‘নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ সমাজের বিভাজন দূর করা’
ডেস্ক রিপোর্ট: ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ফের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিএনপি-সহ বেশকিছু দল অংশ নেয়নি। বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সমাজের বিভাজন দূর করাই প্রথম চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
তিনি মনে করেন, রাজনীতিতে যারা নিজের চেয়ে সমাজের কথা বেশি চিন্তা করেন তাদেরকেই ক্ষমতায়িত করা জরুরি। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাসহ আর্থিক খাতে সংস্কারের যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তারও দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চান তিনি।
সোমবার (৮ জানুয়ারি) সকালে বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব তাগিদ দেন বিশিষ্ট অর্থনীতি ড. আতিউর রহমান। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: নতুন সরকারের বড় দায়িত্ব কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: ভালোয় ভালোয় নির্বাচনটা যে হয়ে গেল এটা আমাদের জন্য একটি স্বস্তির বিষয়। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জও কিন্তু রয়ে গেছে। প্রথম চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে-সমাজের ভেতর যে বিভাজনটা হয়ে গেল এই বিভাজনকে দূর করতে হবে, আমি সামাজিক বিভাজনের কথা বলছি-ধীরে ধীরে একে স্বস্তির দিকে নিয়ে আসতে হবে। বিভাজন যেন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা না হয়। রাজনৈতিক বিভাজনটা যেন অর্থনৈতিক অঙ্গনে না ঢুকে পড়ে, এটি সব সময় খেয়াল করতে হবে। অপরদিকে অর্থনৈতিক সংস্কারে আমাদের যেতে হবে, সরকার যেটি ইতিমধ্যেই শুরু করেছে বা প্রস্তুতি নিয়েছে। নতুন সরকারের দায়িত্বও হবে এটি বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে-সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা তা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা। মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময় হারকে নমনীয় করে একটা জায়গায় আনা, যেখানে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক রেট কাছাকাছি চলে আসে। যাতে করে প্রবাসীরা আরও উৎসাহিত বোধ করবেন বেশি করে রেমিটেন্স পাঠাতে। এটা নানা ভাবে হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অলরেডি এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। যতটুকু জানি রেট অব ইন্টারেস্টের ক্ষেত্রে তারা মাঝামাঝি একটা পথ বেছে নিয়েছে। বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও তারা সেরকম একটি হার খোঁজে নেবে বলে আমার প্রত্যাশা। সেই সাথে যারা ছোটখাটো উদ্যোক্তা, যারা কম প্রবাসী আয় পাঠান এক হাজার বা দুই হাজার ডলার, তাদের জন্য আরও একটু ইনসেনটিভ বাড়ানো যায় কিনা। অপরদিকে ফিসক্যাল বা রাজস্ব বাজেটকে আরও একটু যুক্তিযুক্ত করা, যেখানে প্রয়োজন নাই সেখানে খরচ কমিয়ে রাখা এবং বাজেট ঘাটতি যেন আর না বাড়ে সেটার দিকে নজর রাখা। সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়া-এই সব বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে।
বার্তা২৪.কম: তিন দফার সরকার ক্ষমতায় থাকার পর যেটি প্রবলভাবে নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে উচ্চারিত হয়েছে যে সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের সততা ও মূল্যবোধের ঘাটতি রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
ড. আতিউর রহমান: দেশ পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেম ও সততাই তো স্বতঃসিদ্ধ চাওয়া। কিন্তু এটি রাতারাতি অর্জিত হবে বলে মনে করি না। এক ধরণের সংস্কারের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। আমাদের ডিজিটাল যে প্রযুক্তি এসেছে, সেটি ভালোভাবে সদ্ব্যবহার করলে অনেক জায়গায় স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা আনা সম্ভব, তখন আশা করি দুর্নীতির পরিমাণ কমে আসবে। যে রকম নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, সবকিছুতে শূন্য সহিষ্ণুতা রাখা হবে-তা নিশ্চিত করা। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সিগন্যাল গেছে বলেই মনে করি, যা খুশি তাই করেই পার পাওয়া যায় না। যারা বাড়াবাড়ি করেছেন তারা কিন্তু ভোটারদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন। অনেককেই ঝড়ে পড়তে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু কোন হস্তক্ষেপ করেননি, সবার জন্য সমান সুযোগ উন্মূক্ত রেখেছিলেন, বলেছিলেন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। যারা ভালো তাদেরই ফিরে আসতে হবে। পুরোটা না এলেও সিগন্যালটা স্পষ্ট, দরকার হলে তিনি শক্ত অবস্থানে যেতে পারেন, এটা আমার কাছে একটা আশাজাগানিয়া বিষয়।
বার্তা২৪.কম: মূল্যবোধের চর্চায় রাষ্ট্রের সব অঙ্গগুলোর আরও কি করা উচিত হবে?
ড. আতিউর রহমান: শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে, বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একেবারে স্কুল পর্যায় থেকে এটি শুরু করতে হবে মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চর্চা। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই শুভ সংস্কৃতির চর্চা হওয়া উচিত। প্রয়োজনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাহেট বাড়িয়ে যে সকল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আছে, তাদের কাজে সহায়তা করা। সংস্কৃতিজনদের নিয়ে একটি জুরি বোর্ড করা উচিত, যার মাধ্যমে সব জায়গাতে সহযোগিতা অবারিত করা যায়।
বার্তা২৪.কম আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক পরম্পরা সাম্প্রতিক দশকে নানাভাবে বিনষ্ট হয়েছে। এর থেকে উত্তরণে কি করণীয়?
ড. আতিউর রহমান: তরুণ সমাজকে আরও উজ্জীবিত করতে হবে। তরুণরা এক রকম চ্যালেঞ্জে থাকে, কারণ তারা কাজ পায় না। রাজনীতিতে যাঁরা ভালো ও সৎ মানুষ, আদর্শের প্রতিভূ তাদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। যাঁরা নিজের চেয়েও সমাজকে বেশি ভালোবাসেন, তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।