আন্তর্জাতিক

যত্রতত্র বিদেশি এয়ারলাইন্সের অনুমোদন: উপেক্ষিত দেশীয় স্বার্থ

ডেস্ক রিপোর্ট: একের পর এক বিদেশি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাচ্ছে। এর মধ্যে আরো প্রায় ২০টি বিদেশি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইটে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো। যাত্রী বাড়ছে, তাই এদেরকে পরিবহন সুবিধা দিতে হবে- এই অজুহাতে যত্রতত্র বিদেশি ক্যারিয়ারগুলোকে দেওয়া হচ্ছে অনুমোদন।

বলা হচ্ছে, দেশের প্রধান বিমানবন্দরে অবকাঠামোগত সুবিধা ছাড়াই একের পর এয়ারলাইন্স অনুমোদন পাচ্ছে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর স্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮০ দশকেও ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিদেশি গন্তব্যে যে যাত্রী পরিবহন হতো তার ৭৫ শতাংশের বেশি যাত্রী বিমান পরিবহন করতো। আর এখন বিমান, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স মিলিয়ে সেই হার ২৫ শতাংশের বেশি নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে যদি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও বিশাল উড়োজাহাজের বহর থাকা এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলার মতো দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষে বাজারে টিকে থাকা খুবই দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর সক্ষমতা না বাড়িয়ে এ ধরনের বড় বড় এয়ারলাইন্সের সাথে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ৩৩টি বিদেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এমিরেটস, কাতার, সিঙ্গাপুর, টার্কিশ, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েয়ের মতো বিশ্বখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে বিমান ও ইউএস-বাংলাকে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।

ইতিমধ্যে গারুদা এয়ারলাইন্স, কোরিয়ান এয়ার, জিন এয়ার, ইরান এয়ার, ইরাকী এয়ার, উইজ এয়ারের মতো এয়ারলাইন্স ফ্লাইট চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ), ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আবারো ঢাকা থেকে ফ্লাইট চালাতে চায়। বর্তমানে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ার এশিয়া, এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই, এয়ার এরাবিয়া আরো সংখ্যা আরো বাড়াতে আগ্রহী। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে ইজিপ্ট এয়ার।

১৯৮৬ সালে সপ্তাহে মাত্র দুটি ফ্লাইট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এমিরেটস এয়ারলাইন্স এখন দিনে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এ থেকে বোঝা যায় স্বল্প সময়ে তারা কীভাবে লাখ লাখ বাংলাদেশি যাত্রী পরিবহন করছে।

বিমানের মার্কেটিং বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে বাংলাদেশ ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন ও ইচ্ছেমতো ফ্রিকোয়েন্সি দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে বিমান কিংবা অন্য কোনো দেশীয় এয়ারলাইন্সের পক্ষে এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের সময় দেশের স্বার্থ চিন্তা না করলে দেশীয় এয়ারলাইন্সের মার্কেট শেয়ার কমতে কমতে ১০ শতাংশে নেমে আসবে। তখন চাইলেও আর বিমান কিংবা অন্য কোনো দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

বেসরকারি অন্য একটি এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত ৩০ বছর ধরে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো সরকারি নীতিমালা ও ব্যবসা বান্ধব পরিবেশের অভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি এয়ারলাইন্সের যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড, রিজেন্টসহ প্রায় ৮টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো অভ্যন্তরীণ রুট ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাপটের সাথে টিকে রয়েছে।

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের উদাহরণই দেওয়া যায়। আফ্রিকা মহাদেশের গরিব দেশ হয়েও ইথিওপিয়া বিশ্বের শীর্ষ এয়ারলাইন্সগুলোর একটি। ৭৫ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্সটিকে পেশাদার বিমান সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এরপর একে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক হিসেব বলছে, ২০১৯ সালে দেশের বিমানবন্দরগুলো ৮৫ লাখ আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিচালনা করেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। আর আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথের যাত্রী সংখ্যা হবে দ্বিগুণ। বেবিচক বলছে, অধিক যাত্রীকে সেবা দিতে গেলে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুমোদন দিতে হবে, নতুবা এত যাত্রী কীভাবে সেবা পাবে।

এই প্রসঙ্গে বিমানের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কর্মকর্তা শফিউল আজিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, বাংলাদেশকে এত উদার হলে চলবে না। আগে নিজেদের স্বার্থ দেখতে হবে। শুধু এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুমোদন দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না, একই সাথে বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, দেখুন বিকেল ৪টা থেকে ৮টার পর্যন্ত সময়ে শুধু বিমানেরই ৮টি ফ্লাইট ছেড়ে যায়। অন্যান্য আরো এয়ারলাইন্সকে একই সময়ে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রাইম টাইমে বিমানবন্দরে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ বিমান কিন্তু চাইলেই বিদেশি কোনো দেশে প্রাইম টাইমে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায় না।

বলা হয়ে থাকে, বিদেশি এয়ারলাইন্স আসা মানেই বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। তবে বাস্তবে ল্যান্ডিং চার্জ, অ্যারোনটিক্যাল চার্জসহ বিভিন্ন খাতে হাজার খানেক ডলার আয়ের বিনিময়ে এদেশের মানুষের পকেট থেকে লাখ লাখ ডলার অর্থ ওইসব এয়ারলাইন্সগুলো নিজ দেশে নিয়ে যায়। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের আয়ের টাকা দিতে কালক্ষেপণ করেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছে। এই অবস্থায় এসব এয়ারলাইন্স লাখ লাখ মার্কিন ডলার এখান থেকে নিয়ে গেলে তা রিজার্ভের ওপর আরো চাপ বাড়াবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশীয় এয়ারলাইন্সের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে এসব অর্থের বিশাল অংশই দেশে রাখা যায়। শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই খাত থেকে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *