সারাদেশ

‘এই সহিংসতা সুপরিকল্পিত, হরতাল দেওয়াই লক্ষ্য’

ডেস্ক রিপোর্ট: তবু সংঘাত, ধাক্কা….

২৮ অক্টোবর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি হলে সংঘাতই নিয়তি যেন। তবু এরই মধ্যে ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। সংঘাতেই আগে-ভাগে শেষ হয়েছে প্রায় প্রতি দলের কর্মসূচি।

রাজনৈতিক সংঘাত বলতে উসকানি দিয়ে নেতাকর্মীদের উত্তেজিত করার বিষয় আমরা আগে দেখেছি, কিন্তু এবার সেভাবে হয়নি। তবে উত্তেজিত কর্মীরা নিজেরা জড়িয়েছে সংঘাতে। প্রাণের অপচয় হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সম্পদহানি হয়েছে। একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অন্তত ৪১ জন পুলিশ সদস্য। আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিকেরা। আক্রান্তদের প্রকৃত সংখ্যা এখনই বলা যাচ্ছে না।

কী কারণে এই সংঘাত—এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে, তবে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ডের অন্যতম কারণ মহাসমাবেশের কাছাকাছি এলাকার সংঘাত। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য সূত্রে জানা যাচ্ছে, হঠাৎ করে বেলা ১২টার পর থেকে বিএনপি কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাড়ির ফটকে ও জাজেস কোয়ার্টারের সামনে আক্রমণ করে। আইডিবি ভবনের সামনে দুটি গাড়িতে আগুন দেয়। বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, এবং পুলিশ সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিএমপির ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।

বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে বিএনপির নেতাকর্মীরা গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে নামফলক, ফটকে হামলা চালায়। তারা ভেতরে ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এর মধ্যেই কাকরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন দেয় বিএনপির অনুসারীরা। পুলিশ বাধা দিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনার রেশ ধরে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। কাকরাইল, পল্টন ও বিজয়নগরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। কালভার্ট মোড়, পুরানা পল্টন ও সেগুনবাগিচা—এই তিন দিক থেকে ঘেরাও করে পুলিশকে আক্রমণ করে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটের নেতাকর্মীরা, পুলিশ প্রতিহত করে। পানির ট্যাংক মোড়ে অবস্থান নিয়ে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়ে। এরই মাঝে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর হয়, আগুন দেওয়া হয়, আক্রান্ত হন রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যরা।

রাজধানীর জায়গায়-জায়গায় যখন এমন সংঘর্ষ চলছিল তখন বিএনপি নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করছিল। এরপর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে পুলিশ নামে অ্যাকশনে। পুলিশি ভূমিকায় শেষ পর্যন্ত তড়িঘড়ি করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মহাসমাবেশ শেষ করতে হয় বিএনপিকে। বিএনপির নতুন কর্মসূচি হচ্ছে রোববার সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল। এই হরতাল নিয়ে আবার তিন দফা ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। প্রথমে রোববার সারাদেশে হরতাল জানানোর পর, পরে কেবল ঢাকায় হরতালের ঘোষণা দিয়েছিল দলটি। এরপর তৃতীয় দফায় নতুন ঘোষণায় জানা যাচ্ছে, কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নয়, রোববার সকাল সন্ধ্যা হরতাল সারাদেশে।

বার্তা২৪.কম গতকাল (২৭ অক্টোবর) প্রকাশিত এক নিবন্ধে যে শঙ্কার কথা বলেছিলাম সে শঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। ‘বিএনপি কি পারবে নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে’ শিরোনামে সেই লেখায় বলেছিলাম নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা। বলেছিলাম, নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে নাটাই সরকারের হাতে চলে যাবে। সেটাই হয়েছে। বিএনপির উত্তেজিত নেতাকর্মীরা যেভাবে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে, হাসপাতালে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে তাতে বিএনপি আদতে ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জানিয়েছেন, ‘রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে হামলা, ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। শনিবার বেলা ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে এ আগুন দেওয়া হয়।’ অথচ সকলেই জানে, হাসপাতাল কোন অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না, এমনকি যুদ্ধাবস্থাতেও না। দেশে যুদ্ধ চলছে না, চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচি। যুদ্ধাবস্থায়ও যে হাসপাতাল আক্রান্ত হতে পারে না, সেই হাসপাতাল আক্রান্ত হয়েছে আজকের কর্মসূচির দিনে।

অস্বীকার করার উপায় নাই, আজ রাজধানীর জায়গায়-জায়গায় সমাবেশের যে অনুমতি মিলল রাজনৈতিক দলগুলোর, সেখানে আছে মার্কিন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রভাব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রভাবও আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এমন অবস্থায় পুলিশের সঙ্গে সংঘাত, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, হাসপাতালে আগুন-ভাঙচুরসহ নানা ঘটনা বিএনপির জন্যে বিব্রতকর হয়ে ওঠেছে। এই কর্মসূচিতে সারাদেশের মানুষের চোখ যেমন ছিল, তেমনি ছিল পশ্চিমা-চোখও; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কি বেকায়দায় পড়ে গেল না বিএনপি?

আগের লেখায় বলেছিলাম, ‘শৃঙ্খলার বাইরে কিছু ঘটলে বিপুল জনসমাগম ঘটিয়েও কোন লাভ হবে না বিএনপির, বরং জননিরাপত্তা রক্ষার নামে আন্দোলনে শক্তি প্রয়োগ করে সেটা ভণ্ডুল করে দেওয়ার পথ পেয়ে যাবে সরকার।’ সেটাই কি ঘটল না? যখনই সুযোগ পেল তখনই পুলিশ বিএনপির মহাসমাবেশকে পণ্ড করে দিল!

আজকের এই সংঘাতে আওয়ামী লীগ জড়ায়নি। পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা হতাহত হয়েছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির কর্মীরা আহত হয়েছেন। এই সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় কি অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ল না বিএনপি? বিপুল জনসমাগম ঘটিয়েও তারা মহাসমাবেশ সফল করতে পারেনি, আবার উত্তেজিত কিছু নেতাকর্মীর কারণে দেশে-বিদেশে পড়েছে ভাবমূর্তি সংকটে। এরবাইরে সবচেয়ে বড় ক্ষতির জায়গা তাদের মনস্তাত্ত্বিক; যে নেতাকর্মীরা ২৮ অক্টোবর ‘দেশে কিছু একটা হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে যাবে’ বলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন তারা বড়ধরনের ধাক্কা খেল। তাদের এই ধাক্কার প্রভাব হয়তো অনেকখানি, যা অনুদিত হতে পারে বিএনপির আগামী দিনের কর্মসূচিগুলোতে।

সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় বার্তা ২৪-এ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *