সারাদেশ

সাংবাদিকতায় শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদ: নবযুগ এনেছিলেন যিনি

ডেস্ক রিপোর্ট: ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। ‘ভাঙার গান’ শিরোনামেই কবিতাটি ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় ‘বাঙ্গলার কথা’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। ‘ভাঙার গান’ শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’-তে লিখেছেন- “আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ ‘বাঙ্গলার কথা’র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক’রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু’র দ্বাদশ সংখ্যায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:

‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master’s Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *