সারাদেশ

রায়েরবাজারে ফেরদৌসের পুস্পস্তবক অর্পণ

ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কাল ৭১’র- ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন দিনের আলো শেষে কালো অন্ধকার রাত পোহালেই হয়ত ভেসে আসত বাঙালির বিজয়ের ধ্বনি, জয় বাংলা স্লোগানে মুখর হতো এ দেশের আকাশ বাতাস। হয়ত ১৬ নয় ১৫ ডিসেম্বরই হতো এ দেশের বিজয় উল্লাস।

তবে নিশ্চিত পরাজয় জেনে সে বিজয় ঠেকিয়ে দিয়েছিল হায়েনার দল। টানা নয় মাসের রণক্ষেত্রে ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি নরপশুদের মন। লাল সবুজের বাংলাকে মেধা শূন্য করতে সেদিন করা হয়েছিল এক নরকীয় আচরণ।

সেদিন দিনের আলো ফুরাতেই ঘন আঁধার নেমেছিলো বাংলার আকাশে। ঘন অন্ধকারের মধ্যেও হায়নার চোখে খুঁজে বেচে বেচে হত্যার জন্য তুলে নিয়েছিল দেশের শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি সাহিত্যিকদের। সেদিন তাদের তালিকা থেকে বাদ যায়নি সাংবাদিকরাও।

দেশের বেশিরভাগ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ১৪ ডিসেম্বর রাতে তুলে নেওয়া হলেও, এদিন দুপুরে তুলে নেওয়া হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে। আর তাকে তুলে নেওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলবদর বাহিনীর চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খান ও অপারেশন ইনচার্জ মুঈনুদ্দিন।

এদিন সন্ধ্যায় কায়েত টুলির বাসা থেকে সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক শহিদুল্লাহ কায়সারকেও তুলে নেয় আলবদর বাহিনী।

শুধু অধ্যাপক মোফাজ্জল হোসেন ও সাহিত্যিক কায়সার নয় পরাজয় নিশ্চিত জেনে সেদিন তালিকা ধরে ধরে ১ হাজার ১১১ জনকে তুলে নেয় পাক হানাদার বাহিনী ও আলবদররা।

কি হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর রাতে?

সেদিন রাতে কি হয়েছিলো তার সঠিক বর্ণনা কেউ দিতে না পারলেও পরের দিন সকালে প্রতিটি লাশ চিৎকার করে জানান দিচ্ছিলো রাতের বর্বরোচিত নির্যাতন আর হত্যার কথা। রায়ের বাজারে লাশের সারি আর রক্তের গন্ধে সূর্যের আলোটাও সেদিন মলিন ছিল। কারো হাত বাঁধা, কারো শরীর গুলি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করা। আর কাউকে তো জবাই করা হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে। সেদিন প্রকৃতিও যেন নির্বোধ ছিল। স্বজনদের কান্নার আওয়াজ যেন ভাসেনি বাতাসে তাই তো পাখিগুলো সেদিন ডাকেনি, তবে নির্বোধ নয়, নিশ্চুপ হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো প্রকৃতি।

মেধাশূন্য করার অপারেশনে সেদিন রাজারবাগ, মিরপুরসহ ২৩ টি স্থানে হত্যা করা হয়েছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। প্রতিটি লাশের গায়ের দাগগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো কতটা নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিলো তাদের মৃত্যুর আগে।

মিরপুর ও রাজারবাগে সেদিন বাবাকে খুঁজতে আসা সন্তানরা লাশের পুকুরে নেমে উলোট পালোট করেও খুঁজে পায়নি বাবার দেখা, এতটা গভীর ছিল লাল রক্তের স্রোত তা বলে বোঝানোর নয়। রক্ত আর কাদা মাখা শরীরে স্বজনদের আর্তনাদ যেন মেঘের গর্জনের চেয়েও ভয়াল হয়েছিলো অনেকের।

তবে কীভাবে করা হয়েছিলো ঘৃণিত এই হত্যার পরিকল্পনা, কে বা কারা ছিল ১৪ ডিসেম্বরের ডায়েরি লেখক?

বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পিছনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আল-বদর বাহিনী জড়িত থাকলেও পরিকল্পনাটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারাও ফরমান আলির বলে ধারণা করা হয়। আর এর সত্যতাও পাওয়া যায় ঢাকার পতনের পর গভর্নর হাউজ, যেটি এখন বঙ্গভবন নামে পরিচিত, সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা রাও ফরমান আলির পাওয়া একটি ডায়রি থেকে। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেদিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাও ফরমান আলী।

তবে ১৪ ডিসেম্বরের অনেক অজানা কথা সামনে না আসলেও আজও সেই ভয়াবহ দৃশ্য চোখে ভাসে অনেকের। সেদিন দেশের জন্য জীবন দেওয়া অনেকেই আজও আমাদের হৃদয়ে অম্লান, তাই তাদের সম্মানে তাজ উদ্দিন আহম্মেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেন। অনেক পরে হলেও দেশের সেরা সন্তানদের জন্য গড়ে তোলা হয় স্মৃতিসৌধও।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *