সারাদেশ

জননিরাপত্তা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

ডেস্ক রিপোর্ট: তারিখকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে দেশের রাজনীতি। বিএনপির ভাষায়, আগামী ২৮ অক্টোবর ‘আন্দোলনের মহাযাত্রা’ শুরু হবে। এই মহাযাত্রার পথ ধরে হবে সরকারের পদত্যাগ। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও একই তারিখে ‘মহাযাত্রার’ কথা বলা হচ্ছে, তাদের লক্ষ্য ‘উন্নয়নের মহাযাত্রা’ অব্যাহত রাখা। দল দুটোর পৃথক ‘মহাযাত্রায়’ নাগরিকের অবস্থা চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

আন্দোলন এখন ঢাকা অভিমুখে। কেন্দ্র দখলই এখন উদ্দেশ্য। বিএনপির যে ‘এক দফা’ সেখানে আছে কেবলই সরকারের পদত্যাগ। সরকারের পদত্যাগ ছাড়া এই মুহূর্তে তাদের ভাবনায় আর কিছু নেই। আগে তাদের দাবির সঙ্গে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কিন্তু এখন এটা দৃশ্যমান নেই। সরকারের পদত্যাগ ছাড়া অন্য কিছুতে নেই বিএনপি। সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদান্তে যে নির্বাচন, সেই বিষয়টি এখন বিএনপির দাবিদাওয়া আর রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে চলে গেছে।

গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দরকার ছিল, সেটা হচ্ছে যদি বিএনপির দাবি অনুযায়ী সরকার পদত্যাগই করে তাহলে কী হবে? কে নেবে দায়িত্ব? এখানে সাংবিধানিক শূন্যতার যে বিষয়টি সামনে আসছে তার উত্তরই বা কী? উত্তর নেই। তাহলে কি বলতে হচ্ছে না, ভয়াবহ সাংবিধানিক সংকটে ফেলার দাবিই জানাচ্ছে বিএনপি? আদতে তাই! এমন অবস্থায় জনগণের কী করণীয়?

এটা বলতেই হয়, জনতা রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশ্লেষণে যায় না। দাবিদাওয়ার আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য নিয়েও ভাবিত নয়। জনসাধারণের এই বিশ্লেষণী ক্ষমতার অভাব কিংবা বিশ্লেষণের অনীহার কারণে বেশিরভাগ সময়েই রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিদাওয়ার মধ্যে যৌক্তিকতা চাইতে অযৌক্তিক কথকতা বিদ্যমান। যে এক দফা দাবি এখন বিএনপির এটা তাই সংবিধানের সঙ্গে যায় না। একটা অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার দুরভিসন্ধি বরং।

বিএনপির এক দফা দাবির মধ্যে আগামী নির্বাচন নেই। তাদের দাবি সরকারের পদত্যাগ। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে সংসদ ভেঙে যায়। এটাই দাবি তাদের। তাহলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হবেন কে? সরকারহীন থাকবে দেশ? তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেটা অসম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তন করতে হলে সংসদকে দিয়েই করতে হবে। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিএনপি কেন এই সাধারণ বিষয়টিই বুঝতে চেষ্টা করছে না?

বিএনপি কীভাবে ভুলে যায়, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের আগে একদলীয় ব্যবস্থার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। পাগল ও শিশু ছাড়া দেশের কেউ নিরপেক্ষ নয়—তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পরেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সংযোজন করতে হয় বিএনপিকে। এটা নির্বাহী আদেশের বিষয় নয় বলে মাঝরাত পর্যন্ত অধিবেশকে টেনে নিয়ে গিয়ে পাশ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থাৎ সংসদকে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছিল। সংসদকে পাশ কাটিয়ে কিছুই সম্ভব ছিল না। এটা বিএনপি সরকারে থেকে প্রমাণ পেয়েছিল, অথচ এখন এটাও ভুলে গেছে। কারণ সংবিধান থেকে বাদ পড়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে সংসদকে, এবং এটা আনতে হলে ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। এখানে তাই সরকারের পদত্যাগের দাবির কোন যৌক্তিকতা নেই। বলা যায়—অহেতুক এক দফা দাবিতে ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি।

একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশন বর্তমানে চলছে। ২২ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটতে পারে নভেম্বরের ২ তারিখে। নির্বাচন কমিশনের ইঙ্গিত অনুযায়ী নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এগুলো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই। এদিকে, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি সংবিধানের চলমান ব্যবস্থায় হয়, তবে সরকারের পদত্যাগ করতে হবে না, সংসদও ভাঙবে না। আর বিএনপির যে দাবি তার কোনোটাই এর সঙ্গে যায় না। তাদের দাবি মানতে হলে সংসদেই নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিল আনতে হবে, এবং সেটা পাশ হতে হবে।

২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচি। তাদের বক্তব্য, প্রচার-প্রচারণা, প্রস্তুতির সবটাই এই একটা তারিখকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কর্মসূচির দিন পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে প্রথম বাধা আসতে পারে, এই শঙ্কায় সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের একটা অংশ ইতোমধ্যেই ঢাকায় চলেও গেছেন, যাচ্ছেন প্রতিদিনই। বড়সড় একটা জনসমাগমের লক্ষ্য তাদের। এমনটা হবে বলেও ধারণা করা যাচ্ছে। দলটির কেন্দ্র থেকে প্রান্তের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের ধারণা ২৮ তারিখে ‘কিছু একটা হয়ে যাবে’! উজ্জীবিত বিএনপির নেতাকর্মীরা ফের আশায় বুক বাঁধছেন, যদিও আগে একাধিকবার তারিখ নির্ধারণ করে সরকারের পতন হয়নি। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এবারের ২৮-২৯ জুলাই এমন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল সরকারের পতনের।

ডেটলাইন ধরে সরকার পতনের যে আন্দোলন সেটা হাস্যকর যদিও, তবু এটা নজিরবিহীন নয়। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল ৩০ এপ্রিল খালেদা জিয়ার পতন হবে বলে এমন ডেটলাইন দিয়েছিলেন। সেই ডেটলাইন ‘জলিলের আল্টিমেটাম’ হিসেবে দেশের ইতিহাসে হাস্যরসের উপাদান হয়ে আছে। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এমন ঘোষণা দিয়েছিল হেফাজতে ইসলামের নেতারা। ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ ঘটিয়ে হেফাজত নেতা প্রয়াত জুনাইদ বাবুনগরী তাদের কথামতো দেশ চলবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর সম্পর্কিত ডেটলাইন এসেছিল বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের সৌজন্যে। অক্টোবরে আমানউল্লাহ আমান ঘোষণা করেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর (২০২২) থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার নির্দেশে। রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, ডেটলাইন ধরে সরকারের পতন আগে কোথাও কখনই হয়নি, এবারও হবে বলে মনে হচ্ছে না।

২৮ অক্টোবর কি তবে আগের অপরাপর তারিখের মতো আরেক তারিখ হবে? উত্তর দেওয়া কঠিন, তবে এখানে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী যেকোনো কিছু ঘটতেও পারে। আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি ভাবছে তাদের সঙ্গে আছে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, ‘২০১৪ সালে যা করতে পেরেছেন, ২০১৮ সালে যেটা করতে পেরেছেন এবার ২০২৩ সালে সেই নির্বাচন আপনি করতে পারবেন না। পশ্চিমারা আমাদের সাহস যোগাচ্ছে; এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেছেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। বাবারে তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা করো। তারে বলতে হবে- আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস- বাবা ভগবান আসসালামু আলাইকুম’।

বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীদের ধারণা কিংবা বিশ্বাস এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী এবারের তারিখ ও আন্দোলন তাই কেবলই কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, এর সঙ্গে আছে অপরাপর অনেক কিছুর যোগ। এমন অবস্থায় সরকার দল আওয়ামী লীগ দিয়েছে পৃথক কর্মসূচি। শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশসহ শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা।

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখন আর থাকে না। মানুষ বুঝে গেছে সকল কর্মসূচির লক্ষ্য নিজেদেরকে ক্ষমতায় নেওয়া আর ক্ষমতায় থাকা। এগুলোতে অংশ নিয়ে থাকে কিছু অনুগত নেতাকর্মী, আর বাকিরা ‘ভাড়ায় খাটা রাজনৈতিক শ্রমিক’। তারা নিজেদের স্বার্থে পুরো দেশকে জিম্মি করে থাকে, এতে হুমকিতে পড়ে জননিরাপত্তা।

জননিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশসহ শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তারা সফল না হলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না!

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *