !

ডেস্ক রিপোর্ট: সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। যে দেবী অগম্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না তিনিই মা দুর্গা। দুর্গম নামক দৈত্যকে দমন করে মা দুর্গা নাম পান। হিন্দু ধর্মমতে পরমাপ্রকৃতি স্বরূপা মহাদেবী, মহাদেবের পত্নী। মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে, মা মহামায়া, পরমবিদ্যা, নিত্যস্বরূপা, যোগনিদ্রা। মা জন্মমৃত্যু-রহিতা।

মার্কে-য় পুরাণ মতে মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে, দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য ছিলেন বলে– বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ থেকে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এরপর মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুদের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রু, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হয়। এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র ও অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তোলেন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী দুর্গা মহাশক্তিরই প্রতীক। সেই মহাশক্তিকেই তারা প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করে। তাই এই পূজা প্রতিমাকে পূজা করা নয়, প্রতিমাতে পূজা করা। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, চিকের আড়ালে দেবী সব সময়ই রয়েছেন। চিকের আড়ালে যিনি আছেন, তিনি মহাশক্তি দেবী দুর্গা। শাকম্বরী অবতারে তিনি দুর্গম নামের মহাশুরকে বধ করে দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা হয়েছেন। আবার ভক্তদের অনুভবে ‘চিকের’ আড়ালে থাকা মহাশক্তি ভক্তদের দুর্গতি নাশ করেন, তাই তিনি দুর্গা।

আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয় আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবীলক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ।

ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। যষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, প্রচলিত ভাষায় একে কলাবউ বলে। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান- অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয় যাকে বলা হয় কুমারী পূজা।

নবমীতে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পুণ্যাহৃতি দেয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। রামায়ণ থেকে জানা যায়, পিতার আদেশ পালন করার জন্য রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রী সীতা ও অনুগত ভাই লক্ষণকে নিয়ে পঞ্চবটী বনে যান। রাক্ষসরাজ রাবণের বোন সূর্পনখা শ্রীরামচন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার ভালোবাসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। সূর্পনখা শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষতি করতে গেলে শ্রীরামচন্দ্র তার নাক-কান তীর-ধনুক দিয়ে কেটে দেন। বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে দুর্মতি রাবণ ছদ্মবেশে সীতাকে চুরি করে আটকে রাখেন অশোক কাননে। শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শক্তিদায়িনী দেবীদুর্গার পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে শ্রীরামচন্দ্র পূজা করতে বসেন। একে একে অঞ্জলি দেয়ার সময় একশ আটটা নীলপদ্মের জায়গায় একশ সাতটা নীলপদ্ম পান। আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন। সীতা উদ্ধারও হবে না। তাই তো নিরুপায় শ্রীরামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন, কেননা শ্রীরামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা শ্রীরামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবীদুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন।

অধুনা বাংলাদেশের তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। যদিও বাংলায় দুর্গোৎসবের ইতিহাস যে কংসনারায়ণের সময়কাল থেকে শুরু নয় তা প্রায় হলফ করেই বলা যায়। কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে। খুব সম্ভবত, আট কি নয় লাখ টাকা ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করে সে যুগের জনমানসে দুর্গাপূজার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য সূত্রে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর প-িতগণ ধারণা করেন, বর্মণসেন শাসনামল (১১-১৩ শতক) থেকে বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।

ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যা ও জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন। তান্ত্রিক সাধকরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাকে নারীমূর্তিতে কল্পনা করেছেন। আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দেবী দুর্গা কখনো ত্রিভুজা, কখনো অষ্টভুজা, আবার কখনো দশভুজা হিসেবে আবির্ভূত হন। সনাতন ধর্মমতে, বস্তুত যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দুর্গাপূজা মূলত শক্তির আরাধনা। এর দর্শনটি হলো, দুর্বলের কোনো আত্মজ্ঞান হয় না, জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। আর ব্রহ্ম পরিপূর্ণতা লাভ করেন শক্তিতে। শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ণ ঘটে জগৎসৃষ্টিতে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *