সারাদেশ

কত আসনে জিততে চায় আওয়ামী লীগ

ডেস্ক রিপোর্ট: গণতন্ত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জনগণ, জনগণই করে প্রতিনিধি নির্বাচন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের ক্ষমতা কমে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেশের অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটই দেওয়ার সুযোগ পায়নি কেউ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সারা দেশে ভোট হয়েছিল ঠিক, তবে আছে নানা বিতর্ক।

জনতার ক্ষমতা কমতে যাওয়ার এই সময়ে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আরেকটি নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন নেই। আওয়ামী লীগই নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে এটা শতভাগ নিশ্চিত। প্রশ্ন কেবল ৩০০ আসনের কতগুলো জিততে চায় তারা? নির্বাচনের আগে ফলের এমন নিশ্চয়তাকে কি নির্বাচন বলা যায়—সংগত প্রশ্ন।

সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ পুরো ৩০০ আসনে জিততে চায়নি। এর প্রমাণ দিয়ে রেখেছে তারা দলীয় চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণার দিনেই। ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছিল তারা। এরপর তারা ১৪-দলীয় জোটের শরিক বাকি ১৩ দল থেকে আরও ৭ জনকে সাতটি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এরপর তারা জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে আরও ২৫টি আসন। এছাড়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, কল্যাণ পার্টি, সুপ্রিম পার্টিসহ কিছু দলকে সহানুভূতির চোখে দেখেছে আওয়ামী লীগ।

১৪-দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে যে বৈঠক ও সমঝোতা হয়েছে এতে সকল পক্ষই মনে করছে এই সমঝোতাই নির্ধারণ হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কে বা কারা সংসদ সদস্য হচ্ছেন। অর্থাৎ এসব বৈঠকই মূলত সংসদ সদস্য নির্ধারক। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসে দলগুলো জাতীয় সংসদের আসন ভাগাভাগি করছে। কার ভাগে কয়টি আসন দেওয়া যায়, কে কয়টি আসন নিতে পারে—এনিয়েই মূলত দেনদরবার। কিছু দলকে সংসদ সদস্য দিতে আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি বলে তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। আওয়ামী লীগের পুরনো বন্ধু তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেছেন, ‘৪ ডিসেম্বর গণভবনে জোটের বৈঠকে তার আসনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।’ মাইজভাণ্ডারী তার আসন পাননি। জাকের পার্টিও কোন আসন পায়নি, তাই তারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যদিও এই দলটির কেউ কখনই সংসদ সদস্য হতে পারেননি।

নির্বাচনের আগে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে যে বৈঠকগুলো হয়েছে তাতেই নির্ধারণ হয়েছে কে কোথায় এমপি হচ্ছেন। সরকার-দল আওয়ামী লীগ করছে নির্ধারণ কার ভাগে কত সংসদ সদস্য পড়বে, আর তারা নির্ধারণ করেছে নিজেদের ভাগে কতজন সংসদ সদস্য রাখবে। ফলে ৭ জানুয়ারির যে নির্বাচন সেটা এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। জনগণের ভোট যেখানে সংসদ সদস্য নির্ধারণের মাপকাঠি হওয়ার কথা ছিল, সেটা এখন জনতার হাত থেকে সরে গেছে। মালিক এখন আর জনগণ নয়, এর মালিক সরকার-দল আওয়ামী লীগ।

জনগণের কাছে জবাবদিহি করার কথা জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যম নির্বাচন যেখানে জনগণের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে সেখানে জবাবদিহির আশা করা যাচ্ছে না। নানা বিতর্ক সত্ত্বেও জনগণ যখন নির্বাচনের মাধ্যমের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পেতেন , তখনো নির্বাচনের পর অনেক জনপ্রতিনিধির বিপক্ষে জনতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার অভিযোগ ছিল। আর এখন জনগণই লাগছে না জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে। ফলে জনগণকে পাত্তা না দেওয়ার বিষয়টি আর শক্তিশালী হচ্ছে।

নজির মিলবে ভুরি ভুরি। প্রসঙ্গক্রমে কেবল উল্লেখ: সিলেট অঞ্চলের এক সংসদ সদস্য নিজের এলাকায় সচরাচর যান না। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন তিনি আগে-পিছে পুলিশ প্রহরায় গেছেন এলাকায়। কিছু এলাকায় করেছেন গণসংযোগও। গণসংযোগের একটা পর্যায়ে একজন সাধারণ নাগরিক সরাসরি প্রশ্নও করে বসেন—‘করোনায়-বন্যায় কোথায় ছিলেন আপনি?’ সংসদ সদস্য কিছু বলেননি, বলার কিছু ছিল না তার। একই দিন অন্য একটি এলাকায় তাকে জনসংযোগে নামতে অনুরোধ জানানো হলে তিনি স্থানীয় সরকারের এক জনপ্রতিনিধিকে বলে বসেন—‘আমাকে কেন সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে; তোমরা আছো কীসের জন্যে?’ এসব ঘটনা দল-ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছ থেকে শোনা। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এধরনের বিবর্তন ঘটেছে মূলত জনতাকে ক্ষমতাহীন করে দেওয়ার মাধ্যমে। কারণ এখন জনপ্রতিনিধিরা বিশ্বাস করে বসে আছে—নির্বাচনে জিততে জনতার ভোট আর লাগে না।

নির্বাচনের আর তিন সপ্তাহ সময়। এখনো নির্বাচনী আমেজ লাগেনি দেশে। বরং প্রশ্ন রয়েছে—আগের মতো কি নির্বাচন হবে? সাধারণ নাগরিকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে যে উত্তর পেয়েছি তার সারসংক্ষেপ—ভোট দিয়ে কী হবে, সবাই তো নৌকা! নির্বাচনে যে জিতবে সেই আওয়ামী লীগের, কেউ দলটির দলীয় প্রতীকের, আর কেউবা অন্য প্রতীকের। এমন অবস্থায় মানুষ কীভাবে নির্বাচনে আগ্রহী হয়? প্রান্তে যখন সাধারণের নির্বাচন-ভাবনা এমন, কেন্দ্রে তখন আসন ভাগাভাগির দেনদরবার। অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল সংসদ সদস্য পদ পেতে যেভাবে আওয়ামী লীগের দুয়ারে ঘুরছে তাতে নির্বাচনটাই প্রহসনে পরিণত হতে বসেছে।

আগের নির্বাচনগুলোর সর্বনাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন। এবার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। তারা চেষ্টা করছে, কিন্তু নির্বাচনে বিএনপি না আসায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় উৎসাহিত করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা আবহ আনার চেষ্টা করেছিল, তবে শরিকদের এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দেনদরবারে নির্বাচন ব্যবস্থাই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। জনতার ক্ষমতা এখন চলে গেছে আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগই নির্ধারণ করছে কার ভাগে কয়টি আসন দিয়ে নিজেদের ভাগে রাখবে কয়টি!

নির্বাচনের মৌলিক যে ভাষা প্রতিদ্বন্দ্বিতা—এটা এখন তিরোহিত। ইলেকশন এখন সিলেকশনে পরিণত। প্রার্থীদের ভাগ্যনির্ধারক এখন জনতা নয়, আওয়ামী লীগ। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন তিন সপ্তাহ আগেই প্রায় শেষ। এ দায় কার? দায় কি জনতার? না, এ দায় জনতার নয়; রাজনৈতিক দলের! বিএনপি সমমনাদের নিয়ে নির্বাচনে না গিয়ে, আওয়ামী লীগ অগ্রাহ্যের রাজনীতিকে শক্তিশালী করে রেখে!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *