সারাদেশ

দেশীয় পণ্যে গর্বের টানেল!

ডেস্ক রিপোর্ট: ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল…! ঠিক এভাবেই যেন ছোট ছোট সিমেন্ট ও বালুকণা-লোহাকে জড়িয়ে গড়ে তুলেছে বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলকে। আর সেই টানেল নির্মাণের পেছনে সিমেন্ট, বালি আর রডের শতভাগ জোগান এসেছে দেশীয় উৎস থেকেই।

এর মধ্যে দিয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু টানেলের গায়ে নিজেদের পণ্যের নাম যুক্ত করার গৌরব অর্জন করেনি, নিজেদের সক্ষমতাও জানান দিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

শনিবার (২৮ অক্টোবর) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে কর্ণফুলী নদীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করবেন। এখন থেকে এই টানেল হয়ে মাত্রই তিন মিনিটেই পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীর তলদেশ হয়ে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছা যাবে আনোয়ারায়।

বঙ্গবন্ধু টানেল শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নদীর তলদেশের টানেল নয়, এমন টানেল দক্ষিণ এশিয়াতেই এই প্রথম। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)। দেশে এরকম টানেল নির্মাণের সক্ষমতা না থাকায় বিদেশি ঠিকাদার দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলেও এটিতে দেশীয় উপকরণ-নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এটা ঠিক টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের প্রধান উপকরণ রিং বা সিগমেন্ট এসেছে চীন থেকে। সিগমেন্টের পর টানেল নির্মাণের অন্যতম উপকরণ রড, সিমেন্ট ও বালির শতভাগ জোগান দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া টানেলকে দিনরাত আলোকিত রাখার পেছনে বৈদুত্যিক তার-বাতিসহ অন্য উপকরণও সরবরাহ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশীয় পণ্য ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে টানেল প্রকল্পের পরিচালক হারুন উর রশিদ চৌধুরীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, ‘পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে চায়না প্রতিষ্ঠান সিসিসিসিএল। আমাদের সক্ষমতা এখনও না থাকায় প্রকল্পটি বাইরের ঠিকাদারকে দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এটা ঠিক, তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্য। টানেলে রড, সিমেন্ট, বালু, কেবলসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সরবরাহ করেছে দেশীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোই।

সিগমেন্ট এসেছে চীন থেকে:

টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে। প্রথমে টানেল বোরিং মেশিনের (টিবিএম) মাধ্যমে খনন করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে বসানো হয় টানেলের মূল কাঠামো-সিগমেন্ট। ১১ দশমিক ৫ টন ওজনের আটটি সেগমেন্ট গোলাকার বসিয়ে ২ মিটারের এক-একটি রিং তৈরি করা হয়। এরপর সেটি সুড়ঙ্গের ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি রিংয়ের ওজন প্রায় ৮৮ টন। টানেলের দুটি সুড়ঙ্গে সর্বমোট ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্ট বসাতে হয়েছে। স্টিলের তৈরি এই সিগমেন্ট আনা হয়েছে চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়াং শহরের টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্ট থেকে।

রডের জোগান দিয়েছে দেশীয় তিন প্রতিষ্ঠান:

টানেল বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ও নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসেব অনুযায়ী টানেলের পুরো প্রকল্পে মোট ৩৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ইস্পাত ব্যবহার করতে হয়েছে। এসব রডের পুরোটাই সরবরাহ করেছে দেশের তিনটি রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম, কেএসআরএম ও জিপিএইচ ইস্পাত। এর মধ্যে টানেলের ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ২৭ হাজার মেট্রিক টন রড সরবরাহ করে বিএসআরএম। বাকি রডের মধ্যে কেএসআরএম ৭ হাজার মেট্রিক টন এবং জিপিএইচ ইস্পাত সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন রড সরবরাহ করেছে।

সিমেন্টও সরবরাহেও দেশীয় তিন প্রতিষ্ঠান:

পুরো টানেলটি বাস্তবায়ন করতে ২১৫ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট প্রয়োজন পড়েছে। এই নির্মাণসামগ্রীর শতভাগও এসেছে দেশীয় তিন প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট, রুবি সিমেন্ট ও কনফিডেন্স সিমেন্ট। এর মধ্যে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ৮৫ হাজার মেট্রিক টন, রুবি সিমেন্ট ৭৫ হাজার মেট্রিক টন এবং কনফিডেন্স সিমেন্ট ৫৫ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট সরবরাহ করেছে।

ক্যাবলস এসেছে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে:

টানেলের ভেতরে আলোকায়নে বসানো হয়েছে হাজারো বাতি। এর সঙ্গে বায়ু চলাচল সচল রাখতে বসানো হয়েছে জেট ফ্যানও। ভারি এসব বাতি আর ফ্যানের জন্য টানেলে ব্যবহার করতে হয়েছে ৭৫০ ডিগ্রি সহনীয় বিশেষ তার। আর এসব তার সরবরাহ করেছে দেশের তিন প্রতিষ্ঠান। তারের ৮০ শতাংশই সরবরাহ করেছে বিবিএস ক্যাবলস। বাকি তার দিয়েছে বিআরবি ক্যাবলস এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ক্যাবলস লিমিটেড।

অর্থাৎ টানেলের রড, সিমেন্ট, ক্যাবল নয়টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করেছে। আর প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত বালুও এসেছে দেশীয় উৎস থেকে। সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে আনা হয়েছে এসব বালু।

তবে সিগমেন্টের মতো প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পাথর, লাইট, ফায়ার বোর্ড, ডেকোরেটিভ বোর্ড আমদানি করতে হয়েছে বিদেশ থেকে। এর মধ্যে পাথর এসেছে দুবাই থেকে। বাকিগুলো আনা হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে।

ব্যবসায়ীরা মনে করছেন টানেল নির্মাণে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার নির্মাণসামগ্রী শিল্প খাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা কতটা-সেটিও বিশ্বের কাছে বার্তা গেল। ফলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে রড, সিমেন্ট, ক্যাবলসহ নানা নির্মাণসামগ্রী রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *