সারাদেশ

সরকার পোশাক শিল্পকে ধ্বংসের নীল নকশা করছে: রিজভী

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের নির্বাচন এখন আর কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটা এখন আমেরিকা আর রাশিয়ার লড়াইয়ের অংশও হয়ে গেছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ দুটির বাগযুদ্ধের অস্ত্র হিসেবেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নির্বাচন যত এগুচ্ছে এর প্রবণতাও বাড়ছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ের নিয়মিত অংশ। দেশটির এই দপ্তরের মুখপাত্ররা নিয়মিতই নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রশ্নের মুখে পড়েন, জবাব দেন, এবং সেটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশও হয়। কেবল ব্রিফিংই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জন্যে পৃথক ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। প্রকাশিত ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে যারাই প্রতিবন্ধক হবেন তারাই আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। এই তালিকায় যেমন আছেন রাজনীতিবিদ, তেমনি আছে প্রশাসন, বিচারপতি থেকে শুরু করে সাংবাদিকেরাও। মার্কিনীদের ভাষায়, তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।

গুঞ্জন আছে, মার্কিনীদের নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত গড়াতে পারে। এ নিয়ে নানা মহল থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থ বা আওয়ামী লীগ সরকারকে অপছন্দের কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞার অপেক্ষায় রয়েছে অনেকেই। এই গুজব শুরুর দিকে প্রবল ভীতিপ্রদ ছিল, আছে এখনো, তবে এটা আর এখন আগের মতো এতখানি ভীতিপ্রদ নয়। অতি-ব্যবহারের আবেদন হারিয়েছে অনেকটাই। তবে নির্বাচন যত এগুচ্ছে তত নানা আঙ্গিকে হচ্ছে এর প্রচার।

বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে যে গুঞ্জন চলছে তার বেশিরভাগই রাজনৈতিক প্রচারণা। সরকারবিরোধী অংশ বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভাবছে এতে করে তাদের মাঠের রাজনীতির ব্যর্থতা আড়াল করা যাবে। একের পর এক ব্যর্থ রাজনৈতিক কর্মসূচির পর এটাই একমাত্র আশার আলো তাদের। অপেক্ষার দিনগুলো একে একে পার হচ্ছে, তবে আশা ছাড়েনি তারা। প্রথমে তারা ভেবেছিল মনোনয়নপত্র জমাদানের তারিখ শেষের আগেই আমেরিকার ভেলকি দেখা যাবে। একাংশের ধারণা ৭ জানুয়ারির নির্বাচন করতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। আরেক দলের আশা নির্বাচন করলেও বেশিদিন টিকতে পারবে না সরকার।

সরকার টিকতে পারবে না—এই আশার মূলে রয়েছে আমেরিকা। আমেরিকা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশ অচল হয়ে যাবে, দেশ অচল হয়ে গেলে সরকারকে বিদায় নিতেই হবে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং আন্দোলনে সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় সরকারের পতন হয়েছে, এই উদাহরণও এখানে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। এই যে বিবিধ ভাবনা, অপেক্ষা আর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাশা যেখানে দেশের স্বার্থ গৌণ, দলীয় স্বার্থটাই মুখ্য। দেশের সর্বনাশ প্রত্যাশায় তাদের নিজেদের জন্যে পৌষ মাস প্রার্থনা! ভাবা যায়, স্রেফ সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে দেশের প্রতি কতখানি বিদ্বেষ পোষা একপক্ষের! তারা কেবল রাজনৈতিক বিরোধিতায় রাষ্ট্র ও সরকারকে এক করে ফেলেছে।

আমেরিকার ভিসানীতি এবং তৎপরবর্তী দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ, অতি-আগ্রহ লক্ষণীয়। হাস রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, প্রশাসনের বিভিন্ন অংশ, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান-সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে যাচ্ছেন একের পর এক। সকল বৈঠকের কেন্দ্রে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন। তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন বলে নানা অভিযোগ আছে। তবু তার তৎপরতা থেমে থাকেনি। অতি-তৎপরতার এক পর্যায়ে এক সপ্তাহে ছুটি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের বাইরে গেছেন। ফিরে এসে আগের মতো তৎপর না হলেও থেমে যাননি। তার এই দৌড়ঝাঁপ কেবল বাংলাদেশেই আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে না, এটা পৌঁছে গেছে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে। তিনি এখন দুই পরাশক্তি আমেরিকার-রাশিয়ার আলোচনায়-বাগযুদ্ধে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বেশ কিছুদিন ধরে নিয়মিত বিষয়। আমেরিকার পর এটা রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়েও ওঠে এসেছে। রাশিয়া বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অতি-আগ্রহকে ভালো চোখে দেখছে না। দেশটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণই নেবে। সাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচনের কথা বলছে আমেরিকা-বিরোধী প্রধান দেশটি। এই অঞ্চলে চীন ও ভারতের অবস্থান পরস্পরবিরোধী হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া, চীন ও ভারতের অবস্থান একই। তিনটি দেশ এরই মধ্যে জানিয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে নিয়ে বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপের বিরোধী তারা। এখানে বাইরের দেশ বলতে তারা আমেরিকাকেই বোঝাচ্ছে।

ভারত ও চীন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অতি-তৎপরতাকে নমনীয় ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানালেও রাশিয়া সে পথে নেই। তারা ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিরোধী দলের এক নেতার সঙ্গে বৈঠক করে ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করছেন’ বলেও অভিযোগ করেছে। অক্টোবরের শেষের দিকে পিটার হাস সরকারবিরোধী বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিরোধীদলীয় এক সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে গত মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করা হয়। পিটার হাসের এই তৎপরতাকে ভিয়েনা কনভেনশন পরিপন্থী হিসেবেই আখ্যা দেয় রাশিয়া। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার এই অভিযোগকে অস্বীকার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এরপর এর জবাব দেয় যুক্তরাষ্ট্রও। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর দাবি করে, রাশিয়া বক্তব্য তাদের ‘ধারাবাহিক অপব্যাখ্যার’ অংশ।

আমেরিকা-রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র, ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরাই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কেবল কথা বলছেন না, এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ বিষয়ক সমন্বয়ক জন কিরবিও। গতকাল ওয়াশিংটনের ফরেন প্রেস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, রাশিয়ার এমন অভিযোগের বিষয়ে জন কিরবি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। রাশিয়ানরাও জানে যে এটি মিথ্যা। এটি শুধু উচ্চমানের রুশ অপপ্রচার। তারা জানে এটা মিথ্যা। বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, আমরাও তাই চাই এবং তা হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। পিটার হাসের তৎপরতা সম্পর্কে তার ভাষ্য, রাষ্ট্রদূত এবং তার টিম আগে যেভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেইভাবে তারা বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, বিরোধী দল ও সরকারসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণ এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে যেন সম্মান করা হয় তা নিশ্চিতে তাদের কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত থাকবে।’

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার ভিসানীতি এবং সাম্প্রতিক বিবিধ নিষেধাজ্ঞার গুঞ্জন সম্পর্কে কথা বলেছে রাশিয়া। ঢাকায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্সান্ডার মান্টিটস্কি আজ বৃহস্পতির রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে থাকবে রাশিয়া। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার ওপরে আমেরিকার অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে কিন্তু সেগুলোকে আমরা আমলে নিই না।’

নির্বাচন হবে বাংলাদেশে কিন্তু এ নিয়ে বাগযুদ্ধে জড়াচ্ছে আমেরিকা ও রাশিয়া। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক যে সম্পর্ক বাংলাদেশের, সে তুলনায় রাশিয়া পিছিয়ে ঠিক। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে রাশিয়ার যে অবস্থান সেটা বাংলাদেশের অপর দুই বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী ভারত-চীনেরও। দেশ দুটি রাশিয়ার ভাষায় আমেরিকার সমালোচনা করছে না ঠিক, তবে অবস্থান ঠিকই ধরে রেখেছে।

নির্বাচন আমাদের, কিন্তু মাথাব্যথা কিংবা বাগযুদ্ধ আমেরিকা-রাশিয়ার। এ দুই পরাশক্তির বাগযুদ্ধ স্রেফ কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যদি এর পরিসর বাড়ে তবে আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *